গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। হামলাকারী অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত শেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট। তার বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডের আদালতে হত্যা মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ সেদিন নিউজিল্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। রক্তের দাগ মুছে যাওয়ার আগেই আত্মঘাতি হামলা হলো শ্রীলংকায় তিনশতাধিক সাধারণ মানুষকে সেই হামলায় খুন করা হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মসজিদের সেই রক্ত আর শ্রীলংকার গীর্জার রক্তের রং একই ছিল। সেই লালে কোন ভিন্নতা ছিলনা। দিনের ও ব্যবধান ছিলনা, নিউজিল্যান্ডে হামলা হয়েছিল ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের পবিত্র দিন শুক্রবার। যেখানে জুম্মার নামাজে সমবেত হয়েছিলেন সবাই। শ্রীলংকায় হামলা হলো খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের পবিত্র দিন ইস্টার সানডেতে। তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে এইদিনে ইশ্বরের পুত্র যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার তিনদিন পর আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। ইতোমধ্যে শ্রীলংকার হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন আইএস আইএস । কিন্ত শুধু দায় স্বীকারে কি দায়মুক্তি ঘটে??
জায়ান নামের ফুটফুটে দেবশিশুটি বাবার সাথে সকালের খাবার খেতে গিয়ে লাশ হয়ে গেল। বাংলাদেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জায়ানের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত জায়ান নামের দেব শিশুটির দিকে আমি অপলক তাকিয়ে দেখি। বিষাদে ভরে উঠে মন। জায়ানের সমবয়সী আমার ভাগ্না ভাগ্নি গুলোর মুখ ভাবি।বাংলাদেশের একদল জঘণ্য মানুষ, শুধুমাত্র জায়ানের নানা, শেখ সেলিমের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে এই মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করছে। ঠিক তেমনি অন্যপক্ষ ৩৬০টি লাশের মিছিল এক পাশে রেখে, শুধু জায়ানের জন্যই সব হাহাকার উজার করে দিচ্ছেন, যতোটা না মানবিক কারণে তার চেয়ে বেশী রাজনৈতিক প্রভুভক্তি প্রমাণের জন্য বলে মনে করছেন অনেকে।
সর্বজনীন শোক কিংবা প্রতিবাদ নেই কোথাও। নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্স মসজিদে হামলায় প্রার্থনারত মানুষের উপর জঘন্য হামলায় সারা পৃথিবী হাতে হাত রেখে প্রতিবাদ করেছে। মুসল্লীদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে পাহারায় ছিলেন অমুসলিম নাগরিকগণ। লন্ডনের মসজিদগুলোর সামনেও অনেক অমুসলিম সেদিন বুক আগলে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিন্তু শ্রীলংকার হত্যাযজ্ঞ সেভাবে কোন উদ্যেগ দেখা যায়নি। এর কারণ হতে পারে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে সংখ্যাগুরুরা তাঁদের নিরাপত্তা দিতে, মানসিক শক্তি যোগাতে দাঁড়িয়েছিলেন। ইউরোপ তথা পশ্চিম বিশ্বে যেহেতু মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে সংখ্যাগুরু খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের নিরাপত্তা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।কিন্তু শ্রীলংকার মুসলমানরা যেমন সংখ্যালঘু, হত্যাযজ্ঞের লক্ষ্যবস্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও ঠিক তেমনি সংখ্যালঘু।
শ্রীলংকার বোমা হামলায় নিহতদের জন্য সমবেদনায় বা শোক জানানোতে কিছুই হয়তো পরিবর্তন ঘটবে না পৃথিবীতে, তবু মানুষ সাহস পায়, এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই বিশ্ব জনমতে রূপ নেয়।
ব্যাক্তিগত ভাবে পেশাদার, অপেশাদার কিছু হোয়াটস আপ এবং ফেইসবুক গ্রুপের সাথে জড়িত কোনটা ইচ্ছায় কোনটা অনিচ্ছায়।কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সেই পেশাদার অপেশাদার বন্ধুরা শ্রীলংকার সেই হামলায় কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন নি।যেমন বিক্ষুব্ধ ছিলেন নিউজিল্যান্ডে হামলা পরবর্তী সময়ে। শ্রীলংকার হামলাকে পাশ কাটিয়ে, সবাই ব্যস্ত ছিলেন জীবিত সাংবাদিক মাহাফুজ উল্ল্যাহ খানের আত্মার শান্তি কামনায় ব্যস্ত।
আমাদের সেই সহকর্মী, বন্ধুরা সেদিন উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ক্রাইস্টচার্চের হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা উল্লেখ করলো না কেন সেই বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন । একদল আবার ব্যস্ত ছিলেন ,নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিকা আর্ডরেন এর জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবীতে পিটিশন সাইন নিয়ে ।রোহিঙ্গার মতো আপদ বাংলাদেশ গ্রহণ করার পেছনে মানবতাবাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ছিল ধর্মবাজী। তবুও বাংলাদেশের মানুষ সরকার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই আপদ এখন বাংলাদেশের জন্য বিপদে পরিণত হয়েছে।
৯১ সালে বাবরী মসজিদের ধ্বংসের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা এখনো কিছু কিছু মনে আছে।মানুষের চোখে মুখে চাপা ভয়, জন্মমাটি ছেড়ে দেশান্তরি হওয়া তখনো সেইসব বুঝার বয়স ছিল না আমাদের। কিন্তু আতংকিত মুখগুলো এখন মনে পড়লে বুঝতে পারি সেই বেদনা। মানুষ যেন অন্তরে ধর্মান্ধতা লালন করে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে। মানুষের এই দ্বিচারিতার কাছে ধর্মানুভব, ধর্মানুবতাবাদ, মানবতাবাদ অপাংতেও।
এমন দিন না আসুক, শ্রীলংকার বৌদ্ধরা যদি মেতে উঠে মুসলিম নিধনে তখনো কি এই নীরবতা পালন করবেন ঐ মানুষগুলো। আরেকটা গুজরাট ফিরে না আসুক । আরেকটা বাবরী মসজিদ ফিরে না আসুক, পৃথিবীতে আর কোন মায়ানমার না হউক, আর কোন ইয়েমেন, গাজা না হউক। ধর্মানুভূতি নয়, মানবতানুভূতি জাগ্রত থাকুক। পৃথিবীটা মানুষের হউক। না হলে একদিন পৃথিবীতে শুধু রক্তের দাগ থাকবে , ধর্মগ্রন্থ আর ধর্মই থাকবে, কোন মানুষ থাকবে না সেদিন। অন্তরে বিষ রেখে এই রক্তপাত এড়ানো যাবে না।
যে মানুষ ব্রিটেনের সমাজ ব্যবস্থায় জীবন যাপন করেন। যাবতীয় সুযোগ সুবিদা ভোগ করেন, সেই একই মানুষ বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য কাজ করেন।
শ্রীলংকায় এর মাঝেই ছোট একটা ঘটনা ঘটে গেছে, কোন এক মসজিদে হামলা হয়েছে। চক্ষুলজ্জায়ই হয়তো কেউ প্রতিবাদ করেন নি। ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙার দুঃসহ স্মৃতি ভারতের চেয়ে বেশী বুঝেছেন বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বীর। ভারতে দাঙ্গা হয়েছিল দুইপক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ বাংলাদেশে হয়েছিল একতরফা । আমার বালক-বেলার সেই স্মৃতি কিছু কিছু এখনো মনে আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের নাম নিয়ে মসজিদে গুলি ছুড়বে,মসজিদ গুড়িয়ে দিবে, মুসলিমের নাম নিয়ে মন্দিরে গীর্জায়, মেলায় হাটে ঘাটে ক্লাবে বোমা মারবে, সিরিয়া ইরাক, আফগানিস্তানের মতো, মানব সভ্যতার সব নিদর্শন মুছে ধ্বংসস্তূপ করে দেবে পৃথিবী। প্রতিশোধের এই খেলায় যদি মানুষই না থাকে শুধু ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থ কি পৃথিবীকে পাহারা দিবে?
যাপিত জীবনে ধর্মকে রাখুন, গ্রামেগঞ্জে একটা প্রবাদ আছে, পুরুষ নষ্ট হয় হাটে, নারী নষ্ট হয় ঘাটে। ধর্ম নষ্ট হয় লোক দেখানোতে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন সেদিন বিশ্বমানবতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, কোথাও কোন মসজিদে কোন মন্দিরে কোন প্যাগোডায় গীর্জার সামনে কেউ দাঁড়ায়নি। সেদিন হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীজুড়ে মুসলামানদের পাশে এসে দাঁড়িয়ছিল। মুসলামানদের সেই দায়িত্বটা এইবার বেশী ছিল শ্রীলংকার খ্রিস্টানদের পাশে দাঁড়ানোর। গাজার জন্য, মায়ানমারের জন্য যেভাবে কন্ঠস্বর জেগেছিল, শ্রীলংকার জন্য সেটা কি হয়েছে ?
শ্রীলংকা নিউজিল্যান্ড হতে পারেনি। সহি কিংবা অসহি ফর্মুলা দিয়ে আর কতো! সহি হোক বা না হোক, স্বীকার করতে হবে ধর্মের নামেই এই রক্তপাত চলছে পৃথিবীব্যাপী। ১৭০ টা সংগঠনের নামের তালিকা করেছেন একজন, যারা ইউরোপ আফ্রিকা এশিয়া আমেরিকায় ধর্মের নামে এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আমরা বারবার বলছি সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই। এই বলে বলে প্রতিটা হত্যাকে শুধু সমবেদনা আর শোক জানিয়ে পাশ কেটে যাই।অথচ ধর্মের নামেই এই রক্তপাত হচ্ছে।তাই সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই বলে আর এড়িয়ে যাওয়ার আর সময় নেই। মানুষের পৃথিবী হউক ধর্ম গ্রন্থ আর ধর্ম থেকে কি হবে যদি মানুষই না থাকে। কে পালন করবে ধর্ম, কে পড়বে পবিত্র গ্রন্থসমূহ।
জুয়েল রাজ: সাংবাদিক কলামিস্ট