অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকদের শ্রদ্ধা, ফুলেল ভালোবাসা ও তাঁদের কর্মজীবনের তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলার ১৪ জন শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়েছে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা-২০২৪। এরমধ্যে ৫ জনকে দেওয়া হয়- টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা -২০২৪। বাকী ৯ জন আদর্শ শিক্ষককে দেয়া হয়েছে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন বিশেষ সম্মাননা- ২০২৪
সম্মাননাপ্রাপ্ত ১৪ শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের হাতে বায়োগ্রাফি তুলে দেওয়া হয়। এবং প্রজেক্টারের মাধ্যমে তাদের জীবনচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া সম্মাননাপ্রাপ্ত প্রত্যেক শিক্ষককে আর্থিক উপহার দেওয়া হয়েছে।
৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আলী আমজাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে জমকালো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফজলুর রহমান।
বিশেষ অতিথি ছিলেন টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন ইউকের বাংলাদেশ সমন্বয়ক , সিলেট বিভাগ বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কবির খান।
এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যবাসি সিনিয়র সাংবাদিক ও ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি চৌধুরী মুরাদ।
সভাপতিত্ব করেন আলী আমজাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: মইনুল হক । সঞ্চালনায় ছিলেন একই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক বাবুল উদ্দিন খান।
অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো.আব্দুল করিম, আলহাজ্ব মোহাম্মদ মাশুক , মো. আমজদ আলী,মো.সফিকুর রহমান,ভিডিও কলে নিহারেন্দ্রু ভট্টাচার্য্য ও খুরশীদ উল্লাহর পক্ষে ছেলে রাসেল আব্দুল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর শিক্ষকরা সেই মেরুদন্ড তৈরির শ্রম শিল্পী।একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে যেমন স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়, তেমনি শিশুর ভবিষ্যৎ লক্ষ্যে পৌঁছাতে শিক্ষকেরা আলোর দিশারি হয়ে কাজ করেন। তাদের চিরজীবন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধনে রাখা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রধান অতিথি মোহাম্মদ ফজলুর রহমান শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন- টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন ইউকের উদ্যোগের ভুয়সী প্রসংশা করে বলেন, এই ধরণের চর্চা যতো বেশী হবে সমাজ তো বেশী উপকৃত হবে। মানুষ গড়ার কারিগরদের আনুষ্ঠানিক সম্মান জানানো ব্যক্তিরাও সমাজে নি:সন্দেহে সম্মানীত। প্রবাসে থেকেও সমাজে আলোকিত করার অনন্য কাজ করা যায়- যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই সংগঠনটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
বিশেষ অতিথি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও টি আলী স্যার ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ সমন্বয়ক কবির খান তার বক্তব্যে – ফাউন্ডেশনের ধারাবাহিক কার্যক্রম এবং সম্মাননা পদকের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মা-বাবার পরে শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন। একজন ভালো শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ দেখাতে পারেন। জীবনে সফলতার পেছনে যার অনুপ্রেরণা, দক্ষতা ও দিক-নির্দেশনা সবচেয়ে বেশী থাকে তিনি হচ্ছেন- শিক্ষক।
সংগঠনটি ধারাবাহিকভাবে সিলেট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকদের খুজে বের করে সম্মানীত করছে। উদ্যোগটি নি:সন্দেহে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
তিনি বলেন, টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন এর অন্যতম আলোকিত কাজ হচ্ছে- সংগঠনটি লৌকিকতার বিপরীতে অনেকটা নিরবে তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকদের সম্মান ও সহযোগিতায় কাজ করে। তিনি ফাউন্ডেশনের সকল কর্মকর্তা, ডনার, ট্রাস্টিদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথি যুক্তরাজ্যবাসি সাংবাদিক চৌধুরী মুরাদ বলেন, ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- মানুষ গড়ার কারিগরদের সম্মান জানানো। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবদ্দশায় তাদের ভালোবাসার বন্ধনে রাখার চর্চা করা। যাদের কারনে সমাজে আমরা আলো ছড়াচ্ছি তাদের সেবা ও সম্মান দেখানোকে সবচেয়ে মহৎ ও সেরা কাজ বলে মনে করি।
তিনি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এই সংগঠনের পক্ষ থেকে উপস্থিত শিক্ষক ও অতিথিদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বর্ণাঢ্য জীবনের তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই সময় অনেক শিক্ষক তাদের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীন শিক্ষকদের পাশে থাকা স্বজনরাও আবেগ আপ্লুত হয়ে গর্ববোধ প্রকাশ করেন। পরে সম্মাননাপ্রাপ্ত ১৪ শিক্ষক ও তাদের পরিবারের হাতে বায়োগ্রাফি তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন ফেঞ্চুগঞ্জ ফরিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো.ময়ুব আলী ও গিতা পাঠ করেন অরপিতা সুত্রধর ।
সম্মানাপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ফুল দিয়ে বরণ করেন স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল মতলিব ও দশম শ্রেণীর ছাত্রী তাহিহা তাবাসুম ।
ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় মনোনয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার জেলার মোট ৭টি উপজেলার মধ্য থেকে প্রতি উপজেলা থেকে ২জন অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের নাম টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক ২০২৪ এর জন্য চুড়ান্ত করে। এদের মধ্য থেকে ৫জনকে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক ২০২৪ ও ৯জনকে বিশেষ সম্মাননা পদকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূষিত করা হয়।
টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক-২০২৪ প্রাপ্ত ৫জন গুণী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হলেন- বড়লেখা উপজেলার ছিদ্দেক আলি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন ।
কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মাশুক, জুড়ী উপজেলার সাগরনাল উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল ইসলাম, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আজমনি বহু পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক মো. সফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য।
এছাড়াও ৯জন শিক্ষককে দেওয়া হয়েছে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন বিশেষ সন্মাননা পদক। সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন- মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কানিহাটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. খুরশীদ উল্লাহ ,শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক দ্বীপেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য, শ্রীমঙ্গল উপজেলার দি বার্ডস রেসিডেনসিয়েল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক আব্দুল হামিদ,রাজনগর উপজেলার রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয় ধর্মীয় শিক্ষক আব্দুল করিম , জুড়ী উপজেলার রাঘনা বটুলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক হিমাংশু মোহন পাল, বড়লেখা উপজেলার ফকিরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক নিরঞ্জন চন্দ্র দাস,কমলগঞ্জ উপজেলার ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আমজদ আলী,মৌলভীবাজার সদরের জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুর রহমান ,রাজনগর উপজেলার মেহেরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার দেব।
তজম্মুল আলী একজন মানুষ গড়ার কারিগর। ভালোবেসে তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রীরা নাম রাখেন টি আলী স্যার। টি আলী স্যার সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার বৃহত্তর জলঢুপে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি হোস্টেল সুপারের মত গুরু দায়িত্বও পালন করেন। ২০১৯ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান এই শিক্ষকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারিটি সংস্থা -টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন ইউকে।
মূলত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষকদের সহযোগিতার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০২০ সালে সিলেট বিভাগে আদর্শ শিক্ষকদের নিয়ে কাজ শুরু করে সংগঠনটি। আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা আদর্শ শিক্ষকদের সন্ধান অথবা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রুচিশীল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যাদের খোঁজ খবর অনেকে রাখেন না- তাদেরকে খোঁজে কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে।
ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ সমন্বয়ক, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সিলেট বিভাগ বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি কবির খান।
ইতিমধ্যে ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের ২০২২ সালে সিলেট জেলা, ২০২৩ সালে হবিগঞ্জ জেলায় সম্মাননা প্রদান করেছে। এবং আগামী বছর সুনামগঞ্জ জেলায় প্রদান করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলার ১৪ জন অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন করায় ফাউন্ডেশনের সভাপতি ফয়ছল আহমদ রুহেল ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম অভি ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ টিম ও মৌলভীবাজার জেলার অনুষ্ঠান পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ফেঞ্চুগঞ্জ ফরিজা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো.ময়ুব আলী , আলী আমজাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক বাবুল উদ্দিন খান ও একই বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল মতলিব সহ সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছে বলেছেন- সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২৩ অনুষ্ঠানটি সফল হয়েছে।