যে যুদ্ধ করে আর যে যুদ্ধের বয়ান তৈরি করে- এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম, তারা তৈরি করা বয়ান দিয়েই তো যুদ্ধ, যোদ্ধা, ইতিহাসকে চিনেছি। তাহলে এই ফারাকটা ভরাটের পথ কী?
ঠিক এই জায়গাটা থেকেই একসময় ভাবি, যোদ্ধার প্রকৃত বয়ানটাই বোধহয় সেই ফারাকটা ভরাট করে দিতে পারে। একসময় যোদ্ধার বয়ান শোনা শুরু করি। সত্যিকার অর্থেই তখন অন্য এক যুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করি যোদ্ধার চোখে। সেই ঘোর আজও কাটেনি।
কিন্তু যোদ্ধাও তো মানুষ, সময়ের ব্যবধানে সেও নিজেকে যে পাল্টে ফেলেনি- তাই বা কে বলবে! তবু আজও মুক্তিযোদ্ধার, বীরাঙ্গণার, শরণার্থীর গল্প শুনি ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার মতো সরলতা, মুগ্ধতা আর শিহরণ নিয়েই।
সেই অচেনা, অজানা, অখ্যাত যোদ্ধা, যারা মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দিয়েছিল, তাদের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এই উত্তাল মার্চের দিনগুলোতে শুনাতে চাই ৫২বাংলায় ।
‘মুক্তিযুদ্ধের পর তো সোয়ামি আমারে আর ঘরে লয় না। বলে, তুই পাকিস্তানী ক্যাম্পে যা। আমি তোর লগে থাকুম না। বাহে কন, আমি তখন কই যাই? সোয়ামি ঘরে আসে না, বাইরে বাইরে থাকে। ততদিনে বড় পোলা মোস্তফার জন্ম হইছে। বাপের বাড়ির লোকজন আমারে দেখে, পোলারে দেখে। সোয়ামিরে তখন অনেক বুঝায় বাপের বাড়ির লোকজন আর গ্রামের মানুষ। শেষে ছয় মাস পরে সোয়ামি আমারে ঘরে লইছে। হেরপরেও কত ঝগড়া, কথায় কথায় খালি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা তুলত। সে এখন পঙ্গু, অচল; চলাফেরা করতে পারে না। আমিই তারে দেখি, খাওয়াই।’
মেহেরজানের সামনে বসে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ বোধহয় তার মূল অবয়ব ছেড়ে বেরিয়ে আসছে আমার চোখের সামনে, মেহেরজানের কঙ্কাল যেন অন্য-ভিন্ন এক ছায়াশরীর হয়ে হানা দেয় পৃথিবীর তামাম যুদ্ধবিধ্বস্ত মনস্তত্ত্বে। আমি ইতিহাসের সেই কঙ্কাল খুঁজতে এসেছিলাম কুড়িগ্রামে।
বীরাঙ্গনা মেহেরজান বেগম ২০১৩ সালের আগস্টের এক সকালে আক্ষেপ করেই এসব কথা বলছিলেন।(ছবি: চন্দন সাহা রায়)