- বাউলদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে: প্রেস সচিব
- বাউলদের ওপর হামলা করছে উগ্র ধর্মান্ধরা: মির্জা ফখরুল
- ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাউল শিল্পী আবুল সরকার কারাগারে
দেশে বাউল ও তাঁদের অনুসারীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা চলছে। এসব ঘটনায় ধর্মীয় একটি গোষ্ঠীকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে, যারা নিজেদের ‘তৌহিদী জনতা’ হিসেবে পরিচয় দেয়।
গত ২৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজের ভক্তদের ওপর প্রথম হামলা হয়। এরপর বুধবার আবারও হামলার ঘটনা ঘটে ঠাকুরগাঁও ও খুলনায়।
ঘটনার সূত্রপাত মানিকগঞ্জের ঘিওরে ৪ নভেম্বর আয়োজিত একটি পালাগানের আসরকে ঘিরে। সেখানে আবুল সরকার মহারাজ ও ফরিদপুর থেকে আসা আরেক বাউল—নাম একই—দু’পক্ষ ‘জীব’ ও ‘পরম’ নিয়ে চার ঘণ্টা দীর্ঘ দার্শনিক বিতর্কে অংশ নেন। মানিকগঞ্জের আবুল সরকার মহারাজ ছিলেন ‘জীব’ পক্ষের, আর প্রতিপক্ষ ‘পরম’ নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এই পালার কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপ কেটে অনলাইনে ছড়িয়ে ধর্মবিরোধী মন্তব্যের অভিযোগ আনা হয়। পরে মামলা করে দ্রুত তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর পর থেকেই তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি তুলছেন ভক্ত-অনুরাগীরা। দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে মাজার, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর হামলা অব্যাহত থাকলেও এসব রোধে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়েনি। এবারও সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বহুজন।
ঘটনাটি প্রসঙ্গে কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যে সরকারের দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়—সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে বিষয়টি ‘অস্বস্তিকর’; তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ফৌজদারি অপরাধে পদক্ষেপ নেওয়ার মূল দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মনে করেন, ‘আগের নিপীড়িতরা এখন নিপীড়ন করছে’। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঘটনাটিকে ‘ট্র্যাজিক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে, বাউলদের ওপর হামলাকে ‘ন্যক্কারজনক’ বলে অভিহিত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হামলা, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
অবশেষে বৃহস্পতিবার বাউল সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।
নাট্যকার ও গীতিকবি শাকির দেওয়ান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, যে পালাকে কেন্দ্র করে এত বিতর্ক—‘জীব ও পরম’ পালা—এর শিকড় বহু পুরোনো। আলেফ চাঁন শাহ ওরফে আলফু দেওয়ানের হাত ধরে এ পালার সৃষ্টি, যার বয়স শত বছরের বেশি। তাঁর পরিবার ও পরবর্তী শিল্পীদের হাত ধরে পালাটি আজও জনপ্রিয়।
শাকির দেওয়ান বলেন, তাঁর ছোটবেলা থেকেই পালাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শ্রোতারা এটিকে ভক্তিবোধ নিয়ে উপভোগ করেন।
তিনি জানান, পালাগানের শিকড় খুব প্রাচীন না হলেও, এর বিস্তার ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে। পরিবেশনে আলাদা ঢং—একজন বা দুজন পালাকারের তর্কভিত্তিক উপস্থাপন, যেমন শরীয়ত-মারফত, হিন্দু-মুসলিম, গুরু-শিষ্য বা জীব-পরম।
আলফু দেওয়ান প্রথম ময়মনসিংহ এলাকায় এ ধারার সূচনা করেন। সারারাত গাওয়া মরমী- মারফতি গানে যুক্তি-তর্ক যোগ করলে শ্রোতার আগ্রহ বাড়ে, এমন ভাবনা থেকেই এ ধরনের পালার জন্ম।
শাকির দেওয়ান বলেন, পালায় যতই তর্ক হোক, ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকে না। শেষে শিল্পীরা একে অপরকে আলিঙ্গন করেন, একসঙ্গে সমাপনী গান ধরেন—যা ‘জুড়িপালা’ নামে পরিচিত।
তিনি আরও বলেন, সংগীতের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই—“গান আদিকাল থেকেই আছে, ধর্মের কথাই তো বলা হয় এতে।” আবুল সরকারের কথার একটি অংশ কেটে ‘হিংস্র আক্রমণ’ চালানোকে তিনি অমানবিক উল্লেখ করেন।
‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হামলা’
কবি–চিন্তক ফরহাদ মজহার আবুল সরকারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ও বাউলদের ওপর হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, ভবিষ্যতে বাউলদের নিয়ে মানিকগঞ্জেই বড় সম্মেলন করবেন।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “চার ঘণ্টার পালা থেকে কিছু সেকেন্ড নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ।”
তাঁর মতে, পালাগান দর্শনচর্চার একটি বিশেষ ধারা—সক্রেটিস যেমন কথোপকথনের মাধ্যমে ভাব বিনিময় করতেন, বাউলরা তেমনি শ্রুতি ও কণ্ঠের মাধ্যমে ভাবসংলাপ করেন।
তিনি বলেন, কেউ আহত হলে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু বাউলদের লাথি মেরে পানিতে ফেলা, জবাইয়ের হুমকি—“যারা ইসলামের নামে এসব করছে, তাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।”
তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, “সম্ভবত বিদেশি কোনো শক্তি এদের নামিয়েছে, অথবা নির্বাচন নস্যাৎ করার জন্য। দ্রুত গ্রেপ্তার করা জরুরি।”
এটাকে তিনি ‘জাতিবাদের সংঘর্ষ’ বলে উল্লেখ করেন—সেক্যুলার বনাম ধর্মীয় জাতিবাদ। সেক্যুলার জাতিবাদের পতনের পর ধর্মীয় জাতিবাদ শক্তি পেয়েছে, যা অশুভ—এটিকে মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি যোগ করেন, “সমাজের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে, সামনে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বড় পরিবর্তন আসছে।”
‘জালিম একই আছে, লেবাস বদলেছে’
নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, দেশের বহু মানুষ বাউলগান থেকেই জীবনদর্শন খুঁজে পান। বাউলরা কারও বিরুদ্ধে কথা বলেন না—তারা মানবমন, প্রাণ ও প্রেমের কথা বলেন। বাউলদের আঘাত করে মানুষের ভেতরের এই কথা কি থামানো যাবে?
তিনি আক্রমণকারীদের উদ্দেশে বলেন, সম্পদের লোভ থাকলে সরাসরি বলুন। আর ভাবের অমিল থাকলে বোঝার চেষ্টা করুন।
শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মনে করেন, আগের সরকারের মতোই এখনকার হামলাকারীরাও অত্যাচারী—শুধু পোশাক বদলেছে।
তিনি বলেন, কেউ যদি মনে করেন তাঁর বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে, তিনি এসে বলুক। হাত তোলার মাধ্যমে কেবল আরও ক্ষোভ তৈরি হবে—জুলাই অভ্যুত্থান এ শিক্ষাই দিয়েছে।
দেশের প্রশাসনে নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র আরও কার্যকর হলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভয়–ভীতি কাটিয়ে এগোলে এ ধরনের সহিংসতা অনেক কমবে।