কারও মৃত্যু অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা! মৃত ব্যক্তি বয়সে নবীন হলে দুঃখের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও দুঃখ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কারও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নোংরামো, বিচারের আগে রায়দান, অন্যদের ফাঁসানো আজকাল মাত্রা ছাড়িয়েছে! এক শ্রেণির বৈদ্যুতিন মাধ্যম যেন রীতিমতো ‘বিচারক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে! তিলকে তাল করা, অর্ধ-সত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদ পরিবেশন কতিপয় মিডিয়া গ্রুপের রুটি-রোজির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে! চিল কান নিয়ে গেছে! খবরটি কতটুকু সত্য হতে পারে, এই বিবেকটুকু কাজে না-লাগিয়ে চিলের পেছনে মুভি ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছেন কতিপয় সাংবাদিক! কিংবা কাকদন্ত গবেষণায় ব্যস্ত! বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের ফলে কোনটি সত্য, কোনটি অর্ধ-সত্য, কোনটি সর্বৈব মিথ্যা, তা যাচাই করা এখন সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার! কোনও একটি সংবাদ চ্যানেল দেখে কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা আত্মঘাতী হতে পারে! কমপক্ষে তিন/চারটি নিউজ চ্যানেলের প্রতিবেদন না-দেখা পর্যন্ত কোনও একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন!
এক শ্রেণির মিডিয়া নিজে সংবাদ সংগ্রহ করার পাশাপাশি পুলিশ হয়ে ‘তদন্ত’ করে আবার ‘বিচারক’ সেজে রায়দানও করে থাকে! ফলে, আমজনতা নিজ নিজ পছন্দের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত / পরিবেশিত রায়কে একমাত্র ‘সত্য’ বলে জ্ঞান করে থাকেন! মায়া নগরী মুম্বাইয়ে বিহারের তরুণ অভিনেতা সুশান্তর ‘মৃত্যু’ নিয়েও আজকাল নানা মুনির নানা মত সংবাদ মাধ্যমে চাউর হচ্ছে! সরকার সিবিআইসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ করেছে সুশান্ত সিং -এর মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে। নিন্দুকরা বলছেন, বিহারের নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকার জাতি-বিদ্বেষের চিরাচরিত খেলায় মেতেছে!
সুশান্তর প্রাক্তন প্রেমিকা বাঙালি-কন্যা রিয়াকে যেন-তেন-প্রকারেণ সুশান্ত সিং-এর মৃত্যুর জন্য ‘দায়ী’ করা না গেলে নির্বাচনি প্রচার ও ভোট জমবে না! তাই, নির্দিষ্ট ‘অভিযোগ’-এ রিয়াকে গ্রেফতার করা না-গেলেও ‘গাঁজা’ জোগান দেয়ার তথাকথিত অভিযোগে রিয়াকে গ্রেফতার করেছে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা! তাঁকে চোদ্দো দিনের হেফাজতে নেয়া হয়েছে তদন্তের স্বার্থে।
করোনকালীন পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ বিভিন্ন সমস্যায় জেরবার! প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী দেশের অর্থনীতি যখন পাঁচ ট্রিলিয়ন হওয়ার কথা, তখন, জিডিপি মাইনাস টুয়েন্টি ত্রি-তে নেমেছে! এতেই স্পষ্ট! দেশের জনগণের আর্থিক অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে! দেশের লক্ষ লক্ষ পরিবারে এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়! চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন নিম্ন-আয়ের লোকজনসহ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা! শ্রমিকদের অবস্থা তো বলা-ই বাহুল্য! দেশে সমস্যার অন্ত নেই! কিন্তু একশ্রেণির পোষ্য মিডিয়া ও সরকার পরিস্থিতির না-জায়েজ ফায়দা তুলতে ব্যস্ত! সুশান্ত সিং-এর মৃত্যু নিয়ে সরকারি তরফে ব্যাপক তৎপরতা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, দেশে সুশান্ত ইস্যু ছাড়া আর কোনও জ্বলন্ত ইস্যু নেই!
দেশবাসীর চোখ সুশান্ত সিং ইস্যুতে স্থির করার লক্ষ্যেই যে একাংশ পোষ্য মিডিয়ার ও সরকারের এতো তৎপরতা, তা কান পাতলেই যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে! সুশান্তর মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটিত হোক। কিন্তু বাকি সব কিছু স্থবির করে দিয়ে নয়। সুশান্তর মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গত ছয় বছরে অসংখ্য মানুষের অপমৃত্যু ঘটেছে, সেগুলোরও উপযুক্ত তদন্ত হোক। দোষীদের আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা হোক। সংবাদ মাধ্যম পুলিশও নয়; বিচারকও নয়! তাই, বিচারিক কাজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত ‘অভিযুক্ত’কে নির্দোষ বলেই জ্ঞান করা হোক।
লেখক: কবি,গবেষক ও শিক্ষাবিদ । প্রকাশক, দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ। করিমগঞ্জ। অসম।
আরও পড়ুন: