লন্ডনে জমজমাট আয়োজনে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো –গোলাপগজ্ঞ এওয়ার্ডস। গোলাপগঞ্জ স্যোশাল এন্ড কালচারাল ট্রাস্ট ইউকে’র উদ্যোগে (১০ ডিসেম্বর) রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বৃটেনের বিভিন্নস্থান থেকে আসা বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে তিন জনের হাতে এই সনদ ও সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়। মানবিক অবদান রাখায় গোলাপগজ্ঞের কৃতিসন্তান মানবাধিকার কর্মী ও নাট্যকার আবু তাহেরকে গোলাপগজ্ঞ এওয়ার্ডস দেয়া হয়েছে। বাকী দু’জন হলেন গবেষক ফারুক আহমদ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আখলু মিয়া।
আবু তাহের একজন ছড়াকার, নাট্যকার ও সংগঠক। জন্ম ১৯৬৮ সালের মে মাসে, সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার চন্দরপুর গ্রামে । পিতা মোহাম্মদ মুক্তার আলী ও মাতা মাসুমা খাতুন । তিনি স্থানীয় আল এমদাদ হাইস্কুল ও এমসি কলেজে লেখাপড়া করে ছাত্র অবস্থায় ১৯৮৭ সালে চলে আসেন যুক্তরাজ্যে। লন্ডনে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি একাউনটেন্সি ফার্মে একজন একাউনটেন্ট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন । মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে ১৯৯৯ সালে নিজের নামে চালু করেন “মাহি এ্যন্ড কোম্পানি” । সার্টিফাইড প্র্যাকটিসিং ফার্মটি শুরু থেকেই অত্যন্ত দক্ষতা, সফলতা ও সুনামের সাথে অ্যাকাউন্টিং সেবা চালিয়ে যাচ্ছে এই পেশায় তিনি ২০১১ সালে আইসিপিও থেকে সার্টিফাইড ফেলোশিপ অর্জন করেন ।
তিনি একজন নির্লোভ সমাজসেবী ও সংস্কৃতি কর্মী । পেশাদারিত্বের পাশাপাশি শিক্ষা, সাহিত্য ,সাংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান । বিলেতের কমিউনিটি সেবার পাশাপাশি তিনি দেশের অবহেলিত গরীব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। মেধাবী ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলের টিউশন ফি, বইপত্র ও স্কুলড্রেস বিতরণ করে থাকেন। এই জনহিতকর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তিনি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রয়াত মাতা মাছুমা বেগমের নামে ‘মাছুমা মেমোরিয়েল ট্রাস্ট’ গঠন করেন। এর ফলে দেশে অনেক সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থী সহযোগিতা পেয়ে থাকেন ।
আবু তাহের “ব্রিজ একাডেমি” নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক । ব্রিজ একাডেমি একটি নতুন উদ্যোগে নির্মিত ইংরেজি -মাধ্যম স্কুল । যেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক সুবিধা সহ নার্সারি থেকে স্ট্যান্ডার্ড ১২ (ইন্টারমিডিয়েট লেভেল) পর্যন্ত উন্নত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা। তাছাড়া তিনি চন্দরপুর আল এমদাদ ডিগ্রি কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ।
বেকার গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি টিফাইভ টেইলারিং ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি ফ্রি টেইলারিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছেন । বর্তমানে বুধবারীবাজার ও ফুলবাড়ি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠানের দুটি শাখা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে । গ্রামবাংলার শতশত মহিলা এই কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে ।
২০২২ ইংরেজি তে বন্ধুদের নিয়ে “ভিসন কেয়ার ফাউন্ডেশন” নামে একটি দাতব্য চিকিৎসা সেবা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের অবহেলিত, দুর্দশাগ্রস্ত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের চোখের সমস্যা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা আর সুরক্ষার জন্য কাজ করে থাকে এই সংস্থা । ইতোমধ্যে ১০০০ এরও বেশি লোক এখান থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন এবং অর্ধ শতাধিক লোকের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়েছে ।
আবু তাহের বিলেতের ‘সংহতি সাহিত্য সংস্থা’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি । ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সংহতি বিলেতের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে । সংহতি প্রকাশনার পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার মধ্যে নাটক, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে অনুষ্ঠান, মাসিক সাহিত্যের আড্ডা, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সাহিত্য সম্মেলন, সেমিনার, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি সংগঠনটির মূল কর্মের অংশ।
সংহতি বিলেতের লেখকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মত বাংলা একাডেমি অমর একুশের বইমেলায় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ যোগ্য। ২০০৮ সাল থেকে সংহতি আয়োজন করছে কবিতা উৎসব , সেই থেকে ইউকে এবং ইউরোপের কবিদের সম্মানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রদান করে আসছে সম্মাননা পদক।
এছাড়া তাঁর অগ্রণী ভূমিকায় বিলেতে গোলাপগঞ্জবাসীদের নিয়ে প্রথম “গোলাপগঞ্জ উৎসবের” সূচনা করেন । তিনি দুইবার এই উৎসবের এর মাধ্যমে গোলাপগঞ্জের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান করেছেন। উৎসবে নানা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ বাঙালি তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় এই উৎসব । যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ থেকে ৫০টিরও বেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই উৎসবে অংশ নেয় । আমাদের পূর্বপুরুষ যারা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ মাটিতে পা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমান ব্রিটিশ বাংলাদেশী তরুনদের মধ্যে বন্ধন স্থাপন করা এই উদ্যোগের মুল উদ্দেশ্য ।
ছোটবেলা থেকেই আবু তাহের লেখালেখি করে থাকেন । তাঁর বেশ কয়েকটি ছড়া ও নাটকের বই প্রকাশিত হয়েছে । তাঁর লেখা অসংখ্য মঞ্চনাটক বিলেতে এবং বাংলাদেশে মঞ্চত হয়েছে এবং তাঁর নির্মিত অনেক নাটক ও টেলিফিল্ম বিলেতে ও বাংলাদেশের টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে । এর মধ্যে তদবির, পদইবাবু, সম্বর্ধনা, মোল্লা ভিজিট, শোধ, বিয়ের ঘন্টা উল্লেখ যোগ্য ।
আবু তাহের সবসময় বাংলাদেশে একটি কেয়ার হোম নির্মাণের স্বপ্ন দেখে আসছেন । যেখানে বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করা হবে । তিনি ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের জন্য ২৫একর জমি কিনেছেন এবং তার একক প্রচেষ্টায় মাটি ভরাট সহ সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ শুরু করেছেন এবং বৃদ্ধদের জন্য বিভিন্ন রকমের ফলের বাগান ও খামার তৈরী করেছেন । প্রকল্প এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি শিক্ষা কেন্দ্রও স্থাপনের ইতিমধ্যেই কাজ চলছে।
সম্মাননা পেয়ে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে প্রতিক্রিয়া জানান ছড়াকার আবু তাহের, তিনি বলেন বরাবরই আমি প্রচার বিমুখ। কোনো সম্মাননা পাওয়ার আশায় জীবনে কিছুই করিনি। মানুষের কল্যাণে ও ভালবাসায়, আমিও আনন্দিত। এরপর ও আমাকে এ সম্মাননা দেয়ায় প্রথমে লাখো কোটি শুকরিয়া জানাই মহান আল্লাহর দরবারে। আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি গোলাপগঞ্জ স্যোশাল এন্ড কালচারাল ট্রাস্ট ইউকে’র সকল সদস্যদের।’
সমাজের জন্য যা কিছু ভালো, যা কিছু কল্যাণকর তাঁর সঙ্গী হতে চাই। তাঁর জন্য আমি কখনো একক প্রচেষ্টায় আবার কখনো বল্ধু বান্ধবদের সঙ্গী করে নিরন্তর জনহিতকর কাজ করে যাচ্ছি অবিরাম। এই মহৎকর্ম দ্বারা সমাজ আরো উপকৃত হবে।