বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনের মধ্যকার কথার লড়াইয়ে এখন সরগরম ক্রীড়াঙ্গন।ফুটবল -ক্রিকেটের এই দুই গ্যালারীর লড়াই কিন্তু অনেক পুরানো।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবল ছিল নাম্বার ওয়ান স্পোর্টস। এখন আর নেই। ক্রিকেট মূলত ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হবার পর সারা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে এবং সেই ধারাবাহিকতার রেশ নিয়েই হয়ে উঠে দেশের এক নাম্বার খেলা। তাও সেটি মাঠে এবং মাঠের বাহিরের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও।
এখানে সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার গল্পের ভিতরের গল্প খুজঁতে গেলে দুটি ফেডারেশনই আসলে ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে- ফুটবল কিংবা ক্রিকেটের বিকাশ অথবা দেশের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে দিতে।
মজার ব্যাপার হলো- বাফুফের চাইতে বিসিবির সাফল্য হিসাবে যেটি বেশী দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে সাফল্য নয়। একটু গভীরভাবে দেখলে বুঝা যাবে এটা হলো ফুটবলের চরম ব্যর্থতার মাঝে বেশী শুধু উজ্জ্বল মনে হচ্ছে ক্রিকেট এর সাফল্য। অথচ ঘরোয়া প্রতিযোগিতা কিংবা তৃণমূল পর্যায়ে দুটি বোর্ডই শুধুই হ-য-ব-র-ল নয় ; এরা নিয়মিত সজ্ঞানে পাতানো ম্যাচের আয়োজক।
ক্লাবের কাছে একেবারে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন অন্যদিকে বোর্ড পরিচালক হিসাবে প্রতিবছর পদ নবায়ন আর ভিতরে ঘরোয়া খেলা নিয়ে ব্যস্ততা হলো অধিকাংশ পরিচালকদের । যা কিছুদিন আগে ক্যাসিনো কেলেংকারীর সময়ে দেশবাসীর সামনে উম্মোচিত হয়েছিল।
এখনো সারা দেশের আনাচে- কানাচের মানুষের কাছে নাম্বার ওয়ান আবেদনের খেলা ফুটবল। ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ের সেই উম্মাদনা জানান দিয়ে গেছে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি। বিশ্বময় মিডিয়াতে পর্যন্ত যা আলোড়ন তুলেছে।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামই ছিল ফুটবল এবং ক্রিকেট উভয়ের একমাত্র সিম্বল। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হবার পরেই কিন্তু ক্রিকেটের উর্ধমুখী যাত্রা দেখে ফুটবল ফেডারেশন তাদের কাজ বাদ দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠা ক্রিকেটকে সামনে থেকে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।তারা ফুটবলের অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে ক্রিকেট সরিয়ে দেওয়ার জন্য সব চেষ্টা করে এবং ঢাকার বাইরে ফুটবল চলে গেলে ফুটবল বাচাঁনো যাবে না- এমন দাবী তুলে।
অথচ এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৯৯৮ সালে আইসিসির বিশ্বকাপের পরেই সবচাইতে বড় একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট “আইসিসি মিনি বিশ্বকাপ” আয়োজন করে বিশ্বব্যাপী বাহবা কুড়িয়ে আনে নবীন বিসিবি।একপর্যায়ে ক্রিকেট বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছেড়ে মিরপুরে চলে যায় স্থায়ীভাবে এবং নিয়মিত ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজন করে মাঠ ভর্তি দর্শক সমাগম করিয়ে প্রমাণ করে দেয় -এদেশের মানুষ ক্রীড়াপ্রেমি।
মাঠে খেলা রাখতে পারলে গ্যালারীতে দর্শক আসবেই- সেটা দেশের যেকোন মাঠেই হোক । সিলেট -চট্টগ্রাম যার উজ্জল প্রমাণ। ফুটবল ফেডারেশন মাঠ দখলে জয়ী হলেও মাঠে খেলা রাখতে পারেনি বিধায় ফুটবল আজ নিজেদের হারিয়ে খুজেঁ হয়রান।
ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি এবং ফুটবল ফেডারেশন এর সভাপতি দুইজনই প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক। দুজনই পারিবারিক সেই ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দুটি চেয়ারে বসে আছেন, যদিও আই ওয়াশ মার্কা নির্বাচন করে তারা বৈধতার প্রশ্নেও গ্রীন লাইট জ্বালিয়ে রেখেছেন দেশবাসীর সামনে।
সম্প্রতি নারী ফুটবল দলের সফর বাতিল নিয়ে বাফুফের সংবাদ সম্মেলন কে কেন্দ্র করে যে কাঁদা ছুড়াছুড়ি হয়েছে সেটি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাঁদার চাইতেও ভয়াবহ। সালাউদ্দিন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে বিসিবি বসকে কাঁদা ছুড়তে গিয়ে একেবারে প্রধানমন্ত্রীকে ‘ড্রামার পার্ট‘ বানিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে পাপন যেভাবে এসব বাউন্সারের বিপরীতে হুক পুল মেরেছেন- সেটাও তার ব্যাটিং এর সাথে আগে দেখা যায়নি। ব্যাকগ্রাউন্ডের জবাবে তিনি যেভাবে -বাফুফে বসকে বেহায়া -অহংকারী -অসভ্যতার কাতারে ফেলেছেন, সেগুলি এতো প্রকাশ্যে দেশবাসী ইতিপূর্বে দেখেনি। ৫১ লক্ষ টাকার পুরস্কার আনতে কোন কর্মকর্তা বিসিবিতে না গিয়ে চরম অপেশাদারিত্বের যে নজির সৃষ্টি করেছে বাফুফে এবং এখন যেভাবে তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে দিন দিন- সেটা নিয়ে বক্তব্য রাখতে হয়েছে স্বয়ং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে।
ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বক্তব্যটি হচ্ছে, ‘বাফুফের পক্ষ থেকে নারী ফুটবল টিমের অলিম্পিক বাছাইয়ের জন্য বরাদ্দ চেয়েছিল ২৭শে মার্চ। আমরা চিঠিটি পাই এবং সেটি পাওয়ার পরেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখি যে ফুটবল ফেডারেশনের বাজেট প্রয়োজন। তো আসলে যেকোনো বিষয়ের জন্য কিছু সময় প্রয়োজন, সরকারি কাজ তো সাথে সাথে বললেই হয় না।’
‘কিন্তু আমরা ২৯শে মার্চই দেখলাম যে তারা সাংবাদিক সম্মেলন করলেন এ বিষয়ে সরকার আমাদের কোনো টাকা দিচ্ছেনা, তাই আমরা টিম পাঠাতে পারছি না। কিন্তু আপনি যদি চিঠিটা দেখেন, চিঠিতে উল্লেখ আছে ৩১শে মার্চের মধ্যে এই টাকার বিষয়ে উনাদের অবগত করতে বলা হয়েছে।’
‘তাহলে কিভাবে তারা ২৯শে মার্চে বলে যে, তারা টাকা পাচ্ছে না, টিম উইথড্র করবে। এতে বুঝা যায় তারা কোনোভাবেই নারী দলকে অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলাবে না বলেই এই ধরণের নাটক তৈরি করেছে। এবং আমি মনে করি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই তারা এই কাজটি করেছে।’
সংবাদ মাধ্যমে বাফুফের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল আরও বলেন, –‘আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে যখন দেখা করবো তখন এগুলি বিস্তারিত অবহিত করবো।’
এর মানে দাড়াচ্ছে -সাংবাদিক সম্মেলনে উঠা প্রশ্নগুলি এবং সালাউদ্দিনের প্রধামন্ত্রীকে নিয়ে ’নাটকীয় কথার’ ব্যাপারগুলি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বাফুফের চেয়ার (VAR) থার্ড আম্পায়ারের এর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেখানে দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর গ্রীন কিংবা রেড লাইটের উপর চলে এসেছেন বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিন।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
টরেন্টো; কানাডা।
১১ এপ্রিল ২০২৩ সাল।
আরও পড়ুন: