রাস্তা লাগোয়া মূল গেইট পেরিয়ে বাসায় প্রবেশ করতে গিয়ে বামপাশে যে নারকেল গাছটি পড়ে বা বাসার পেছনে অন্য গাছটিও যে সারা বছর নারকেলের ঝুপি নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকে, তা এতোদিন চোখে পড়লেও খেয়ালে খুব একটা রেখাপাত করতে পারেনি। বাসার দুইপাশে একজোড়া আমগাছ, কিংবা অনতি দূরের ঝোপের ভেতর কলার বন আর ডুমুরের ফলবর্তি গাছও কেমন যেন দৃষ্টিপাত এড়িয়ে থেকে ছিল।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সভ্যতার সঙ্কটকাল শুরু হওয়ার পর সরকারী ছুটিতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও দীর্ঘ ছুটি হয়ে যাওয়ার দরুণ পেশায় শিক্ষক বাসার দুইজন মেসমেট বাড়ি চলে গেছেন। আর তাই বাসায় একদম একা হয়ে পড়ি।
দিনে সীমিত পর্যায়ের ব্যাংক সেবাদান শেষে বাসায় ফিরে বাকি সময়টুকু একাকীত্বে কাটিয়ে দিতে গিয়ে এতোদিন খেয়াল এড়িয়ে থাকা চারপাশ দৃষ্টিপাত কাড়ল। অবসরের এই সময়টুকু প্রিয় বই ম্যাগাজিন পড়ে, টিভিতে সংবাদ ও মুভি দেখে আর মোবাইলে প্রিয়জনদের সাথে অফলাইন অনলাইনে কথা বলে সময় কেটে যেতে থাকে।
সন্ধ্যায় একমগ চা বা কফি নিয়ে গিয়ে একতলা বাসার খোলা ছাদে বসি কখনও। আলো ফিকে হয়ে এলে মাথায় ওপর দিয়ে কোঁয়্যাক কোঁয়্যাক শব্দে নিশিবকের ঝাঁক উড়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদও যে এমন বড়সড় হয়, সেটাই বা কতবার দেখেছি! নিমগাছের পত্রপল্লবে ছোঁয়া দিয়ে মৃদু বাতাস মাথার চুলও হালকা পরশে বুলিয়ে দিতে ভুলে না।
এরকম এক বিকেলে একটি কাঠবেড়ালীর ওপর চোখ রাখতে গিয়ে দেখি সেটি নারকেল গাছে ডাবের ঝুপির একটিতে দাঁত বসিয়েছে। নারকেল তলায় তখন চেয়ে দেখি এমন দাঁতে কাটা কয়েকটি নষ্ট ডাব নিচে পড়ে আছে। ঠিক সেই সময়টায় খেয়াল হল বাসার বিলেত প্রবাসী মালিক তো গত আড়াই বছরে একবারও এখানে আসেননি। ডাবগুলো তবে এভাবেই নষ্ট হয়ে যায়? তাই নষ্ট হওয়া থেকে ডাবের সদ্ব্যবহারের কথা মাথায় আসে তখনই। তবে তার জন্য লম্বা বাঁশ বা কাঠের টুকরো দরকার। এই শহরে এমন বাঁশ বা কাঠ পাব কই? কথায় বলে উদ্দেশ্য আন্তরিক হলে উপায়ও হয়ে যায়। সামনের বাসা পার হয়ে নতুন ওঠা একটা বাসায় ইট সিমেন্টের গাঁথুনীতে ব্যবহারের পর বেশ কিছু বাঁশের টুকরো ফেলে রাখা ছিল।কেয়ারটেকারকে ব্যাপারটা বলতে তার ব্যবস্থা হয়ে গেল। তারপর দিনে একটি করে ডাব গলা ভেজালো কয়েক দিন।
এর মধ্যে আমাদের ব্যাংক শাখা পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত সপ্তাহখানেকের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতে থাকা পরিবারের জন্য মন টানছিল। ম্যানেজার স্যারের সাথে কথা বলে একটি সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। লকডাউনের কারণে গাড়ির ব্যবস্থা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হল। যাতায়াতের ক্ষেত্রে কড়াকড়ির কারণে চালকেরা সহজে যেতে চায় না। শেষতক নিজের পেশাদার পরিচয় দিয়ে যেতে সমস্যা হবে না, নিশ্চয়তা দিয়ে গাড়ির ব্যবস্থা হল।
তবে ফেরার পথে এবার গাড়ির ওপর ভরসা না করে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের শারীরিক সক্ষমতার ওপর ভরসা করার। বাড়ি থেকে চাকুরীস্থলের দূরত্ব প্রায় আশি কিলোমিটার। অন্তত একবার সেই দূরত্ব বাইসাইকেল চালিয়ে পাড়ি দেব, এতোদিন ভেবেও সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে লকডাউনের বদৌলতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, শখের ভেলোস সাইকেল নিয়েই এবার যাব ঐ পথ। দিনের প্রথম প্রহরেই বেরিয়ে পড়ি। পথে একবার পুলিশ থামিয়ে জানতে চেয়ে এতো দূর যাচ্ছি শুনে অনেকটা চোখ কপালে তুলে দিল। প্যাডেলে দুইপায়ের চাপে সাইকেলের চাকা চলতে থাকে। আর যেতে যেতে দেখতে থাকি এক অন্য জগতের পথঘাট! যান কিংবা জানের কোনও কলরব কোলাহল নেই। নেই ধোঁয়ায় নাকমুখ চেপে ধরার ব্যাপারস্যাপার।
কুলাউড়া রাজনগরের মধ্যখানে চাবাগান অধ্যুষিত আঁকাবাঁকা টিলাঞ্চল। ক্লান্ত শরীরে চোখ জুড়িয়ে দুইপাশের নিসর্গ দেখতে দেখতে ভাবছি, সভ্যতার ব্যস্তযজ্ঞের সাময়িক বিরতীতে চারপাশ আর প্রকৃতি যে এমন প্রাণ ফিরে জেগে ওঠে, সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পর আমরা অন্তত এবার সেটা মনে রাখতে পারব তো?
লেখক : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা
আরও পড়ুন: