ত্রাণ নিয়ে গাজার উদ্দেশ্যে প্লাবিত হওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের সবশেষ জাহাজটিও শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক করা হয়েছে। গাজার উপকূলে পৌঁছুমাত্র ‘ম্যারিনেট’ নামের জাহাজটিকে দখলে নেয় সেনাবাহিনী। এর আগে ফ্লোটিলার অন্যান্য সব জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করেছিল ইসরায়েলি নৌবাহিনী; আর এখন শেষ চলন্ত জাহাজটিও আটক হওয়ায় সমগ্র বহরের অবরোধ ভাঙা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলম জানান, এরপরও অন্য একটি জাহাজ ৯টি নৌবহর নিয়ে গাজা অভিমুখে এগিয়ে চলছিল। শেষ পরিস্থিতিতে স্পষ্ট যে—সুমুদ ফ্লোটিলার অভিযান অবরোধ ভাঙতে না পারলেও তারা বিশ্বজুড়ে একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। এবারের বহরে ছিল ৪০টিরও বেশি বেসামরিক নৌযান; মোটামুটি ৪৪টি নৌযানে প্রায় ৫০০ মানুষ রওনা হয়েছিল—যাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের নাগরিক, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা।
আটকের পর ফ্লোটিলার দাবি ও চাহিদা
২ অক্টোবর একের পর এক জাহাজ আটক হওয়ার পর সুমুদ ফ্লোটিলা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, ইসরায়েলি নৌবাহিনী তাদের জাহাজগুলো অবৈধভাবে আটক করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এটি একটি শান্তিপূর্ণ, অসহিংস কনভয় যা গাজায় খাদ্য, শিশুর দুধ, ওষুধ এবং ৪৭টি দেশের স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের বক্তব্য—শত শত অংশগ্রহণকারী অপহৃত হয়েছেন এবং রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের বড় নৌযানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সরকারের, বিশ্বনেতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তৎক্ষণাত হস্তক্ষেপের through নিখোঁজ অংশগ্রহণকারীদের অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের নিরাপত্তা ও মুক্তি দাবি করেছে। পরে ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া অধিকারকর্মীরা অঙ্গীকার করে বলেছেন,
‘‘আমাদের অঙ্গীকার পরিষ্কার—ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ভেঙে ফেলা এবং প্যালেস্টাইনিদের বিরুদ্ধে চলমান জাতিগত নিধন বন্ধ করা। আমাদের ফ্লোটিলার বিরুদ্ধে যেকোনও দমনমূলক পদক্ষেপ, গাজায় সহিংসতার যেকোনও বৃদ্ধি এবং সংহতি কর্মসূচি দমন করার যেকোনও চেষ্টা আমাদের সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।’’
ফ্লোটিলার আলাদা কৌশল ও শহিদুল আলমের বার্তা
সব জাহাজ আটক হওয়ার খবরে বিশ্বমিডিয়া যখন তৎপর, ঠিক তখনই দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলম নানান ভিডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন যে তারা এখনও চলমান এবং গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহর থেকে আলাদা অবস্থানে রয়েছেন। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন,
‘‘আজ ৩ অক্টোবর ২০২৫। দেখতেই পাচ্ছেন, ঝকঝকা রোদ। আজ আমরা ফিলিস্তিন টাইম জোনে এসেছি। সুমুদ ফ্লোটিলায় যারা গিয়েছিলেন, তারা ভিন্নভাবে গিয়েছিলেন। আমরা আলাদাভাবে যাচ্ছি। এভাবেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল যে ওদের ওপর কিছু হলেও আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি। জানতে পেরেছি, ইসরায়েল তাদের (সুমুদ ফ্লোটিলা) সব জাহাজ আটক করেছে।’’
শহিদুল আলম স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তারা ত্রাণ নিয়ে নয়—অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘‘এটা বলা প্রয়োজন, সুমুদ ফ্লোটিলায় যে নৌকাগুলো ছিল, তাদের কিন্তু দায়িত্ব ছিল ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার। আমরা কিন্তু ত্রাণের জন্য যাচ্ছি না। আমরা একটা অবৈধ অবরোধকে ভাঙব, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছি।’’
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা
ফ্লোটিলা আটক হওয়ার খবরে ইতালি ও কলম্বিয়াসহ গ্রিস, আয়ারল্যান্ড ও তুরস্কে বিক্ষোভ দেখা দেয়; ইতালির শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সাধারণ ধর্মঘট ডাক দেয়। বহরে থাকা সুইডিশ মানবাধিকারকর্মী গ্রেটা থানবার্গসহ চার শতাধিক বিদেশি কর্মী আটক হওয়ায় আন্তর্জাতিক স্তরে তীব্র নিন্দা ও চাপ পড়ে ইসরায়েলের ওপর। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা দ্রুত তাঁদের মুক্তির দাবি জানান; বহরে ছিলেন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বও—যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি জওলিভেলিলে ম্যান্ডেলাও।
এই ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াও কঠোর ছিল। শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘এই কাজ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ইসরায়েলের ব্যবহারের নির্লজ্জ প্রকাশ।’’ বম্বিহত বন্দী মানবিক সহায়তাকারী ও অধিকারকর্মীদের অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি ও তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
















