কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন স্টিভ স্মিথ এর বল ট্যাম্পারিং নিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বই টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। সেটি আবার প্রচন্ড গতি পেয়েছিল কিংবা সুইং রিভার্স সুইং হয়েছিল স্মিথের স্বীকারোক্তি এবং সেখানে প্রায় পুরো টিমের জড়িয়ে পড়ার কারনে।তারপর নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত গিয়ে থেমেছিলো সেই ঝড়।
বল ট্যাম্পারিং নিয়ে তখন অসংখ্য ব্যাখ্যা এসেছিল। স্মিথ আর মিডিয়ার কল্যাণে সবাই কমবেশি ব্যাপারটা অবগত হয়েছিলেন নতুন করে।
সারমর্মটা এমন “বল পুরাতন হয়ে গেলে সুইং পেতে বলের দুই দিকের মাঝে পার্থক্য তৈরি করা” ।
অর্থাৎ একদিক মসৃণ হলে থাকলে এবং অন্যদিক রুক্ষ করে নিলে দুইদিকের মাঝে একটি চাপের তারতম্য সৃষ্টি হয় ।মসৃণ অংশ স্বাভাবিকভাবেই বাতাসের চাপ তৈরি করে আর রুক্ষ অংশ সৃষ্টি করে তুলনামূলক বেশী চাপ। আর বলের গতিপথ ক্রমপরিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয় রিভার্স সুইং এর । স্বাভাবিক সুইং এর ক্ষেত্রে বোলাররা বলের মসৃণ ভাগ সামনের দিকে রাখলে ও রিভার্স সুইং এর ক্ষেত্রে রুক্ষ ভাগকে ই সামনে রাখেন এবং বলটি লোকানোর চেষ্টা করেন যাতে করে ব্যাটসম্যান রিড করতে না পারে ।
রিভার্স সুইং এর জনক বলা হয় পাকিস্তানিদের। বিশেষ করে সরফরাজ আর ইমরান খানের নেতৃত্বে এই কূট কৌশল কিংবা শৈল্পিক চর্চাটার শুরু হলেও সুইং সুলতান ওয়াসিম আকরাম আর গতি দানব ওয়াকার ইউনুসের কল্যাণে রিভার্স সুইং একটি শৈল্পিক ক্রীড়াকৌশল হিসাবে বিবেচিত হয়ে উঠে।
পাকিস্তানিরা ছাড়া অন্যরা যতক্ষণ পর্যন্ত এই কৌশলটি আয়ত্তে আনতে পারেনি ততক্ষণ পর্যন্ত রিভার্স সুইং কে প্রতারণা বল্লেও যখনই অস্ট্রেলিয়া -ইংল্যান্ড -সাউথ আফ্রিকা -নিউজিল্যান্ড এমন কি ভারতের বোলাররা আয়ত্তে নিয়ে আসলো তখন থেকেই এইটা কে শৈল্পিক কিংবা বুদ্ধিমত্তার কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করা শুরু হলো ।
বিশুদ্ধবাদীরা অবৈধ শিল্প বলে ও অবিহিত করেন
মজার ব্যাপার হলো -ক্রিকেট আইনে বলা হয়েছে ,”কোন দল চাইলে বল চকচকে করতে পারবে কিন্তু সেজন্য কোন কৃত্রিম বস্তু ব্যবহার করা যাবে না “।
এই বিধান মেনে কোন দল বা বোলার যদি প্রতিনিয়ত রিভার্স সুইং করাতে সক্ষম হয় কিংবা সক্ষমতা অর্জন করে তবে সেটা কে অবৈধ বলাটা কি আসলেই ন্যায়সঙ্গত ?
