পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য অন্যতম সেরা দেশ কানাডা সবসময় ইমিগ্রান্ডদের প্রথম পছন্দের জায়গা। বিশ্ব রেংকিং ও আপনার পছন্দের পক্ষে কথা বলবে। ইদানিংকালে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ স্টুডেন্ট এবং ভিজিট ভিসা ইস্যু করছে কানাডিয়ান দূতাবাস। আমাদের বাংলাদেশের তারুণ্যের বড় একটি অংশ এমনিতেই বিদেশমুখী তার উপর কানাডার মত দেশ যেভাবে ভিসা ইস্যু করছে, সে জন্য ইদানিং কোয়ালিফাইয়ার -নন কোয়ালিফাইয়ার সকলে সে সুযোগ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, নিয়েছেন এবং ভিসা প্রাপ্ত হয়ে কানাডা পর্যন্ত চলে এসেছেন।
কানাডার বুকে এই বিশাল ইমিগ্রান্ডদের আমরা যারা কানাডায় আছি তাদের পক্ষ থেকে স্বাগতম। আমি বা আমরা যেখানে অবস্থান করছি সেখানে আপনাকে আসার জন্য উৎসাহিত করা উচিত । মূলত কারণেই
আমার লেখাটি পড়ে নিরুৎসাহিত না হওয়ার জন্যই এই ভূমিকা ।
কল্পনার রাজ্যের চেয়ে বাস্তবের কানাডা এখন অনেকটাই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে নবাগত ইমিগ্রাউন্ডদের।
প্রথমত আমরা যারা কানাডায় এসেছি কিংবা যারা আসছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই স্কিল ওয়ার্কার নয়। কাজ করতে করতে এখনকার আর্থসামাজিকতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, হয়ে যাচ্ছি; অনেকে হবার পথে এটাই বাস্তবতা।
ইউরোপীয় জীবন সব সময়ই কর্মময় , যেটা আমাদের এশিয়া তথা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঠিক উল্টো ।
এজন্য স্কিল মাইগ্রেশনে যারা আসেন তারা আসার পরে সবচাইতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। দ্বিতীয় দফায় যারা আসেন -ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে তারা আসলে ডানামেলা পাখির মত জীবন যাপন থেকে এসে খাচাঁয় বন্দী জীবনের ফাদেঁ আটকে যাচ্ছেন। কর্মময় জীবনের একটি গণ্ডির মধ্যে ঢুকে পড়েন কিংবা সাইকেলের মধ্যে প্রবেশ করেন যেখান থেকে বের হবার পথ খুবই নগণ্য । এবং অনেকেই সে জীবনটাই বেছে নিতে বাধ্য হন বলে আর বের হওয়া হয় না।
এটা সার্কাসের সেই হাতির মত জীবন, যে আগুন লাগার পরও সার্কাসের সেই শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে যায়নি সুযোগ থাকার পরও কারণ সার্কাসের হাতির নিয়তি তাকে আটকে রেখেছিল এই গণ্ডির মধ্যে।
আপনারা যারা ইমিগ্র্যান্ড হিসাবে ভিজিট কিংবা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট কিংবা অন্য যে কোন ভাবেই আসছেন তারা যদি মাইন্ড সেটআপে সবচেয়ে নেগেটিভ পরিস্থিতি মোকাবেলার মাইন্ডসেটাপ করে আসেন, তাহলে আসার পরে সমস্যার চাপ অনেকাংশেই কমে যাবে কিংবা মোকাবেলা করা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু উল্টোভাবে যদি কল্পনার রাজ্যে আসছেন এই চিন্তা নিয়ে আসেন, তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে খুবই অস্বস্তিকর এবং কঠিন জীবন যাপনের এক মঞ্চ।
একটু ব্যাখ্যা করে বলি – গত বছরের তুলনায় এই বছর কানাডার জব মার্কেট অবস্থা অনেকটাই সংকোচিত । করোনা সংকট কাটিয়ে কানাডার অর্থনীতি সচল হতে পারেনি এখনও । সেজন্য আপনারা যারা ভিজিটে আসছেন এবং আসার পরে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা নিয়ে আসছেন, তারা অন্ততপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় মাসের থাকা এবং খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার নিয়ে আসা উচিত।
