যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে কেন জামিন চাইব? প্রশ্ন লতিফ সিদ্দিকীর
- আপডেট সময় : ০৩:৩০:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৫
- / 256
মব সৃষ্টি করে ‘মঞ্চ ৭১’ আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে আলোচনা সভা পণ্ড করে দেওয়ার পর সেখান থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দেওয়ার পর আদালতে হাজির করা হলে আদালত কাউকেই জামিন দেননি। আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ও সাংবাদিক মনজুরুল ইসলাম পান্নাসহ ১৬ জনকেই কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জনের পক্ষে আদালতে জামিন প্রার্থনা করা হলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে জামিন আবেদন করা হয়নি।
মামলার শুনানিতে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী তার জামিনের প্রার্থনার জন্য ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেননি বলে জানান আইনজীবী সাইফুল ইসলাম সাইফ। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, “লতিফ সিদ্দিকীর জামিনের প্রার্থনা করতে জন্য যখন তার কাছে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে যাই তখন তিনি বলেন, যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে কেন জামিন চাইব? আমি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করব না, জামিন চাইব না।’’ তিনি আরও জানান, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে যতবার স্বাক্ষর আনতে গিয়েছি, ততবারই তিনি এ কথা বলেন, এ কারণে তার জামিনের প্রার্থনা করা হয়নি।
শুক্রবার (২৯ আগস্ট) সকালে ঢাকার মহানগর হাকিম সারাহ্ ফারজানা হকের আদালতে, এই মামলায় লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৬ জনকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই তৌফিক হাসান।
আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখীসহ অন্যরা জামিন চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম সারাহ্ ফারজানা হক লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৬ জনকে কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন।
গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামিরা হলেন- মো.আব্দুল্লাহ আল আমিন (৭৩), কাজী এ টি এম আনিসুর রহমান বুলবুল (৭২), গোলাম মোস্তফা (৮১), মো. মহিউল ইসলাম ওরফে বাবু (৬৪), মো. জাকির হোসেন (৭৪), মো. তৌছিফুল বারী খান (৭২), মো. আমির হোসেন সুমন (৩৭), মো. আল আমিন (৪০), মো. নাজমুল আহসান (৩৫), সৈয়দ শাহেদ হাসান (৩৬), মো. শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার (৬৪), দেওয়ান মোহম্মদ আলী (৫০), মো. আব্দুল্লাহীল কাইয়ুম (৬১)।
এদিন সকালে আসামিদের সিএমএম আদালতে আনার পর হাজতখানায় রাখা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাদের এজলাসে তোলা হয়। এসময় তাদের হাতে হাতকড়া, মাথায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল। কাঠগড়ায় তোলার পরও আসামিদের পরনে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দেখা গেছে।
শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন) পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “ভয়াবহ অবস্থা। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলি।” তখন পুলিশ সদস্যরা তাদের জ্যাকেট খুলে দেন।
কাঠগড়ায় সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন লতিফ সিদ্দিকী। এসময় তাকে হাস্যজ্জ্বোল দেখা যায়। পানি পান করেন। মাঝে মধ্যে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
কারাগারে নেওয়ার পথে সাংবাদিকরা লতিফ সিদ্দিকীর কাছে তার কিছু বলার আছে কী না জানতে চাইলে তিনি মাথা নাড়িয়ে ‘না’ করে দেন। পরে তাকেসহ অন্যদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
মামলার বিবরণে যা বলা হয়েছে
মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বন্ধের লক্ষ্যে গত ৫ আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য জাতির অর্জনকে মুছে ফেলার সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নেওয়া। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ২৮ অগাস্ট সকাল ১০টায় একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
“সেগুনবাগিচায় বেলা ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর মধ্যেই এক দল ব্যক্তি হট্টগোল করে স্লোগান দিয়ে সভাস্থলে ঢুকে পড়েন। একপর্যায়ে তারা অনুষ্ঠানস্থলের দরজা বন্ধ করে দেন। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করেন। হট্টগোলকারীরা গোলটেবিল আলোচনার ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন এবং আলোচনায় অংশ নেওয়াদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে অতিথিদের অনেককেই বের করে দেওয়া হলেও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এবং অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। পরে পুলিশ এসে ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেন এসআই আমিরুল ইসলাম। পরবর্তীতে এ মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।”
যা ঘটেছিল
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট ২০২৫) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আলোচনা সভার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের। আর সভাপতিত্ব করার কথা ছিল অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নার। সভার শুরুতে তারা উপস্থিত ছিলেন না। সকাল ১১টায় শুরু হওয়া আলোচনা সভায় প্রথমে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে জামায়াত শিবির ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের জুতার মালা পরাচ্ছে।’
শেখ হাফিজুর রহমানের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেই মিছিল নিয়ে একদল ব্যক্তি ডিআরইউ মিলনায়তনে ঢোকেন। এ সময় তাঁরা ‘জুলাইয়ের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘লীগ ধর, জেলে ভর’, ‘জুলাইয়ে যোদ্ধারা এক হও লড়াই করো’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। তারা অনুষ্ঠানে আসা শ্রোতাদের বের করে দেয়। অতিথিদেরও বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের গায়েও ধাক্কা দেয়।
একজনকে ফেলে রক্তাক্ত করা হয়। অতিথিদের মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে আক্রমনের মুখে অতিথিরা চলে গেলেও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী মঞ্চে বসেই থাকেন।
লতিফ সিদ্দিকীকে ঘিরে কয়েকজন তরুণ লাফাতে লাফাতে স্লোগান দেয়, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জেলে ভর’- এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনকে অবরুদ্ধ করে রাখে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বহিরাগতরা। এ সময় একজন যুবক অধ্যাপক কার্জনকে গালাগাল করলে তিনি বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমি তো কোনো দল করি না, এখানে সংবিধান নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছিলাম।
অনুষ্ঠানে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমি এখানে প্রোগ্রামে এসেছি। দল মতের হিসাবে নয়, এখানে সব মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকা হয়েছে; তাই এসেছি। আমরা প্রোগ্রাম শুরু করেছিলাম। লতিফ সিদ্দিকী সাহেব এসেছেন। কামাল হোসেন সাহেব আসেননি। ২০/২৫ জন ছেলে এসে হট্টগোল করে। আমাদের ঘিরে ফেলে।”
অনুষ্ঠানস্থলে কেশব রঞ্জন সরকার নামের একজন মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। আর রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মারধরের শিকার হন জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম।
মব সৃষ্টিকারীরা নিজেদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কয়েকজন কর্মীকে মারমুখি অবস্থায় দেখা গেছে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন স্থানীয় যুবদল ও বিএনপি নেতাকর্মীরাও যোগ দেন। ডিআরইউ প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা পালন করেনি কিংবা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ সময় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি জানতাম না এখানে সমস্যা হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এই অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়েই এসেছিলাম।’
একপর্যায়ে তাঁরা গোলটেবিল আলোচনার ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। দুপুর সোয়া বারোটার দিকে পুলিশের (ডিএমপি) একটি দল আসলে তাঁরা পুলিশের কাছে লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমানসহ অন্তত ১৬ জনকে তুলে দেন। অতিথিসহ অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে যাওয়ার সময় তখন পুলিশ জানিয়েছিল, মব হামলার মুখে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পরে তাদের মধ্যে কয়েকজনতে মিন্টো রোডে এবং কয়েকজনকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পুলিশ তাদের কারও নাম জানায়নি। রাত ১০টা অবধি তাদের আটক করার বিষয়েও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। রাত সাড়ে ১০টার পরে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে বলেন অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল। এর কিছু সময় পর তিনি মামলা হওয়ার তথ্য দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর কথা বলেন।
আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক একুশে পদকপ্রাপ্ত সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান, মঞ্চ ৭১-এর সমন্বয়ক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ প্রমুখ।

















