রাত তখন ৩টা। ঘুমে চোখ পড়ে যাচ্ছে সবার। কারণ সকালে সবার যায় যায় কর্মস্থলে কাজ আছে। তবু মনের শক্তি যেন কাজটি শেষ করতেই হবে। পরবাসে জীবনের প্রথম নিজ দেশের শহিদ মিনার বানাচ্ছে তিশা সেন। সে একজন নৃত্যশল্পী। চারুকলা আর বাচিকশিল্পেও তার পাকা হাত। বেড়ে ওঠেছে আরব আমিরাতে। ভিনদেশী সংস্কৃতির বলয়ে বেড়ে ওঠলেও তার মাঝে দেশ ও মাটির মমতা গেঁথে দিয়েছেন তার বাবা মা।
আর বাকিটুকু একটি প্রদীপকে জ্বলতে দেওয়ার উপযোগি করতে যে তাগাদা সেটি দেয়ার চেষ্টা আমাদের। দেশ নিয়ে অনেক জানা বাকি থাকলেও ভিনদেশে বেড়ে ওঠা তিশার মন মগজে বাংলাদেশ আর বাঙালিয়ানা। সে আন্তর্জাতিক মহলে নিজের দেশকে তুলে কথায় আর তুলিতে, কখনোবা নুপুরের ছন্দে আবার কখনো কলমের কালিতে।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ভোর হচ্ছে শহিদ মিনার বানাতে গিয়ে। সংহতি সাহিত্য পরিষদ আরব আমিরাতের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালন করতে এই শহিদ মিনার বানাবার আয়োজন। পুরোদিন স্কুলের শিক্ষকতা শেষে তিশা এসে লাগলো এই কাজে। সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত তার সাথে সাথে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তার বাবা মা। বাবা অনুপ সেন আর মা রূপশ্রী সেন। তারা বকাঝকা খাবার পরও যেন তিশার কাজের সহযোগি। তারা থাকেন আরব আমিরাতের আজমানে। আমি আর জাবেদ ভাই দুবাইয়ের সোনাপুর থেকে আমাদের কাজ শেষ করে আসছি আর আমিনুল শারজাহ শহর থেকে। পরে আমি জাবেদ ভাই আর আমিনুল রাত ১২টার পর একসাথে যাই তিশাদের বাসায়। গিয়ে দেখি শহিদ মিনার অনেকটা তৈরী। দেরী করাতে বরাবরের মতো তিশার চোখ রাঙিয়ে শাসন—এখন আসার সময় হলো?
মূল কারিগর তিশা আর মূল সহযোগি তিশার বাবা মা। আমরা তিনজন যোগ দিলাম টুকরো সহযোগিতার জন্য। তখন কাজ শেষ করতে করতে রাত ৪টা বাজে। আমরা চলে গেলাম আমাদের নিজেদের বাসায়। পরের দিন সকাল থেকে আমার কাজ আছে বলে ওখান থেকে ফিরে গেলাম বাসায়। রাতজাগা কষ্ট আমাদের কিছু না। বরং নিজ দেশের জন্য এই শহিদ মিনার বানাতে পেরে তিশার চোখে মুখে গর্বের ঝিলিক। আমরা কলাগাছ আর বাঁশ দিয়ে স্কুল জীবনে শহিদমিনার বানাবার যে সুখ পেতাস সেটি পেয়েছি। আর তারচে’ বেশি খুশি হয়েছি ভিনদেশে বেড়ে ওঠলেও বাঙালি সন্তানেরা ঠিকই জ্বলে ওঠে আপন আলোয়। অনেকটা নিজের কল্পনায় আঁকা ছবিটা দেশের ছবি হয়ে ওঠলে যে আনন্দ পায় একজন তুলি শিল্পী। আরব আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে স্থায়ি শহিদমিনার নেই। তবে কোথাও বাংলাদেশী স্কুলে কাঠ দিয়ে তৈরী বা স্থায়ি শহিদমিনার আছে বলে জানা গেছে।
পরেরদিন ছিলো শুক্রবার। শারজাহে চলে আমাদের বানানো শহিদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। আরব আমিরাতে থাকা বাংলাদেশী অনেক বাচ্চারা এতে অংশ নেয়। রঙতুলিতে আঁকে দেশের ছবি। আমাদের সভাপতি গুলশান আরা, সহসভাপতি সাইদা দিবা, সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয়ঘোষসহ সংহতি পরিবারের সবাই থাকি শ্রদ্ধা জানাবার সুন্দর পরিবেশ গড়তে। হয়েছিলোও তাই। দূতাবাসের বাইরে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আমাদের এই উপস্থাপনা সকলের নজর কাড়ে।
আমাদের এই অনুষ্ঠানে এসেছিলো ভারতীয় একটি বাচ্চা। নাম ভবিষ্যা। দক্ষিণ ভারতীয়। তার মা নিয়ে এসেছেন তাকে। তারাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এই প্রতীকি শহিদমিনারে। এবং বাচ্চাটি বাংলাদেশী বাচ্চাদের সাথে তাল মিলিয়ে এঁকেছে শহিদমিনারের ছবি। আমাদের অনুষ্ঠানে চলে একুশের গান আর কবিতা।
নানাশহর থেকে নানাজন এসেছেন দেশের টানে। পরবাসে বুকে দেশ লালন করা যেন পরবাসীদের পরম ব্রত। এইপ্রেম এতোটা গভির যতোটা গভিরে মায়ের ছবিতে হাত বুলায় মানুষ। পরবাসে পরদেশে এমন করে দেশকে লাল করুক সকল পরবাসী।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সংহতি সাহিত্য পরিষদ, আরব আমিরাত শাখা, প্রতিনিধি-একাত্তর টিভি ।