কানাডাতে উইন্টার শুরু হচ্ছে এবং এই সময়ে জব মার্কেট এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়ে, সেজন্য মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে আপনি সেই প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারলে এই মধ্যবর্তী সময়টি সহজেই মোকাবেলা করে উঠতে পারবেন। নতুবা আপনার জন্য কখনো কখনো ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।
যদি ভাগ্যবান হোন এবং কোনভাবে যে কোন একটি কাজে ঢুকে পড়তে পারেন তাহলে আপনার নিয়ে আসা ডলার তো আপনার কাছেই রয়ে গেল ;আপনি শুধু বিকল্পটি চিন্তা করে এই প্রস্তুতি নিয়ে আসা উচিত।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস হিসেবে যারা আসছেন বিশেষ করে আমাদের সিলেট অঞ্চলের তাদের মধ্যে মানসিক এবং পারিবারিকভাবে এমনিতেই একটি মাইন্ডসেটাপ নিয়ে আসেন- বিদেশ যাচ্ছি টাকা রোজগার করবো, দেশে পরিবারের হাল ধরবো- এই আবেগি মনমানষিকতা নিয়ে আসা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য বাস্তবতা হলো- পড়াশোনার জন্য যে কোর্স ফি আছে সেটা প্রথমে দিকে রোজগার করে পরিশোধ করা অনেক অনেক কঠিন।
সেজন্য যাদের পড়াশুনা কন্টিনিউ করে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তাদেরকে সেই প্রস্তুতি নিয়ে আসা উচিত অর্থাৎ স্টুডেন্ট হিসাবে সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করেন কিংবা কাজ না পান- তাহলে কলেজের এবং আবাসনের জন্য আপনার পরিবার সেই ব্যায়ভার বহন করতে পারবে কী- না কিংবা পরিবারের যারা অভিভাবক আছেন তারা যদি সেই ব্যবস্থা করে দেন কিংবা করার মতো অবস্থায় থাকেন- তাহলে স্টাডি কন্টিনিউ করা সবচাইতে উত্তমপন্থা নতুবা আপনি বিকল্প পথে (রিফিউজি ক্লেইম করা) যাওয়া ছাড়া উপায় নাই ।
কানাডার বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে দেখা যাচ্ছে বড় একটি অংশ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রিফিউজি ক্লেইম করেন এবং সময়ের তারতম্যে প্রায় সবারই কেস হয়ে যায়, সেটি একটি ভালো দিক । অন্যদিকে কারো কারো ভাগ্যে ডেপুটেশন কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হেয়ারিং এর মার-প্যাচে পড়ে যেতে পারেন । অতএব এই আগাম ভবিষ্যতের পজটিভ-নেগেটিভ দিকগুলো মাথায় থাকলে আপনি মানসিকভাবে অন্তত ভেঙ্গে পড়বেন না।
আরেকটি ব্যাপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আপনারা যে বা যাদের মাধ্যমে রিফিউজি ক্লেইম করেন এবং সেখানে দেশ ছেড়ে আসা অথবা দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে একটি বানানো মিথ্যা গল্প ফাদেঁন! সমস্যা হলো সেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে আপনি আছেন সেটা কি আপনার সাথে যাচ্ছে- সে ব্যাপারে আপনি নিজেকে ওয়াকিবহাল আছেন নাকি শুধু শুধু ল-ইয়ারকে দুষবেন, সেটাও ভেবে দেখবেন। অর্থাৎ এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সত্যের মতো মিথ্যা দিয়ে বানানো গল্পটি যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয় সেই মাল –মসলা, উপকরণ কিছুটা নিজেই ম্যানেজ করে নিয়ে আসুন, তাহলে এখানে এসে আপনাকে অন্ধের মত একে ওকে খুঁজতে হবে না।
আরেকটি সমস্যা বেশ কয়েকমাস থেকে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে কানাডার টরেন্টো শহরের আবাসন ব্যবস্থা । টরেন্টো শহরে বাসার রেন্ট বেড়েছে প্রায় ডাবল। একটি এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ২০০০ ডলার এর উপরে। আগে যেখানে বেসমেন্ট হাজার ডলারে পাওয়া যেত, সেগুলো এখন ১৫০০ ডলারে !
তাছাড়া জব লেটার, পে-স্লিপ ছাড়া ও গ্রান্টার ছাড়া এপার্টমেন্টগুলোতে ভাড়া পাওয়া মুশকিল। অন্যদিকে অধিকাংশ বাড়িওয়ালারা এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ।
রেন্ট যেমন বাড়িয়েছেন একই সাথে সেখানে থাকতে গেলে তারা নানা ধরনের রেস্ট্রিকশন দিয়ে আপনার ইউরোপিয়ান লাইফ স্টাইলকে বস্তির জীবন বানিয়ে ফেলছেন বা ফেলা হবে।
এরা পানি ব্যবহার থেকে শুরু করে হিটিং ব্যবস্থা নিয়ে ভাড়াটিয়াদের সাথে বেশিরভাগ সময়ই লুকোচুরি খেলা খেলে । অতএব আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে এসব মোকাবেলা করা সহজ হবে নতুবা এসব নোংরামি ফেইস করতে গেলে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা তৈরী হয় ।
এপার্টমেন্টে থাকলে অবশ্য এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হয় না । আপনার কোন বন্ধুকেও আশ্রয় দিলে সেটা নিয়েও সচরাচর জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না।
জব মার্কেটের চলমান অস্থিতিশীলতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার বলছে জব মার্কেটে লোক নেই অথচ জব মার্কেটে এন্ট্রি দিতে গেলে বলছে লোকের অভাব নেই।
অভিজ্ঞরা বলেন কানাডায় কাজের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। বলতে গেলে এগুলো একাডেমিক ব্যাখ্যা। বাস্তবতা হলো- যারা ক্যাশ জব কিংবা উবার ফুড ডেলিভারির মতো কাজে আছেন তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হতে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি টাকার ট্রানজেকশন পাচ্ছে কিন্তু ক্যাশ লেনদেনের কারণে ফাঁকিবাজ মালিকরা সরকারকে সব সময় বলে যাচ্ছে ব্যবসা লসে আছে এবং সে কাজের লোক পাচ্ছে না । এভাবেই এরা করোনার সময়ে সরকার হতে বিলিয়ন ডলার লুটে নিয়েছে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং ভিজিটরদের তারা নামমাত্র মূল্যে কিংবা অর্ধেক মূল্যে বেতন দিয়ে কাজে লাগাচ্ছে ।
তাদের এই দুই নাম্বারি নন অফিসিয়ালি সরকার জানলেও কাগজে কলমে এসব শুন্য দেখাতে হচ্ছে!
কানাডার উদ্দেশ্যে যারা আসছেন, ভবিষ্যতে আসার ইচ্ছা পোষণ করছেন সবাইকে স্বাগতম। আনন্দ উল্লাসের সাথে সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা না হয় একসাথেই করি।
বাংলাদেশে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়া তরুণ যদি কানাডার মত দেশে এসে সম্পদে পরিণত হতে পারে- তাহলে তাদেরকে আমাদের স্বাগতম জানানো উচিত।
এই সংকট নিশ্চয় কাটিয়ে উঠবে কানাডা ;কাটিয়ে উঠবে আমাদের নবাগত ইমিগ্রেন্টরা- শুভকামনা সবার জন্য।
ফুজেল আহমদ : রম্য লেখক।টরন্টো, কানাডা।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইংরেজি
আরও পড়ুন-