পঞ্চখন্ড পরগণায় যে কিছু মানুষ মানব কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন প্রমথনাথ দাস। এ ধারায় তিনি মানব কল্যাণে যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন অথবা তার সংস্পর্শে থেকে যারা তার বিভিন্ন কর্মের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পেয়েছিলেন বিভিন্ন গ্রন্থে তাদের লেখা পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় তিনি হচ্ছেন এই অঞ্চলের মানবতার মূর্ত প্রতীক।
প্রমথনাথ দাসের জন্ম পূর্ব সিলেটের পঞ্চখন্ড পরগণায়, বর্তমান বিয়ানীবাজার উপজেলার দাসগ্রামে, জমিদার পরিবারে। যে বাড়িতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন সে বাড়ি এদত অঞ্চলে ‘বাবুর বাড়ি’ হিসেবে সুপরিচিত। তার পূর্ব পুরুষ ময়মনসিংহ থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বসতি পরবর্তী সময়ে এই গ্রাম দাসগ্রাম হিসেবে ইতিহাস খ্যাত হয়। এই জমিদার পরিবার অন্যান্য জমিদারের মতো প্রজা নির্যাতন, শোষণের বিপরীতে ছিল- প্রজা দরদী । তারা যে কত দয়াশীল ও বড় মনের অধিকারী ছিলেন, তাদের রেখে যাওয়া দৃশ্যমান অসংখ্য কর্ম তা বলে দেয়।
প্রমথ নাথ দাসের এর পিতা পবিত্র নাথ দাস, মাতা সরলা সুন্দরী। তার ছোট ভাই সুমথ নাথ দাস তিনি ভারতে বসবাস করতেন।
ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কাছাড়ের শিলচর হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং এমসি কলেজে থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র কৃষি কলেজ- সাবুর কৃষি কলেজে ‘ বিএজি ক্লাসে ভর্তি হন। বাবার নির্দেশে কলেজের সকল ছুটিতে বাড়িতে না এসে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি, শিল্প সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শন করে বিস্তারিত প্রতিবেদন বাবার কাছে পাঠাতেন। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তিনি বিএজি শেষ বর্ষের ছাত্র। বাবার নির্দেশে তিনি বাড়ি চলে আসলে আর ফিরে যাননি।
সমাজবিনির্মাণে পিতা –পুত্রের চিন্তা-চেতনায় এক অনন্য অভিন্ন মিল
প্রমথনাথ দাসের পিতা ছিলেন সমাজসেবী ও জনদরদি ব্যক্তিত্ব। তিনি কালের নবদ্বীপ খ্যাত বিয়ানীবাজারের ‘পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় ‘ এর প্রতিষ্ঠাতা। বিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে তার পিতা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। পিতার ঋণ পরিশোধ করতে প্রমথনাথ বিভিন্ন চা বাগানে ঠিকাদারী কাজ সহ সিলেট শহরে যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানা স্থাপন করে প্রচুর আয় করেন। এই টাকা দিয়ে পিতার স্কুল নির্মাণের ঋণের টাকা পরিশোধ করেন।
পবিত্রনাথ দাস পরলোক গমনের পর পিতার অবর্তমানে প্রমথনাথ দাস স্কুল পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করেন। পিতার তৈরি জুনিয়র স্কুলটি তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৭ সালে মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত হয়।
১৯৬০ সালে সরকারের গৃহীত বিজ্ঞান উন্নয়ন স্কিমের আওতায় যায় স্কুল। তখন টাকা প্রয়োজন পঞ্চাশ হাজার। শর্ত হলো-এই টাকার অর্ধেক দিবে সরকার বাকি পঁচিশ হাজার টাকা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে দিতে হবে। এই শর্ত পূরণ করতে স্থানীয়রা পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিতে হিমশিম খান। সবাই চেয়ে থাকেন ‘প্রমথ বাবু’র দিকে।পরে বাবু জমি বিক্রি করে শর্তের পঁচিশ হাজারের মিল করে দিয়ে স্কুলে বিজ্ঞান শাখার দ্বার উন্মুক্ত করেন। সামাজিক যে কোনো ক্ষেত্রে পিতা-পুত্রের উদার হস্তে দানের অভ্যাস ছিল অনুকরণীয়।
তারা শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেননি, তাদের সময় বিয়ানীবাজারে জনহিতকর সকল কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক ছিল এই পরিবার। পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার ডাকঘর, বিয়ানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন, বিয়ানীবাজার দাতব্য চিকিৎসালয়, বিয়ানীবাজার কলেজ, পঞ্চখন্ড গোলাবিয়া লাইব্রেরী, টেলিগ্রাম অফিস কালের স্বাক্ষী হিসেবে আজও আলোকিতভাবেই রয়েছে।
প্রমথনাথ পূর্ব সিলেটে আধুনিক কৃষি বিপ্লবের অগ্রপথিক
প্রমথ নাথ দাস তাঁর লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন। সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে সময় ও অর্থের সাশ্রয় এর পাশাপাশি অধিক ফলন পাওয়া যায় তা এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি নিজ হাতে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজের সূচনা করেন।
