জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা, কেউ বলছে ‘হাস্যকর’, কেউ বলছে ‘পণ্ডশ্রম’
- আপডেট সময় : ১২:১৮:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
- / 124
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এটি কার্যকর করার প্রক্রিয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। কমিশন তাদের সুপারিশে নতুন একটি ধারা যুক্ত করে “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (নয় মাস) “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে কাজ করবে। এই সময়ের মধ্যে জুলাই সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করা না গেলে, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হবে। জুলাই সনদ সইয়ের আগে এই ধারা যুক্ত ছিল না। বিএনপি এই প্রস্তাবকে বলেছে ‘হাস্যকর’, আর বাম দলগুলোর মতে, নয় মাসের কার্যক্রম “পণ্ডশ্রমে” পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপি ও সমমনাদের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিনই “গণভোট” আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও কমিশন বলেছে, এটি তার আগেই করা যেতে পারে। পাশাপাশি, “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগেই জানিয়েছিল, তারা নির্বাচনের দিন গণভোটের পক্ষে নয়। তাদের দাবি, নভেম্বরেই গণভোট করে সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা হোক। তাদের মতে, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে গণভোটের গুরুত্ব হারাবে।
এনসিপিসহ চার বাম দল এখনও সনদে সই করেনি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন মতভেদের কারণে প্রশ্ন উঠেছে—জুলাই সনদ আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে ২৭০ দিনের মধ্যে কার্যকর না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হবে—এমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। আমি মনে করি, এটি পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দিলে ভালো হতো। আর সময়সীমা নয় মাসের পরিবর্তে ছয় মাস হওয়াই যুক্তিযুক্ত।”
তিনি আরও বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব অধিকাংশ দলেরই ছিল। সেখানে কমিশন আগেই গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে—এটা ঠিক হয়নি।” তবে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়াকে তিনি ইতিবাচক মনে করেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই সুপারিশে কমিশন ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। অঙ্গীকারনামায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা ছিল না। নোট অব ডিসেন্টও বাদ দেওয়া হয়েছে।” মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পর বিকালে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে কী আছে?
জুলাই সনদ কার্যকরের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তিনটি প্রক্রিয়া প্রস্তাব করেছে।
প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করবে। গণভোটে অনুমোদন পাওয়া বিল পরিষদের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে না পারলে, বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ–২০২৫” জারি করবে। আদেশ এবং এর তফশিলে উল্লিখিত প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।
আদেশ জারির পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে একটি “সংবিধান সংস্কার পরিষদ”, যা সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদ ও পরিষদ একসঙ্গে কাজ করবে।
অন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং কাজ শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম শেষ হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে রাজনীতিকদের শুরুতে তেমন ধারণা ছিল না। তারপরও সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছে। কমিশনের সুপারিশ ভালো উদ্যোগ। তবে অধ্যাদেশের কথা যেভাবে বলা হয়েছে, তা সংবিধানে নেই। তাই বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
অনিশ্চয়তা দেখছে না জামায়াত ও এনসিপি
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “তিন ধাপে সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশ ইতিবাচক দিক। সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য।” তবে তার দল নভেম্বরেই গণভোট চায়। তার ভাষায়, “নির্বাচনের দিন গণভোট করা ঠিক হবে না, এতে গণভোট গুরুত্ব হারাবে।” তবু তিনি মনে করেন, যেকোনও প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হয়ে যাবে—তাই এতে কোনো অনিশ্চয়তা নেই।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে আমরা প্রাথমিকভাবে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। বিশেষ করে নোট অব ডিসেন্ট তুলে নেওয়া, গণ-অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেটে বাস্তবায়ন আদেশ জারি, পুরো সনদ ‘হ্যাঁ–না’ প্রশ্নে গণভোটে নেওয়া—এগুলো সবাইকে মেনে নেওয়া উচিত। তবে গণভোট নির্বাচনের আগেই হলে সনদ বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে।”
নয় মাসের কার্যক্রম ‘পণ্ডশ্রম’
সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি চার বাম দল—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের দেওয়া সুপারিশকেও তারা একপেশে হিসেবে দেখছে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের নয় মাসের কার্যক্রম পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়েছে। তারা সব সময় নিজেদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে যে সাংবিধানিক আদেশের কথা বলা হয়েছে, আদালতে গেলে তা টিকবে না—কারণ একটি সংবিধান বিদ্যমান থাকতে এমন আদেশ বৈধ নয়।”
তিনি আরও বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে পরিষদ ভেঙে দেওয়ার বিধান থাকা উচিত ছিল। আর ঐকমত্য না হওয়া বিষয় বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও ঠিক হয়নি।” তার মতে, “এ পর্যায়ে সনদে সই করা না করা একই কথা।”
বাসদ (মার্কসবাদী)-এর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “আমরা শুরু থেকেই নোট অব ডিসেন্ট রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। কমিশন এতদিন কিছু বলেনি, এখন তা সুকৌশলে বাদ দিয়েছে। আবার ২৭০ দিনের মধ্যে কার্যকর না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হওয়ার প্রস্তাবও প্রহসন। এ অবস্থায় গণভোটের আর প্রয়োজন নেই।”
আরও পড়ুন:
















