শুক্রবার ছিল ‘করিমগঞ্জ দিবস’। ১৯৮৩ সালের এই দিনে অর্থাৎ ১ জুলাই করিমগঞ্জ মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়েছিল। কাছাড় জেলা থেকে পৃথক হয়েছিল এদিন। করিমগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরির নাম করিমগঞ্জের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে! তাঁর প্রচেষ্টায় অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ ইদ্রিস করিমগঞ্জ সদর শহরে এসে করিমগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছিলেন।
১৮৭৮ সালে বর্ধিষ্ণু জনপদ করিমগঞ্জ ৪০ টি পরগণাসহ অবিভক্ত সিলেট জেলার একটি মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের প্রাককালে সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ৬ ও ৭ জুলাই। গণভোটের ফলাফল চলে যায় পাকিস্তানের অনুকূলে। করিমগঞ্জ মহকুমাও চলে যায় পাকিস্তানে। ১৭ আগস্ট সীমানা কমিশনার রেডক্লিফের রোয়েদাদ অনুযায়ী করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতে চলে আসে। ফলে, ১৭ আগস্ট করিমগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। দেশভাগের সময় সিলেট জেলায় মোট ১৬ টি থানা ছিল। সাড়ে বারো থানা পাকিস্তানে রয়ে গেল! করিমগঞ্জ মহকুমা সাড়ে তিন থানা নিয়ে কাছাড় জেলার একটি মহকুমায় পরিণত হল।
এদিকে, হাইলাকান্দি মহকুমা ১৯৮৯ সালের ১ অক্টোবর কাছাড় জেলা থেকে পৃথক হয়ে নতুন জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। হাইলাকান্দিকে জেলায় উন্নীত করার লক্ষ্যে তৎকালীন ক্যাবিনেট মন্ত্রী প্রয়াত শহিদুল আলম চৌধুরির নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে! করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি সিলেট বিভাজনের পর থেকে বরাক উপত্যকা নামে নতুন অভিধায় ভূষিত হল। উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি সুরমা উপত্যকা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনারশাসিত আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর ১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ হয়। প্রশাসনিক সুবিধার্থে বঙ্গভঙ্গ-এর সুবাদে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামক নতুন প্রদেশের সৃষ্টি হয়। ঢাকা হয় পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী। ফলে, প্রশাসনিক সুবিধার্থে নতুন প্রদেশকে আরও দুটি প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করা হয়। একটি সুরমা উপত্যকা ও পার্বত্য জেলা সমূহ (Surma Valley and Hill Districts Division), অন্যটি আসাম ভ্যালি (Commissionership of Assam Valley Districts)। গারো পাহাড় ছাড়া সবগুলো পাহাড়ি এলাকা সুরমা উপত্যকার অধীনে ছিল। শুধু গারো পাহাড় ছিল আসাম ভ্যালির অধীন। আসাম ভ্যালি গঠিত হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর, ১৯০৯ সালে। সুরমা ভ্যালি গঠিত হয়েছিল ১৯০৫-এর অক্টোবরে। সুরমা উপত্যকা তথা সমগ্র পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক-শৈক্ষিক-রাজনৈতিক বিকাশে ১৯০৫-এর তথাকথিত ‘বঙ্গভঙ্গ’-এর সুদূরপ্রসারী ফল বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ এখনও ভোগ করছেন। বঙ্গভঙ্গ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছিল!কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর নিকট যে ‘বঙ্গভঙ্গ’ ছিল নেতিবাচক, পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য সেই ‘বঙ্গভঙ্গ’ ছিল আশীর্বাদ!
১৯৪৭ সালে দেশভাগের দরুন সিলেট জেলার বৃহদাংশ পাকিস্তানে চলে যাওয়াতে করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি ‘বরাক উপত্যকা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বরাক উপত্যকা তখনও কোনও প্রশাসনিক অঞ্চল ছিল না সুরমা উপত্যকার মতো। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে ‘হিলস এন্ড বরাক ভ্যালি ডিভিশন’ নামে পৃথক একটি প্রশাসনিক ডিভিশন সৃষ্টি করা হয়েছে। উক্ত ডিভিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বরাক উপত্যকার তিনটি জেলা যথাক্রমে, করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি এবং পাহাড়ি জেলাদ্বয় যথাক্রমে, ডিমা হাসাও ও কার্বি আংলং।
করিমগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার লক্ষ্যে যাঁরা মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।