মাগুরায় আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় করা আলোচিত মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মামলার বাকি তিন আসামি—শিশুটির বোনের জামাতা সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ এবং তাদের মা জাহেদা বেগম খালাস পেয়েছেন।
শনিবার (১৭ মে ২০২৫) সকাল সাড়ে ৯টায় মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চার আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় মামলার রায় দেওয়া হলো।
২০২৫ সালের ৬ মার্চ শ্রীপুর উপজেলার ওই শিশুটি তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। সাত দিন পর, ১৩ মার্চ, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
হিটু শেখ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে একাধিকবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
জেলা পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা জানান, মামলার রায়কে কেন্দ্র করে শনিবার সকাল থেকে আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশে বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
অভিযোগপত্রে যেভাবে উঠে এসেছে অপরাধের বিবরণ
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আট বছরের শিশুটিকে যৌন নিপীড়নের সময় হিটু শেখ ধারালো ব্লেড ব্যবহার করেন, যা তার ‘বিকৃত ও পৈশাচিক মানসিকতা’ প্রকাশ করে। একজন নারীনেত্রী একে ‘জানোয়ারের মতো আচরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাড়িতে একা পেয়ে শিশুটিকে ধর্ষণের পরেও হিটু শেখ স্বাভাবিক আচরণ করেন—খাওয়া-দাওয়া করেন এবং মাঠে কাজে যান। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, যাতে ধর্ষণের পর মৃত্যুর দায়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ঘটনা ধামাচাপা দিতে হিটুর স্ত্রী জাহেদা বেগম শিশুটিকে হাসপাতালে না নিয়ে প্রথমে এক হুজুরের কাছে নিয়ে যান, দাবি করেন—জ্বীনের আছর হয়েছে। কিন্তু হুজুর শিশুটির গলার দাগ ও বুকে আঁচড় দেখে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর জাহেদা চিকিৎসকদের বিভ্রান্ত করে বলেন, শিশুটি পেটব্যথায় কাতরাচ্ছিল। তিনি শিশুটিকে ভর্তি না করে বাড়ি নিয়ে যেতে চান।
তদন্তে জাহেদা বেগমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারা (প্রমাণ লোপাট, সত্য গোপন) অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়েছে। সজীব শেখ ও রাতুল শেখের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৫০৪ ধারা অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়।
ঘটনার সময়রেখা, যে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ
১ মার্চ: রোজার ছুটিতে শিশুটি বোনের বাড়ি আসে।
৬ মার্চ: ধর্ষণের শিকার হয়; ওইদিনই হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং রাতে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
৭-৮ মার্চ: মেডিকেল বোর্ড গঠন ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর। ৮ মার্চ শিশুটির মা চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
১৩ মার্চ: শিশুটির মৃত্যু; মরদেহ উড়োজাহাজে মাগুরায় এনে দাফন।
১৪-১৫ মার্চ: ধর্ষণ মামলার পাশাপাশি হত্যা মামলাও হয়। হিটু শেখ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
৮ এপ্রিল: ডিএনএ রিপোর্টে হিটুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রমাণ মেলে।
১৩ এপ্রিল: অভিযোগপত্র জমা।
২৩ এপ্রিল–৮ মে: অভিযোগ গঠন ও ২৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন।
১৩ মে: যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১৭ মে নির্ধারণ।
১৪ কর্মদিবসে বিচার সম্পন্ন
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম মুকুল জানান, মাত্র ১৪ কার্যদিবসে মামলার বিচার শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার নির্দেশনা এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ৩০ কার্যদিবসের লক্ষ্য পূরণের আগেই রায় ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি জানান, হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পেয়েছেন। খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মামলার বিশেষ কৌঁসুলি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদাপ্রাপ্ত আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, বিচারক স্বাধীনভাবে বিচার বিবেচনায় রায় দিয়েছেন। তিনি জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিদের বক্তব্য জানার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা কিছু বলেননি বা সাফাই সাক্ষী আনেননি।
বাদীপক্ষের অসন্তোষের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। খালাসপ্রাপ্তদের বিষয়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”