ধারাভাষ্যকাররা ফাস্ট বোলারদের অসাধারণ কোন স্পেল এর ক্ষেত্রে রিভার্স সুইং এর কথা বলে কমেন্ট্রি বক্সে ঝড় তুলেন । রিভার্স সুইং করাতে যেহেতু বলের কিছু পরিবর্তন করাতে হয় এবং বল খেলার উপযোগী কি না সেটার ছাড়পত্র দিতে মাঠের দুইজন সাথে মাঠের বাহিরের আরো দুইজন অফিসিয়াল আছেন এবং তাহারা প্রতিনিয়ত বল পরীক্ষা করে থাকেন তাহলে এই বৈধতার মাঝে অবৈধ বলাটাই বা কতটুকু যৌক্তিক।
ওয়াসিম আকরাম একবার বলেছিলেন, রিভার্স সুইং পেতে হলে যেহেতু বলের একদিক চকচকে এবং অন্যদিক রুক্ষ হলে উত্তম হয় সেজন্য খেলা শুরু হলেই সবাইকে বলে দিতে হয়- বলের একদিকে ঘষতে।
আর থার্ডম্যান কিংবা লংঅফ -লংঅনের ফিল্ডারদেরও বলে দেওয়া হয়- বল উইকেট কিপারের কিংবা বোলারের হাতে ফিরত দেওয়ার সময়ে যেন মাঠিতে এক কিংবা দুই বাউন্সে পৌছানো হয়।এতে করে বল তাড়াতাড়ি পুরোনো হয় এবং রিভার্স সুইং এর কার্যকারিতা শুরু হয়।
সমস্যা হলো এই স্বাভাবিকের চাইতে আগ বাড়িয়ে বল পুরনো বানানো কিংবা ঘষাঘষি করতে গিয়ে অনেক কিংবদন্তী ক্রিকেটারই অধিক দ্রুততায় ভিন্ন পন্থায় তা করতে গিয়ে ট্যাম্পারিং এ জড়িয়ে পড়েন।
যেমন ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের কাপ্তান মাইক আথারটন টাউজারের পকেটে বালু রেখে বল ঘষাঘষি করেন ।২০১৩ সালে সাউথ আফ্রিকার ফাফ ডু প্লেসি টাউজারের জিপারের সাথে বল ঘষাঘষি করেন।২০১৬ সালে ইংলিশ অলরাউন্ডার জো রুট বলে গামের সাথে থুথু ঘষতে ঘষতে ম্যাচের পর পেঠের পীড়ায় পড়েন।
২০০৬ সালে ওভালে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে বল ট্যাম্পারিং এর অভিযোগ আনেন ম্যাচের দুই আম্পায়ার ।জরিমানা করা হয় পাঁচ রান। এর প্রতিবাদে ইনজামাম উল হক দল নিয়ে মাঠ ছাড়েন ।আর খেলতে না নামাতে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে (ফোরফিট) জয়ী ঘোষণা করা হয় ।যদি ও অনেকদিন পর পাকিস্তান এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পায় ম্যাচ টি ড্র ঘোষণা করা হয়।
সাউথ আফ্রিকান সাবেক ক্যাপ্টেন ডু প্লেসি আরেকবার মিন্ট চুইংগাম চিবিয়ে বল চকচকে করতে ব্যবহার করেন।পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি তো আরেক কাটি এগিয়ে হাতের মাঝে বল নিয়ে সুতায় কামড়িয়েই দিয়েছিলেন একাধিকবার । ভারতের জহির খানের বিপক্ষে বলের মাঝে জেলি বিন ব্যবহারের অভিযোগ করেছিলো ইংলিশরা ।
কিংবদন্তী শচীনের বিপক্ষে আম্পায়ারদের কোন অভিযোগ না থাকলে ও ম্যাচ রেফারি নখ দিয়ে বলের সিম নষ্টের অভিযোগ তুলেন ।
সাসপেন্ডও হন যদিও পরে সেই শাস্তি বাতিল করা হয়।পরের ম্যাচে ভারত এই ম্যাচ রেফারির অধীন খেলতে অস্বীকার করে এবং ম্যাচ রেফারি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।
ওয়াকার ইউনুসের বিপক্ষে নখ দিয়ে বলের সিম তুলার অভিযোগ উঠেছিলো ম্যাচ ফি কর্তনও হয়েছিল ।
আর ইংরেজীতে শব্দটি TEMPERING (টেম্পারিং ) নয় শব্দটি TAMPERING( ট্যাম্পারিং )Tempering হলো লোহা গরম করার বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ।আর Tampering হলো কোন বস্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে বিকৃত করা কিংবা পরিবর্তিত করা ।
আর হ্যাঁ এই রিভার্স সুইং করাতে হলে অন্যতম যে প্রধান যোগ্যতা অর্জন করতে হয় সেটা হলো ঘন্টায় ১৪৫/১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করা। যেখানে ভারত -বাংলদেশ -শ্রীলংকার বোলারা যোগ্যতার বা সুযোগের অভাবে ভালো ছাত্র বা বোলার ।
যে দুএকজনের গতি আছে, ছিলো তারা ঠিকই এইটার চর্চা করেন। যা ভারতীয়দের বর্তমান বোলিং ইউনিটের দিকে নজর দিলেই পরিস্কার।বিশেষ করে মোহাম্মদ সামী তো বিশ্বকাপে খুবই দ্রুত তছনছ করে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইন।
অসি ওপেনার ক্যামেরুন ব্যানক্রফট এর স্বীকারোক্তিটা খুবই ইন্টারেস্টিং। তিনি বলেছেন -“আমি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিলাম “। মানে কি এমন না যে ধরা পড়াতেই এতো হইচই না হলে এসব হচ্ছে প্রতিনিয়তই ।
আর অস্ট্রেলিয়ানদের যেন স্ট্রিং অপারেশনের ফাদেই আটকালেন সাউথ আফ্রিকার সাবেক পেসার হালের ধারাভাষ্যকার ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স ।তার বর্ণনায় প্রথম টেস্ট ম্যাচের সময় ও ওয়ার্নারের চোট পাওয়া হাতের তালুতে হলুদ টেপ জড়ানো ছিলো এবং বলে ও ঘষেছিল।
তৃতীয় টেস্ট চলাকালীন যখন দেখলাম ২৬-২৭-২৮ তম ওভারেই বল অতিরিক্ত সুইং করতেছে তখনই সাউথ আফ্রিকান সুপার স্পোর্ট নেটওয়ার্ক এর ক্যামেরাম্যানদের নজরদারি বাড়াতে তাগিদ দেই । জোটানি অস্কার অসি অসভ্যতার পুরো চিত্রই ক্যামেরাবন্দী করতে সক্ষম হন ।
অস্ট্রেলিয়ানদের এই জোচ্চুরি এবং ক্যাপ্টেনের স্বীকারোক্তির পর ও আসলে সম্মান পুনরুদ্ধার অনেক কঠিন । আর অস্ট্রেলিয়ানা এখন তিন মোড়লের এক হলে ও তাদের জোচ্চুরির ইতিহাস কি অনেক পুরাতন ।
এক নজরে অতীত…
১.ম্যাচের শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের দরকার ৬ রান এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন গ্রেগ চ্যাপেলের পরামর্শে তারই ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেল করে বসেন কুখ্যাত আন্ডারআর্ম বোলিং।ম্যাচ জিতে অস্ট্রেলিয়া কিন্তু মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ট্রেভরের বিয়ে ভেংগে যায় । আর বিয়েও করেননি। সন্তান বিহীন নি:সঙ্গ জীবনে বাচ্চাদের কোচিং করান ।
২.ভারতের বিপক্ষে আউট হবার পর স্টিভ স্মিথ রিভিউ নিবেন কিনা এজন্য ড্রেসিংরুমের দিকে ইশারা করেন ।ধরা পড়ার পর বলেন ব্রেইন ফেইড হয়ে গিয়েছিল ।
৩.মাঠে অনর্গল স্লেজিং করার কারনে সাবেক ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ এর অন্য নামই ছিলো মাউথ মটর ।
৪.ডেনিস লিলি একবার এলুমেনিয়ামের ব্যাট নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে পড়েছিলেন ।
৫.শচীন ডাক করতে গিয়ে তাহার শোল্ডারে বল লাগলে ম্যাকগ্রার নেতৃত্বে সারা দল আপিল করলে এলবিডব্লিউ আউট হন শচীন ।
৬.অস্ট্রেলিয়ার মাঠিতে ব্যাটিংয়ের সময়ে কপিল দেবের একটি হিটে একটি কবুতর মাঠেই মারা যায় ।আপসেট কপিল অসি ফিল্ডারদের কাছে পানি চাইলে স্টিভ ওয়াহ উত্তর দেন পানি নাই ।আনিয়ে পান করো …।
শেষ কথায় …
ফুটবলে একটি কৌশল আছে যেটাকে বলা হয় নাটমেগ।অর্থাৎ কিনা প্রতিপক্ষের দুপায়ের মাঝ দিয়ে বল নেয়া ।কৌশলটি খুবই বৈধ তবে প্রতিপক্ষের জন্য নাকি খুবই অপমানজনক। এজন্য নেইমারকে একবার এক ডিফেন্ডার চড়ও মেরে বসেছিল ।তো, ফুটবল তো সবাই খেলেন, তবে মেসি -নেইমার -রোবেনদের মতো নাটমেগ কয়জনই বা পারেন?
তেমনি অনেকেই ভালো বোলিং করেন কিন্তু রিভার্স সুইং কেন সবাই করান না ? কারণ রিভার্স সুইং করাতে যে গতি; যে লাইন লেন্থ এবং কৌশলের দরকার সেটা সবার আয়ত্তে থাকে না । যারা পারে তারা অই মেসিদের মতোই কৌশলী- প্রতিভাবান এবং অতি অবশ্যই শৈল্পিক।
ক্রিকেট রোমান্টিক হলে মনে রাখা দরকার এখনকার সুইং বোলাররা যা করেন বল দিয়ে কিংবদন্তী ওয়াসিম আকরাম সেটা কমলালেবু কিংবা জাম্মুরা দিয়েই করতে পারতেন ।
আর নিয়মের মধ্যে থেকে ক্রিকেট আইনের বর্ণিত বলের আকার নিয়েও যে রিভার্স সুইং করাতে পারে সেটাকে কষ্টার্জিত শিল্পই বলা চলে।
প্রতারণা নয় কারণ বল তো চারজন আম্পায়ারের সামনেই হচ্ছে।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক । টরেন্টো, কানাডা।
৪ জানুয়ারী ২০২৪
আরও পড়ুন-