বিয়ানীবাজার অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য প্রমথ নাথ নিয়ে আসেন ইঞ্জিন চালিত কলের লাঙ্গল, সেচের জন্য পাম্প মেশিন, আখ মাড়াই মেশিন, ধান ভাঙ্গার জন্য রাইছমিল, ভালো ফসলের জন্য উন্নত প্রজাতির বীজ।
তিনি পূর্ব সিলেটের এই অঞ্চলে প্রথম- তার বাড়িতে ডায়নমা এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালান এবং তাদের পরিবারের প্রতিষ্ঠিত- বাবুর বাজার পর্যন্ত এর সংযোগ স্থাপন করে দেন। বাজারে বিদ্যুৎ দিয়ে বাতি জ্বালানো সহ আখ ও ধান ভাঙ্গার কল পরিচালিত হতো। তখনকার সময় এই বিজলী বাতি, মেশিনের মাধ্যমে ধান থেকে চাল এবং আখ থেকে রস বের করে গুড় তৈরি- শুধু বিয়ানীবাজার নয়, সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে আশ্চর্য বিষয় ছিল। বাবুর বাজার সপ্তাহে দুদিন বসতো। তাই এই দুদিন অত্র অঞ্চলের শত শত মানুষ বিজলী বাতি দেখা সহ ইঞ্জিন চালিত মেশিনের কার্যক্রম দেখতে ভিড় জমাতেন। প্রমথ নাথ দাস অত্র অঞ্চলের মানুষকে কৃষি কাজে উদ্বুদ্ধ করতে নিজ হাতে ইঞ্জিন চালিত মেশিন দিয়ে জমি চাষ করে ধান,আলু,আখ ইত্যাদি রোপন করতেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি অধিক পরিমাণ ফসল ঘরে তুলতে পারতেন। আমাদের অঞ্চলের বিল- বাদাল সহ বিভিন্ন ডুবায় চাষবাসের বাইরে অনেক জমি অনাবাদী দেখে সেগুলো কাজে লাগিয়ে জনগণকে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি পদক্ষেপ নেন।
মুড়িয়া হাওয়রে বাঁধ তৈরির মাধ্যমে পানি আটকিয়ে শীত মৌসুমে বোরো ধান চাষের প্রচলন তিনি প্রথম শুরু করেন। যা দেখে অন্যরাও পরবর্তীতে তাদের জলাশয়ে চাষ করতে শুরু করে। মুড়িয়া হাওয়রে শীতকালে বোরো ধান চাষের জন্য পানি আঁটকে রাখতে তিনি যে বিরাট বাঁধ তৈরি করেছিলেন তা আজও ‘বড়বান্দ’ নামে পরিচিত।
জমিদারের সন্তান হয়ে নিজ হাতে কৃষি কাজ করাতে অনেকে বিদ্রুপ করে ‘আলুচা বাবু’ বলে ডাকত। তিনি তা আমলে না নিয়ে অত্র অঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে ১৯৫৭ সালে সুপাতলা বাসুদেব বাড়ির পুকুর পারে ‘কৃষি শিল্প প্রদর্শনী‘ – এর মাধ্যমে মানুষকে আধুনিক কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি সহ উন্নত ফসলের বীজ, উন্নত গরু ও গরুর কৃত্রিম প্রজনন প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। সাতদিন ব্যাপী চলা এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত।
খেলাধুলা ও সংস্কৃতি বান্ধব বিয়ানীবাজারে প্রমথনাথ পথিকৃৎ
প্রমথনাথ খেলাধুলা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক তৎপর ছিলেন। বিয়ানীবাজার ‘ব্রতচারী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় ছোট ছেলে-মেয়েদের ব্রতচারী আদর্শ, নৃত্য,গান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও বাড়ির উঠানে প্রতি বছর দুই থেকে চারটি নাটক মঞ্চস্থ করতেন।এছাড়াও পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ স্কুলের হলে প্রতিবছর সাতদিন ব্যাপি নাটক মঞ্চস্থ করতেন।
এই অঞ্চলে শিক্ষার সম্প্রসারণ তথা খেলাধুলা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে যে অর্থ ব্যয়ে হয়েছে মূলত এর সিংহভাগ এই জমিদার পরিবার থেকে এসেছে। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের বলে জমিদারদের জমির পরিমাণ সংকুচিত হয়ে আসে। তার ফলে অনেক জমিদারের অতীত ঐতিহ্য ধরে সমাজে চলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে হিন্দু জমিদাররা অনেকেই এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানান্তর হতে বাধ্য হন এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্হাপন করেন। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়া পরবর্তী হিন্দুদের দেশত্যাগ অনেক বৃদ্ধি পায়, সে সময় অনেকেই তাদের সাথে তাকে দেশ ত্যাগের কথা বলেন। বাবু প্রমথনাথ প্রতি উত্তরে বলেন, আমি কেন যাব, কোথায় যাব? এ আমার জন্মভূমি। এখানে আমি জমিদারের পুত্র জমিদার। আর ওখানে আমার পরিচয় হবে- উদ্বাস্তু বাঙ্গাল। আমার জন্মভূমি ছেড়ে যাব না। জন্মভূমির প্রতি তার কত ভালোবাসা- তা তার কর্মগুলোই প্রমাণ করে।
উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বালিকা স্কুলের ভূমিদাতা প্রমথনাথ
১৯৪৭ সাল পরবর্তী হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সহ-শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে এই অঞ্চলে নারী শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি প্রমথনাথ দাস কে ভাবিয়ে তোলে। তিনি নারী শিক্ষার জন্য পৃথক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। এই সময় বিয়ানীবাজার থানার অফিসার-ইন-চার্জ হয়ে আসেন সিদ্দিকুর রহমান। স্হানীয় নারী শিক্ষার বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের এ বিষয়ে সমবেত করেন এবং সভার পর সভা করেন কিন্তু প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি মিলাতে পারেননি।তখন একটি সভায় প্রমথনাথ বলেন, ভূমি মিলবেনা কেন, প্রমথ তো আছে।পরবর্তী দাসগ্রাম মৌজায় ‘বাবুর বাড়ির রাস্তা’ এর পাশে তার মালিকানাধীন স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় ভূমি দান করেন। ১৯৬৬ সালে ছোট একটি ঘর তৈরি করে ষষ্ঠ শ্রেণী দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেন। এবং একজন শিক্ষিকা নিয়োগ দেন, যার নাম শ্রীমতী কমলা চক্রবর্তী। এই শিক্ষিকার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় প্রমথনাথ বাবুর বাড়িতে। মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই মাধ্যমিক স্কুলটি সিলেটে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম বালিকা স্কুল। এই স্কুলটি বর্তমানে বিয়ানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। বর্তমানে বিয়ানীবাজার উপজেলা নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের যে কোন উপজেলার চেয়ে এগিয়ে আছে।সমাজবিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অঞ্চলের নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বাবু প্রমথনাথ এর অবদান সর্বাগ্রে। নিজ অঞ্চলের সার্বিক কল্যাণে তিনি যে ত্যাগ করেছেন তা ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে।
পরোপকারে নিজ ঘরের চাল খুলে দেয়ার নজির ইতিহাসে কত জনের আছে !
তার মহানুভবতার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পঞ্চখন্ড গোলাবিয়া লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা। কসবা গ্রামের আব্দুল মজিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘পঞ্চখন্ড গোলাবিয়া লাইব্রেরী ‘ অধিক মানুষের সুবিধার জন্য ১৯৪৯ সালে বিয়ানীবাজার শহরে স্থানান্তর করা হয়। এর নিজস্ব কোনো জায়গা না থাকায় প্রমথ নাথ দাস তার মালিকানাধীন একটি দোকানে স্থান করে দেন। এক পর্যায়ে দোকানটি বিক্রি হয়ে গেলে মালিক পক্ষকে সমঝিয়ে দিতে হবে তাই লাইব্রেরী স্থাপনের জন্য তিনি আরেকটি দোকান ক্রয় করেন। সেই দোকানটি লাইব্রেরীর জন্য যথোপযুক্ত না হওয়াতে তিনি পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে স্কুলের উত্তর পূর্ব কোনে তা স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এবং লাইব্রেরীর জন্য ক্রয়কৃত দোকানটি বিক্রি করে লাইব্রেরীর কাজের জন্য দিয়ে দেন। লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার অন্যান্য কাজ সম্পূর্ণ হলেও উদ্যোক্তারা ঘরের চাল লাগাতে ব্যর্থ হন। এদিকে বৃষ্টির দিন আসন্ন। লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব আব্দুল মজিদ উপায়ন্তর না দেখে সহপাঠিদের সাথে নিয়ে প্রমথ নাথ দাস এর শরণাপন্ন হন এবং বিষয়টি খুলে বলেন। প্রমথনাথ তখন চরম অভাব- অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের হাতে নগদ টাকা দিবেন এমন সামর্থ্য তার ছিল না। তবে দানবীর বলে কথা। না বলার ইতিহাস তাদের নেই। বই রক্ষার জন্য তিনি তার রান্না ঘরের টিন খুলে নিতে বলেন। তখন তার স্ত্রী কনক প্রভা দাস ক্ষিন আপত্তি জানালে, তিনি স্ত্রী কে অভয় দিয়ে বলেন, কিছুদিন গেলে রান্না ঘরের টিন লাগানোর সংগতি হবে নিশ্চয়। এই রান্না ঘরের টিন দিয়েই পঞ্চখন্ড গোলাবিয়া লাইব্রেরি এর চাল লাগানো হয়। সমাজের স্বার্থে নিজ ঘরের চাল খুলে দেয়ার নজির ইতিহাসে কত জনের আছে –অন্তত আমার জানা নেই ।
শুধু তাই নয় একদিন বাবু পঞ্চখন্ড গোলাবিয়া লাইব্রেরীর সামন দিয়ে যাচ্ছেন। দেখতে পান লাইব্রেরীর সামনে কয়েকজন নারী খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। এই লাইব্রেরীর সামনে ছিল বাস ষ্টেন্ড। হয়ত তারা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবু ভাবলেন, লাইব্রেরী ঘরের বারান্দা থাকলে মানুষগুলো হয়ত একটি আশ্রয়ে দাঁড়াতে পারত। সেই চিন্তা থেকে পরবর্তীতে তার নিজ খরচে বারান্দা করে দেন। এই বারান্দায় অনেকের মতো বিভিন্ন সময় আমিও আশ্রয় নিয়েছি। তার এমন মহনুভবতা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বাবার স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত পবিত্রনাথ লোক শিক্ষায়তন ও শিশু উদ্যান এর জায়গায় বিয়ানীবাজার কলেজ!
