কেওক্রাডং পর্বতে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। দিনমান বেলা পেরিয়ে ঘনিয়ে আসছে আলোকরশ্মিদের ঘুমোতে যাবার সময়। পাল্লা দিয়ে নীড়ে ফিরছে পাহাড়ী বিহঙ্গরাও। আঁধারের ছাই বর্ণে ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে চারপাশের পাহাড়-পর্বত-উপত্যকা! দৃষ্টির পরিসীমা আর খুব একটা এগোয় না। যেতে যেতে মরচে আলোয় থেমে যায়।
পশ্চিমাকাশে সূর্য কিছুক্ষণ আগে টুপ করে ডুবে গেছে। আকাশের কোণে কালচে পাহাড়সারির ওপর ছোপ ছোপ রক্তিম আভারাও মুছে যাওয়ার অপেক্ষায়। দূরে, পর্বতের খাড়া ঢাল পেরিয়ে অনেক নিচে পাহাড়ের গায়ে যেন ঝুলতে থাকা পাহাড়ি গ্রাম রুমানাপাড়ার খেলনার মত ঘরগুলোও আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।হালকা থেকে ক্রমশ ঘন ধোঁয়ার আড়ালে যে রকম কোনো কিছু হারিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করে।
চূড়ার একপাশে বসে ডাক্তার জাহিদ আর মৌ আপুর সাথে গল্প জুড়ে দেই। বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে আর ফুরফুরে হিমেল হাওয়া শীতল হাওয়ায় রুপ নিচ্ছে। খানিক পর দলের শেষ গ্রুপ নিয়ে দলনেতা অপু ভাই ফিরলে আমাদের নির্ধারিত কটেজের চাবি বুঝে পেলাম।
ভেতরে ঢুকেই গা এলিয়ে দেই। বলা যায় আপাদমস্তক কাঠের কটেজ। প্রায় চার ঘন্টা হাইকিং, তার আগে ষোল ঘন্টা বাস-ট্রেন-জীপ জার্নির ধকল শরীর জুড়ে। ক্লান্ত শরীরকে তাই কিছুক্ষণ বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে তারপর ওঠে ফ্রেশ হতে বের হলাম।
পর্বত চূড়ায় সবচে’ দুষ্পাপ্য জিনিস বলা যেতে পারে পানি। সেটা আমলে নিয়ে যথাসম্ভব মিতব্যয়ী হয়ে গোসল সেরে ফিরতেই ডিনারের ডাক পড়ল লালা বমের কটেজে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কেওক্রাডং পর্বতের অবস্থান। এক সময় যাকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হত। তবে ট্রেকারদের সাম্প্রতিক জরীপে চূড়া হিসেবে সর্বোচ্চের স্থান খোয়ালেও কেওক্রাডং অন্যতম সুন্দর চূড়া। এর চূড়ায় দাড়িয়ে অন্য সবগুলো পর্বত চূড়াই দেখা যায় খালি চোখে।
কেওক্রাডং শব্দের উৎপত্তি মারমা ভাষা থেকে। মারমা ভাষায় কেওক্রাডং এর মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়’।
খেয়েদেয়ে কটেজে ফিরে পাতলা টিশার্টের ওপর আরেকটা ফুলহাতা টিশার্ট ও গামছা গায়ে জড়িয়ে গিয়ে বসি চূড়ার কাছে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দিনের বেলা ট্রেকিংয়ের সময় খরতাপ ঘামিয়ে দিচ্ছিল। আর এখন চূড়ার ওপর যেন মাঘ মাসের শীত। রাত বাড়ার সাথে সাথে পুরো আকাশ যেন নেমে এসেছে কেওক্রাডং এর চূড়ায়। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে লক্ষ কোটি তাঁরা। কালপুরুষ, শুকতারা, সপ্তষীমন্ডল নাম না জানা আরো কতশত নক্ষত্ররাজি। দ্রুতি ছড়াতে ছড়াতে তাঁরাগুলো কখনো ঝাপসা হতে হতে অদৃর্শ্য হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত পর আবার ভেসে ওঠে।
মূলত মেঘের খন্ড এসে কিছুক্ষণ পর পর ঢেকে দিচ্ছিল আকাশ। তাতে ঢাকা পড়ছিল তাঁরাদের দল। কেউ একজন টর্চলাইট জ্বেলে দিলে দেখলাম আমাদের ঘিরে ভেসে যাচ্ছে খন্ড খন্ড মেঘদল। দূর আকাশে তাঁরাদের ভিড়ে ঝিম ধরে যাওয়া দৃষ্টিকে হঠাৎ হঠাৎ হতচকিয়ে দেয় উল্কাপিন্ডের পতন। বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা। তারপরও ফিরতে মন চাইছে না। আমরা দু’তিনজন ছাড়া চূড়ায় আর কেউ নেই।
মৃদু শব্দে বাজছে চন্দ্রবিন্দুর মনভোলানো কন্ঠে- আমার রাতজাগা তাঁরা, তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি…। রাতের মৌনতা ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছিল অচেনা কোনো বিহগের স্বর।
রাত বাড়লে তারপর কটেজে ফিরে গেলাম। কাঠের মেঝের ওপর আড়াআড়ি তোষক ফেলে বিছানা করা হয়েছে। গল্প করতে করতেই ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল। লেপ আটোসাটো করে গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তারপরও ঠান্ডা ঠান্ডা লাগতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে খেয়াল করলাম মেঘের ভেতর শুয়ে আছি!
