“What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”
বাক্যটি কত আত্মপ্রবঞ্চনামূলক, তা আমি সবিস্তারে লিখেছি আমার বিভিন্ন গ্রন্থে। বিশেষত, গবেষণা গ্রন্থ,”বাংলা সাহিত্যে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ” -এ। বয়কট আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন; এই পরস্পরবিরোধী সবগুলো আন্দোলনকে একাকার করে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গকে রদ করা ছিল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রাগ্রসর শ্রেণির হিন্দুদের আত্মঘাতী আন্দোলন! দায়িত্ব সহকারে এ-বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছি। উক্ত আন্দোলনের সময় মহামতি গোখলে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করে বাঙালিদের আসকারা দিয়েছিলেন!
ফল যা হওয়ার তা-ই হল! ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দিলেন! ১এপ্রিল, ১৯১২ সালে তা কার্যকরী হল। পাশাপাশি, কলকাতা থেকে ভারতবর্ষের রাজধানী চিরতরে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার নির্দেশও দিলেন! তখন থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালির আধিপত্য হ্রাস পেতে থাকল! গুজরাটিদের আধিপত্য ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকল! বঙ্গভঙ্গ রদের দুঃখ ভুলতে পারেননি পূর্ববঙ্গের জনগণ!
১৯৪৭ সালে শরৎ বসু, শহিদ সোহরাওয়ার্দি প্রমুখ নেতৃবর্গের শত চেষ্টা সত্ত্বেও অখণ্ড বাংলাদেশ সৃষ্টি হল না! ১৯৭১ এসে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি নিজস্ব একটি রাষ্ট্র পেলেন। কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বাঙালির ধার ও ভার কমে গেল! গোখলের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হয়ে বাঙালি সর্বস্বান্ত হলেন! পরবর্তীকালে, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে যে ক’জন বাঙালি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন, জ্যোতি বসু, সুমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো যাবতীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি! কারণ, ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল!
কলকাতা ভারতবর্ষের রাজধানী থাকলে ভারতবর্ষ একাধিক বাঙালি প্রধানমন্ত্রী লাভ করত! ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ না-হলে সম্ভবত দেশ ভাগও হত না! কারণ, ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লিগ-এর জন্মের আশু কারণ ছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও ছোটোলাট বামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টার প্রতিক্রিয়া! নব্যসৃষ্ট “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” প্রদেশ সৃষ্টির পর বামফিল্ড ফুলার ছিলেন “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” প্রদেশের ছোটোলাট। তাঁর তথাকথিত মুসলিমপ্রীতির দরুন তাঁকে হত্যা করার জন্য বার বার চেষ্টা করা হয়েছিল! এতে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন ঢাকার তরুণ নবাব সলিমুল্লাহ! ফলে, তাঁরই আহ্বানে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল “নিখিল ভারত মুসলিম লিগ”-এর। উদ্দেশ্য ছিল, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নামে হিন্দু সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও সরকারের নিকট নালিশ জানানো।
কালে কালে সেই মুসলিম লিগ সর্বভারতীয় কংগ্রেস-এর প্রতিস্পর্ধী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হয়! ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাগ্রসর হিন্দুরা যে ভুল করেছিলেন, ১৯৭১-এ এসে সেই ভুলের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করলেন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাবু সমাজ! আর নিজেরা রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপিনচন্দ্র পালদের ভুলের খেসারত দিলেন! ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন অধরা-ই থেকে গেল! ভারতবর্ষে মুসলমান জনগোষ্ঠী তিন তিনজন (চিফ জাস্টিস হেদায়েতুল্লাহকে হিসেবে আনিনি। তিনি ৩৫ দিনের জন্য এক্টিং প্রেসিডেন্ট ছিলেন) নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি পেলেও প্রাগ্রসর বলে বিবেচিত বাঙালি হিন্দুকে রাষ্ট্রপতি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০১২ সাল অবধি! যদিও ড. জাকির হোসেন (কার্যকাল : ১৩ মে, ১৯৬৭ থেকে ৩ মে, ১৯৬৯) ও ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ (কার্যকাল : ২৪ আগস্ট,১৯৭৪ থেকে ১১ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭) কার্যকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই রহস্যজনকভাবে নিজ নিজ কার্যালয়ে দেহত্যাগ করেন!
উল্লেখ্য, ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল কলকাতা থেকে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। আর ভারতবর্ষ “বাঙালি হিন্দু” রাষ্ট্রপতি পেয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ঠিক একশত বছর পরে!২০১২ সালের ২৫ জুলাই। পশ্চিমবঙ্গের প্রাগ্রসর হিন্দু বাঙালিদের অনেককে এখনও গোখলের বাক্যের জন্য আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখা যায়! কথায় কথায় এখনও সেই পুরনো আত্মঘাতী সংলাপটি আওড়াতে থাকেন, ” What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”! সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালির অধঃপতনের মূলে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন! কথাটি কেউ স্বীকার করুন বা না-করুন! এটাই বাস্তবতা!
প্রণব মুখোপাধ্যায়সহ উল্লিখিত নেতৃবর্গ সকল বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সর্বভারতীয় স্তরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন! কিন্তু পেছনে লোকবল কম থাকার দরুন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি! অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি! প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালির একটি স্বর্ণযুগের সমাপ্তি সূচিত হল! অদূর ভবিষ্যতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালি রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে থাকবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না! জ্যোতিবাবুর জ্যোতি, সোমনাথবাবুর রাশভারী কণ্ঠ কিংবা প্রণব দা’র ডিপ্লোমেসি থেকে বাঙালি চিরতরে বঞ্চিত হলেন! বিশেষ কোনও দল বা ধর্ম নয়, প্রণব বাবুর প্রয়াণে সামগ্রিক অর্থে বাঙালি হারালো তাঁদের শেষ দেউটি!