১৯৬৭ সালে শিক্ষানুরাগীদের সভায় বিয়ানীবাজার থানায় কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সমস্যা হয় জায়গা পাওয়া। তখন বিয়ানীবাজার শহরে জায়গা হাত হিসেবে অতি উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কে দেবে জায়গা? কলেজের জন্য ভূমি দেয়ার মানুষ নেই! সভায় উপস্থিত আছেন একজন যিনি মানব কল্যাণে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছেন, সবাই চেয়ে আছেন তার দিকে। দানবীর বাবু প্রমথ নাথ দাস উপস্থিত সবাইকে নিরাস না করে বলেন, আমি দেব জায়গা। বর্তমানে অবস্থিত বিয়ানীবাজার সরকারী মহাবিদ্যালয় এর এই জায়গায় তাঁর বাবার স্মৃতি রক্ষায় তৈরি করেছিলেন ‘পবিত্রনাথ লোক শিক্ষায়তন’ ও পরিকল্পিত ‘শিশু উদ্যান ‘ ঘর। এই দুটি সহ মোট পাঁচ একর ভূমি তিনি কলেজের নামে দান করেন।
প্রমথনাথ দাসের দানকৃত জায়গায় ১৯৬৮ সালের ১৫ই আগষ্ট কলেজের শুভ উদ্বোধন হয় এবং প্রথম নাথ দাস এর পূর্বেকার তৈরি কলেজের পূর্বাংশে টিলার উপর অবস্থিত টিন সেড ঘরে পাঠদান শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠালগ্লে কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন- সিলেট এমসি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জনাব মুহিব আলী। প্রভাষক পদে যোগ দান করেন- জনাব মো: ইমদাদুর রহমান- অর্থনীতি বিভাগ (পরবর্তিতে অধ্যক্ষ ), জনাব মাহবুবুর রশীদ চৌধুরী, বাংলা বিভাগ( পরবর্তিতে অধ্যক্ষ ), জনাব কুতুব আহমদ -বাণিজ্য বিভাগ, সুলেখা চৌধুরী-দর্শণ বিভাগ, শ্রী রমেন্দ্র কুমার দাস-রাষ্ট্র বিভাগ।
প্রতিষ্ঠালগ্নে একাদশ মানবিক ও বাণিজ্য শাখার মাধ্যমে একশত চব্বিশ জন ছাত্র ও একজন ছাত্রী নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়।একমাত্র ছাত্রীর নাম শুক্লা চক্রবর্তী। কলেজের ইতিহাসে নারী শিক্ষায় পথ প্রদর্শক হিসেবে তার নাম লিখা থাকবে সন্দেহ নেই। এখানেও নি:স্বার্থ এই দানবীরের মহত্ব অমর দৃষ্টান্ত হয়ে আছে- কলেজের একমাত্র ছাত্রী শুক্লা চক্রবর্তী ও কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক শ্রী রমেন্দ্র কুমার দাস এর থাকা এবং খাবার ব্যবস্থা করেন প্রমথ নাথ দাস এর বাড়ীতে। শুধু তাই নয়, প্রমথ বাবুর বদান্যতায় এ বাড়িতে থাকা-খাওয়া করতেন হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বিয়ানীবাজার কলেজের অনেক হিন্দু শিক্ষক।
এছাড়াও অনেক হিন্দু ছাত্র যাদের জন্য লজিং পাওয়া কষ্টকর ছিল, তারাও বাবুর বাড়ি আশ্রয় নিতেন। বাবুর বাড়ি ছিল যেন এক লঙ্গরখানা। শেষ জীবনে এই জমিদার অর্থ কষ্টে থাকলেও আশ্রয় চাইলে কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। এইসব কাজে আরেকজন মানবিক ও মহানুভব মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থ, সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা ছিল- তিনি হলেন প্রমথনাথ দাসের প্রিয়তমা স্ত্রী বিদূষি মহিলা কনক প্রভা দাস।
এদিকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নব প্রতিষ্ঠিত বিয়ানীবাজার কলেজ এফিলিয়েশন প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত ছিল -কলেজের নিজস্ব পাঁচ একর ভূমি এবং একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী থাকতে হবে। শর্ত পূরণে কলেজের জন্য তিনি পাঁচ একর ভূমি দানপত্র লিখে দেন। এবং লাইব্রেরীর জন্য তাঁর বাড়ি থেকে একটি আলমিরা ও কিছু বই দান করেন। বোর্ড কর্তৃপক্ষ তা দেখে কলেজের অনুমোদন প্রদান করেন। এই অনুমোদন প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সিলেটের থানা পর্যায়ে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়- বিয়ানীবাজার কলেজ। এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে উপকৃত হয়নি শুধু বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষ। এর সুফল পেয়েছেন গোটা সিলেট বিভাগের মানুষ। তখকার সময় জেলা সদরে হাতে গুনা কয়েকটি কলেজ ছিল। সেসব কলেজে ছাত্র সংকুলান না হওয়াতে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাওয়া সম্ভব ছিলনা। এসব মেধাবীরা অকালে ঝরে পড়াই যেন ছিল তাদের নিয়তি। আমার দেখা মতে, বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার ছাত্র-ছাত্রীরা এই কলেজের বদৌলতে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তাদের জীবন ও সমাজ আলোকিত হয়েছে। মাঝে মধ্যে ভাবি, এই কলেজ প্রতিষ্ঠা না হলে হয়ত আমাকেও মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকতে হতো। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে বিয়ানীবাজার উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকজন গ্রাজুয়েট থাকলেও আজ এই কলেজের বদৌলতে হাজার হাজার গ্রাজুয়েট। অসংখ্যজন রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে এবং প্রবাসে তাদের কর্ম দক্ষতা দিয়ে সমাজকে আলোকিত করছেন। এবং মূলত তা নি:সন্দেহে সম্ভব হয়েছে বাবু প্রমথনাথ দাস এর বদৌলতে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই পুরুষ অত্র অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে বিপ্লব সাধন করেছেন। সঙ্গত কারণেই কালের পঞ্চখন্ড তথা বিয়ানীবাজারবাসী এই মহান মানুষকে বিয়ানীবাজারের আধুনিক রূপকার অভিধায় শ্রদ্ধায় স্বরণ করেন।
একাত্তরে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা বিরোধীরা ‘বাবুর বাড়ি’টি পুড়িয়েছে
১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালরা যখন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষদের নির্বিচারে নির্যাতন করে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়ি- ঘর লুটপাট, নির্যাতন ও হত্যা করে তখন তিনি বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারতে থাকাকালীন পাকিস্তানীদের এদেশীয় দালালরা শত ঐতিহ্যের ধারক- বাহক ও শত স্মৃতি বিজড়িত –‘বাবুর বাড়ি‘টি পুড়িয়ে দেয়।
বিয়ানীবাজারে মুক্তিযুদ্ধ সময়ের কথা বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয় প্রসঙ্গ আসলে আমার মনে লজ্জা নিয়েও বার বার একটি প্রশ্ন মোটাদাগে জাগে- বাবুর বাড়ির ঘরে আগুন দেবার পূর্বে পাকিস্তানি এদেশীয় দালালদের কি একবারও মনে আসেনি যে , আমাদের জন্য যিনি এতো কিছু করলেন তার শেষ আশ্রয়স্থলে আগুন দিচ্ছি!
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে প্রমথনাথ দাস দেশে ফিরে দেখেন শত স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি অর্ধেক পুড়ে বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে তার মহামূল্যবান বইগুলো পুড়ে গেছে। ঘরটি তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে পূনরায় বসবাস শুরু করেন।
জনকল্যাণে উইল করে যেতে পারেননি –‘সরলা সুন্দরী নারী সদন’
প্রমথ নাথ দাস যেহেতু তার সকল সম্পদ জনকল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন তার শেষ ইচ্ছা ছিল- তার স্মৃতিময় ঐতিহ্যবাহী ‘বাবুর বাড়ি’ টি তার গর্ভধারিণী মা সরলা সুন্দরী এর নামে জনকল্যাণে উইল করে দেয়ার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাঁর মায়ের নামে ‘ সরলা সুন্দরী নারী সদন ‘ নামে বাড়ির ফটকে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছিলেন। অভাবের তীব্র কষাঘাতে শেষ পর্যন্ত তার একান্ত শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ঋণ পরিশোধ করতে পূর্ব পুরুষের বাড়িটি বিক্রি করতে হয়েছে বিশিষ্ট এই দানবীরকে। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য যখন যা প্রয়োজন, তখনই তা করে যেতে পারলেও গর্ভধারিণী ‘মা’ এর জন্য কিছু করে যেতে ‘না পারা‘- ছিল তার অসীম কষ্টের।
বাড়ি বিক্রি পরবর্তী সময় তিনি পার্শ্ববর্তী কালাচাঁদ বাড়িতে নতুনভাবে বসতি স্হাপন করেন। সেখানে ১৯৭৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী সরস্বতী পূজার দিন সন্ধ্যার পূর্বে স্ত্রী ও বিবাহিতা দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি রেখে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। আধুনিক বিয়ানীবাজারের রূপকার মানবিক প্রমথ নাথ দাসের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
এই সর্বজনীন সম্মান বিয়ানীবাজারের আর কেউ অর্জন করতে পারেননি !
সমাজ সংস্কারক প্রমথ বাবুর এই দীর্ঘ পথচলা কোনভাবেই মসৃণ ছিল না। নানা ঘাত- প্রতিঘাত এর মধ্য দিয়েই তার জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। পরোপকার করতে গিয়ে জীবনে অনেক লাঞ্চনা ও সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তবে জীবিত ও পরলোক গমনের পরেও বিয়ানীবাজারের গণমানুষের ঈর্ষনীয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করে অমর হয়ে আছেন। এরকম বিরল দৃষ্টান্ত এদত অঞ্চলে কারো পক্ষে আজবদি অর্জন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি বলে অনেকের মতো আমিও মনে করি । মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে তিনি এবং তার পিতা এ অঞ্চলের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় যে শীর্ষে অবস্থান করছেন তারও একটি উদাহরণ আমাদের সামনে রয়ে গেছে।
আমাদের সমাজে একটি ইতিবাচক দিক কাছে, সমাজে যারা অত্যন্ত সম্মানিত লোক তাদের নাম সন্বোধন করতে সাধারণত মুসলমান হলে নামের সাথে ‘সাহেব’ আর হিন্দু হলে নামের সাথে ‘বাবু‘ যুক্ত করে শ্রদ্ধার্থে তাদের নাম উল্লেখ করা হয় । কিন্তু পবিত্র নাথ দাস ও প্রমথনাথ দাস এই দুই শ্রদ্ধেয়জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরল সম্মানের চর্চা ছিল। তাদের শ্রদ্ধা করে মানুষ সাধারণত অন্যান্যদের মতো সন্বোধন করতেন না।তাদের ‘বাবু’ বলে সন্বোধন করা হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দাসগ্রামে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি –‘জমিদার বাড়ি’ হিসেবে নয় অত্র অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘বাবুর বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। বাড়িটিতে একসময় মুসলিম বসতি হলেও এখনও অনেকে ‘বাবুর বাড়ি‘ হিসেবে উল্লেখ করেন ।
তাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাড়ির পাশের বাজারটি ‘বাবুর বাজার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিয়ানীবাজারের মধ্য বরাবর সিলেট- বরাইগ্রাম রাস্তা থেকে যে সড়কটি বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ পাশ দিয়ে দাস গ্রামে- তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে, তাদের বাড়ি থেকে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত সেই অংশটুকু ‘বাবুর বাড়ির রাস্তা’ হিসেবে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত ছিল। ছোটবেলায় এই রাস্তা লোকমুখে ‘বাবুর বাড়ির রাস্তা‘ উল্লেখ করতে নিজে শুনেছি। এই রাস্তার পাশে একসময় কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে সময়ের ব্যবধানে তা ধীরে ধীরে ‘কলেজ রোড’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
-‘এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না’
এই বিশাল সম্মানের অধিকারী মানবিক মানুষগুলো আমাদের অহংকার। তারা আমাদের পরম শ্রদ্ধা ও গৌরবের। তারা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে মানবিকতার মূর্ত প্রতীক। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগে অনুপ্রাণীত করতে তাদেরকে সকলের সামনে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
শুধু আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য কেন, আমাদেরও দায়িত্বে পড়ে তাদের নাম উজ্জ্বল করে ধরে রাখার। আমরা বিয়ানীবাজার উপজেলাবাসী তাদের দেয়া যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গৌরব করি, যেখান থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করে কোন না কোন ভাবে আলোকিত হয়েছি।কিন্তু বাস্তবতা হলো- আমরা তাদের অনুকরণীয় স্মৃতি রক্ষার্থে কোন উদ্যোগ নেইনি। মানুষের সহজাত একটি আকাঙ্খা আছে – পৃথিবীতে সে কোন না কোনভাবে তার স্মৃতি চিহ্ন রেখে যেতে চায়। প্রমথনাথ দাসও এ থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার নিজ ভূমিতে বিয়ানীবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই ভূমিতেই একটি ঘর তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পিতা পবিত্রনাথ দাস এর নামে ‘ পবিত্র নাথ লোক শিক্ষায়তন ‘। পরবর্তিতে বিয়ানীবাজারবাসীর সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে এই ‘ পবিত্রনাথ লোক শিক্ষায়তন‘ এর ভূমি দান করেছেন- বিয়ানীবাজার কলেজ এর নামে। তেমনি তার গর্ভধারিণী মমতাময়ী মা সরলা সুন্দরী এর নামে মানব কল্যাণে উইল করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাদের বসত বাড়িটি। সেই হিসেবে বাড়ির ফটকে ঝুলিয়ে ছিলেন ‘ সরলা সুন্দরী নারী সদন ‘ ফলক। অভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায়- রেখে যেতে পারেননি প্রিয় মায়ের স্মৃতি। এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে দান করতে করতে যিনি নি:শেষ হয়েছেন এবং এইসব দান করতে যিনি ছায়ার মতো পাশে থেকে সার্বক্ষণিক উৎসাহ যুগিয়েছেন, সেই বিদুষী নারী তার প্রিয়তমা স্ত্রী কণক প্রভা দাস এর নামে কি কিছু করে যেতে কী চাননি ? নিশ্চয় চেয়েছেন।বিয়ানীবাজারের মানুষ ও সমাজের জন্য দান করে নি:শেষ হওয়াতে আসলে তার নিজের সুপ্ত আশা পূর্ণ হয়নি।
বর্তমানে এই অঞ্চলে তাদের কেউ নেই ।তাই বলে কী এভাবে অন্ধকারে ডুবে যাবে তাদের নাম? তাদের অনুকরণীয় কাজের আলোকবর্তিকা। সমাজকে সার্বিকভাবে এগিয়ে নিতে অতীতের ভালো কাজ , সামাজিক সংস্কৃতির অনন্য অবদান ও এসব কাজের অগ্রপথিকদের সামনে স্বরণীয় করে রাখতে হয়। যাতে এথেকে মানুষ উদাহরণ হিসাবে দেখে নিজে ভালো কাজে সম্পৃক্ত হতে অনুপ্রাণীত হয় ।
আমরা যারা তাদের দেয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে আলোকিত হয়েছি, আমাদের দায়িত্ব সকলের সামনে তাদের নাম উজ্জ্বলভাবে তোলে ধরা। আমরা নতুন করে তাদের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান করতে পারি অথবা তাদের দেয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ভবন তাদের নামে নামকরণ করতে পারি। তাদের দানকৃত তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ সরকারী কারণ হয়ে গেছে বিধায় সেগুলো ইচ্ছা করলেও নামকরণ করা সম্ভব হবে না।
তবে আমি মনে করি আমাদের নিরাশ হবার কারণ নেই। বিয়ানীবাজার –গোলাপগঞ্জ নির্বাচনী এলাকার সরকার দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ যিনি এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের দেয়া প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছেন; সেই ঋণ শোধ করতে তিনিই পারেন পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় ও বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের ভবনগুলো তাদের নামে নামকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে । এছাড়াও বিয়ানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি এদতঅঞ্চলে ঐতিহ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কৃতির গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের নামে বিভিন্ন হলের নাম করা উচিত।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের দানে প্রতিষ্ঠিত, তাদের নাম ব্যতিরেকে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ এর নামে পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভবনের নাম করণ বেমানান। প্রমথ নাথ দাস এর পরিবারের সদস্যরা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য যেখানে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দান করে গেছেন, সেদিক বিবেচনায় নিলে এমপি হওয়ার পূর্বে নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব বিয়ানীবাজার এলাকায় নিজের টাকায় সামাজিকভাবে একটি গাছের চারা রোপন অথবা ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক কোন কাজের দৃষ্টান্ত নেই।
আমার মতে, পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিয়ানীবাজার উপজেলায় যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব নিজে নামে ভবনের নামকরণ করেছেন তা একজন সংসদের জন্য নীতি বিরোধী এবং নির্বাচনী ওয়াদার বরখেলাপ। একজন সাংসদ নির্বাচনের পূর্বে জনগণের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে যেখানে তার জানমাল রক্ষার ওয়াদা দিয়ে ভোট ভিক্ষা চান সেখানে, রাষ্ট্রের অর্থ যা জনগণের টাকায় নির্মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো কেমন করে সাংসদের নামে হয়? এবং তিনি নিজে উপস্থিত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আনন্দচিত্তে সেই ভবন গুলো উদ্বোধন করেন। রাষ্ট্রের টাকায় নির্মিত ভবন সাংসদের নামে নামকরণ করা একটি গর্হিত কাজ। জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল। যে বা যারা এমন গর্হিত কাজে সাংসদ কে উৎসাহিত করেছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তারা কখনো সংসদ সদস্যদের মঙ্গলের জন্য করেনি। তারা সংসদ সদস্যকে খুশি করে নিজের ফায়দা হাসিলের পথ সুগম করেছেন বলে আমি মনে করি। এমন কাজে যারা উৎসাহ প্রধান করে সাধারণত এদের কে চামচা বা তোষামোদকারী হিসাবে সমাজ চিহ্নিত করে। ইতিহাস বলে, এই চামচাদের খপ্পরে পড়ে অনেক রাজা- বাদশা কে বিভিন্ন সময় তাদের সিংহাসন হারাতে হয়েছে।
বেশী দূরের ইতিহাসে যেতে হবে না,নিকট অতীতের উদাহরণ বলছে, রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এর রাষ্ট্র শাসনের চিত্র সামনে আনলে -তার পাশে থাকা চামচা , মন্ত্রী,এমপিরা তাঁকে খুশি করতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে দেশে নির্মিত অগণিত প্রতিষ্ঠানে রাস্ট্রপতি এরশাদ এর নামে নামকরণ করে ছিল। কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের পরদিনই সাধারণ জনগণ এইসব ভবন থেকে শাবল-হাতুড়ি দিয়ে চরম অপমানজনক ভাবে সকল নাম ফলক ভেঙ্গে দিয়েছিল। ইতিহাস বলে, যারা এই কাজটি করিয়ে ছিল এরশাদ সাহেব জেলে যাবার পর তার চরম বিপদে চামচারা পাশে থাকেনি। বরং নিজেদের সুবিধা আদায়ে তারা অন্য দলে যোগ দান করেছে।
পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভবন ‘নুরুল ইসলাম নাহিদ ভবন’ নামকরণ করে কী তিনি মানুষের হৃদয়ে থাকতে চাচ্ছেন , নাকি ব্যক্তিগতভাবে নিজের ইতিহাস স্থাপন করতে চাচ্ছেন। এই বিষয়টি বিয়ানীবাজারের অগুনতি মানুষের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।
সহজভাবে বোধগম্য হওয়ার বিষয় হচ্ছে যে, ইতিহাস সৃষ্টির জন্য এমন গর্হিত কাজে কেনো তিনি তার নাম জড়াবেন! তিনি তো বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। এটাই তো প্রকৃত রাজনৈতিক ইতিহাস। এ ইতিহাস অস্বীকার করার কেউ কি ক্ষমতা রাখে।
তিনি যদি নিজের নাম মানুষের দৃষ্টির মধ্যে রেখে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার কৌশল অবলম্বন করেন- সেক্ষেত্রে বিখ্যাত গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী গৌরী প্রসন্ন মজুমদার লেখা ও এই উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে –এর গাওয়া একটি বিখ্যাত গানের কলি স্মরণ করে দিতে চাই –‘ যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিড়ে যাবে/ পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে/ হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে।’
মানুষের মধ্যে সম্মানে বেঁচে থাকতে হলে সরকারি খরচে তৈরি ভবনে নিজের নাম নয় বরং এগুলো মুছে দিয়ে কালের জ্ঞান -গরিমার আঁধার ‘নবদ্বীপ’ খ্যাত বিয়ানীবাজারের খ্যাতিমান ব্যক্তি- যারা দেশ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রেখে গেছেন তাদের নামে নামকরণ করলে নিজে অধিকতর সম্মানের সাথে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন। যেমন নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ না করে বিয়ানীবাজারের নাম সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করতে নিজেদের সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন প্রমথনাথ দাস পরিবার।
তথ্য সূত্র :
প্রমথনাথ দাস স্বারকপ্রন্থ ,প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০০৩
লেখক :উপাধ্যক্ষ রমেন্দ্র কুমার দাস, বিয়ানীবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন প্রবাসক, পরবর্তী উপাধ্যক্ষ মঈনুদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ, সিলেট।
প্রফেসর মাহবুবুর রশীদ চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাকালীন প্রভাষক, পরবর্তী প্রিন্সিপাল বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ।
মো: আলী আহমদ : প্রধান শিক্ষক, পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার।
মিহির কুমার পাল চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, মৌলবীবাজার।
মুহাম্মদ আব্দুল হাকিম তাপাদার : শিক্ষাবিদ, লেখক, কলামিস্ট।
ছরওয়ার আহমদ: হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ;৫২বাংলা টিভি , সাবেক ভিপি ১৯৯৫-৯৬ সাল , বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ, সিলেট । সংগঠক, স্যোসাল একটিভিস্ট।
লণ্ডন ,যুক্তরাজ্য । ১০ এপ্রিল, ২০২৩ সাল।
আরও পড়ুন:
বিয়ানীবাজারবাসীর কাছে দানবীর পবিত্র নাথ দাসের খোলা চিঠি : আপনাদের ঐতিহ্যকে বাঁচান