ভারি কম্বলখানা আরেকটু গলা পর্যন্ত টেনে নিলাম। তার একটু পরে কটেজ থেকে বের হতেই চমকে যাই বিস্ময় আর অসম্ভব ভাল লাগায়। ঘোলাটে চারপাশ। রাতের শেষ প্রহরের ক্ষীণ আলো আর আঁধার মাখা মেঘের ভেতর দাড়িয়ে আছি। চোখ মুখ কান গলা ছুঁয়ে দিচ্ছে মেঘ। নিঃশ্বাসে মেঘের স্পর্শ। চারপাশ জুড়ে এক ঘোরলাগা অপার্থিব দৃর্শ্যপট। যেন ধবল মেঘে ডুবে গেছে দুনিয়া!
চূড়ার পুবপাশে ঢালের কিনারে দাড়িয়ে থাকা কটেজ যেন ভাসছে মেঘের ভেতর। দূরের কোনো পাড়া থেকে মৃদু ভেসে এলো মুরগের ঘুম ভাঙ্গানি ডাক। মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে বাঁশপাতা আর ঘাসের ডগা। তিরতির করে কেঁপে ওঠছে শণঝোপের শির।
চূড়া থেকে অনতি দূরে বেশ বড়সড় এক মেঘখন্ড। কিউমোলোনিম্বাস ক্লাউড জলোচ্ছাসের অবয়বে ধেয়ে আসছে। যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের!
এক সময় সোনালী আভা ছড়িয়ে ধবল দিগন্তে জ্বলে ওঠল আকাশ প্রদীপ। সূর্য ওঠার পর মেঘ ওপরে আকাশপানে মিলিয়ে যেতে থাকে। দূর দিগন্তে রোদ ঝলমল পরিষ্কার আকাশে ভেসে ওঠতে থাকে অন্য পর্বত চূড়া গুলোও। রোদ প্রখর হওয়ার আগ পর্যন্ত চূড়ার ওপর চলল আমাদের আড্ডা-গল্প।
অপূর্ব রাত ভোরের পর এবার কেওক্রাডং থেকে ফেরার পালা। খাড়া ঢালের চড়াই বেয়ে ওপরে ওঠার কষ্ট ফেরার পথে নেই বটে। তবে উৎরাইয়ে ঢাল নামতে গিয়ে পায়ের গোড়ালির ওপর কতোটা চাপ পড়ে, তা টের পাচ্ছিলাম। তার ওপর ট্রেকিংয়ের বড় অবলম্বন বাঁশের লাটিখানাও কটেজে ফেলে এসেছি।
দার্জিলিংপাড়ায় নেমে আসার পথে অপু ভাই বললেন, পাড়ার বর্তমান কার্বারি প্রায় তিন দশক আগে নিজ চোখে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখেছিলেন। গত শীতে কার্বারির কুটিরে আতিথ্য নিলে নিজেই তা গল্প করেন। রুমানাপাড়ার দিকে বছর দুয়েক আগেও নাকি বাঘ দেখেছে কেউ একজন। জুমের ধান পাকার সময়ে সান বিয়ার প্রজাতির বড় ভালুকের আনাগোনার কথাও শোনা যায়।
পাড়ার শেষপ্রান্তে ইরিন বমের দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ি। রঙ চায়ের কাপে চুমুক দিতেই চোখে পড়ে অনতিদূরে ফুটফুটে শিশু কোলে দাড়িয়ে থাকা এক তরুণী বম মা। পাশেই তার ছোট্ট মেয়েটিও। এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরা তাক করতেই ভাবাবেগহীন চেহারায় যেন হঠাৎ করেই মা মেয়ের হাসির প্লাবন বয়ে গেল।
লুংতংপাড়া হয়ে বাকি ট্রেইল হেঁটে বগালেক পাড়ায় নেমে আসতে আসতে বেশ ঘেমে গেছি। পাড়ার সিয়াম দিদির বারান্দায় খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে নেমে পড়লাম লেকের পানিতে। লেকের গভীরতার কারণে পানিতে বেশ নিন্মমুখী চাপ বলে সেখানকার সেনা ছাউনী থেকে সাঁতার কাটতে মানা রয়েছে। আমরা তাই পাড় ঘেঁষে গোছল সেরে নিলাম।
বগালেকের সৃষ্টির কারণ মূলত বড়সড় কোনো উল্কাপিন্ডের আঘাত বা সেটি কোনো মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বলেই ভূ-তত্ত্ববিদদের অভিমত।
ফিরতি পথে আবারো জীপের রোলার কোস্টার জার্নি! আকাশের চেহারা থমথমে। কালো মেঘ চষে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের আকাশ জুড়ে। বৃষ্টি নামি নামি করেও নামছিল না। অবশেষে বৃষ্টির ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গল। পাহাড়ের এক চূড়ার ওপর গাড়ি থামিয়ে দেখলাম বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে পাহাড়-উপত্যকা। দূরে কপিতালের দিকে আকাশ হতে যেন বিশাল এক ফোয়ারা কেউ খুলে দিয়েছে।
খুমি পাড়ার নিকটে বৃষ্টি আমাদের ধরে ফেলল। বড় বড় ফোঁটায় আছড়ে পড়ছে গায়ে। ঝুউমমম শব্দে অঝোর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি। আর সে বৃষ্টিতে ফিরতে ফিরতে দেখলাম- উচ্ছল পাহাড়ি বালিকার ভিজে ভিজে ঘরে ফেরা, আমবনে শালিক ছানার ইতিউতি চাহনি আর মেঘের ছায়ায় ছাইরংয়ে ডুবে থাকা দূর হতে দূরে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়।
ছবি: লেখক
শিমুল খালেদ : কর্মকর্তা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, মৌলভীবাজার শাখা।
আরও পড়ুন: