ঘটনা এক : গত ঈদের দিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়ার পথে দেখি রেলওয়ে স্টেশনে একজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। বারবার তাকাচ্ছেন হাতের ঘড়ির দিকে। তখন ভোর তিনটা। আমাকে দেখে বললেন, ট্রেন ছাড়তে তো অনেক দেরি। বাসে সুইংডন যাওয়ার রাস্তাটা আমাকে একটু দেখিয়ে দিবেন? যুক্তরাজ্যে এসেছি মাত্র দুই মাস হলো। আসার পর প্রবাসে প্রথম রমজান মাস পেলাম। রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতে ত্রিশটা রোজা কোনদিকে শেষ হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। গত রাতে জানতে পারলাম, আজকে ঈদ। ঈদের দিনটা লন্ডনে বন্ধুদের সাথে কাটাতে চেয়ে মালিকের কাছে ছুটি চাইলাম। মালিক ছুটি দিলো না। বললো, ‘এগারোটার ভেতরে সব কাজ শেষ করে যদি যেতে পার যাও। তবে সকাল ছয়টার ভেতরে তোমাকে ফিরে আসতে হবে। ফিরে এসে তোমাকে সেফের জন্য পেঁয়াজ কেটে রাখতে হবে, পিকল চাটনি রেডি করতে হবে। তারপর সেফ আসলে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে তোমাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কাস্টমার সার্ভ করতে হবে। আমি কাল আসবোনা। তোমাদেরকে চালিয়ে নিতে হবে।
মালিকের কথা শুনে আমি এগারোটার ভেতরে সব কাজ শেষ করে কোনোরকমে পুরাতন শার্ট আর প্যান্ট পরে ট্রেনে চেপে লন্ডনে আসলাম। লন্ডনে এসে শুনলাম ঈদের নামাজ সকাল সাতটায়। সকাল সাতটার আগে কোন জামাত নাই। কাজ শেষ করে জার্নি করে এসে আমার পুরো শরীর তখন ব্যাথা করছে। মন চাইছে, একটু ভালোভাবে ঘুমাই। কিন্তু দুইটা বাজতে না বাজতেই মালিক বার বার ফোন দিচ্ছে, দেরি যেনো না হয়, যেনো তাড়াতাড়ি কাজে যাই, যেনো ছয়টার একটু আগেই যাই। তাই রাতে না ঘুমিয়েই চলে এসেছি। দেশে থাকতে ঈদের আগের দিন আমি কেনাকাটা করতাম। ঈদের দিন নতুন জামা কাপড় পরে কত আনন্দ করতাম, কত হৈ চৈ করতাম। দেশের সেই ঈদের আনন্দের দিনগুলি বারবার মনে পড়ছে। যখন ঈদের দিন নামাজ পড়ে বেড়াতে বের হতাম, তখন ঘরে ঘরে কত আদর আপ্যায়ন পেতাম। এ বলে সেমাই খাও-সুজি খাও; ও বলে পোলাও খাও-কোরমা খাও! কতো অপরিচিত জায়গায়ও এই রকম জোর করে করে খাইয়েছে, কিন্তু আজ প্রবাস জীবনে নিজের মালিকও বলেনা- আজ ছুটি, যার যেখানে খুশি যাও, যার যা মন চায় খাও।‘
বলতে বলতেই তার গলা ধরে এলো। আমি তার চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। এর মাঝে দেশ থেকে তার মা ফোন দিয়েছে। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছে- ঘুম থেকে উঠেছিস, তোদের ওখানে নাকি আজকে ঈদ, ঈদের কেনাকাটা করেছিস, তুই কেমন আছিস বাবা, ভালো আছিস? চোখের পানি মুছতে মুছতে সে তার মাকে বলছে, “হ্যাঁ, আমি ভাল আছি। আমি ভালো আছি মা।”
ঘটনা দুই : পূর্ব লন্ডনের এক গ্রোসারী শপে কাজ করেন মইন আলী। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করেন, একদিন বাসায় থাকেন। বাসায় ছুটির দিনটা তিনি সংসারের টুকটাক কাজ সেরে বউ বাচ্চাকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে বের হন। পার্কে ঘুরতে গিয়েই একদিন দেশ থেকে খবর পেলেন যে, তার একমাত্র ছোট বোনের জন্য বিধবা মা ভালো একজন পাত্র খুজে পেয়েছেন। বিয়ে ঠিক হতে পারে ভেবে মইন আলী মালিকের সাথে কথা বলে দশ সপ্তাহ টানা সাত দিন কাজ করে দশ দিনের ছুটি জমিয়েছেন। এরইমধ্যে দেশে ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় বউ বাচ্চাকে আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়ে ঈদের দুই দিন আগে তিনি দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। দেশে গিয়ে সবার সাথে ঈদ করবেন ও ঈদের পরদিন বোনের বিয়ের কাজ সেরে আরও দুই দিন থেকে বউ বাচ্চাকে নিয়ে চলে আসবেন। পরিকল্পনামত আগের দশ দিনের সাথে বাড়তি আরও দুই দিনের ছুটি চেয়ে মালিকের কাছে আবেদন করে বউ বাচ্চাকে তিনি দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একদিকে ছোট বোনের বিয়ে, আরেকদিকে ঈদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যাকুলতায় তার চোখে-মুখে আনন্দের ছটা। খুশিতে তিনি টিকিট বুকিং দিয়েছেন। এদিকে গ্রোসারী শপ মালিক প্রথমে রাজি হলেও পরে স্টাফ সংকট, ঈদের দিন শপ বিজি থাকবে, কোন রিপ্লেসমেন্ট পাচ্ছেন না ইত্যাদি বলে বেঁকে বসলেন। তিনি ঈদের দুই দিন পর থেকে মইন আলীকে ছুটি নিতে বললেন। অনেক চেষ্টা করেও ঈদে ছুটি মিললো না মইন আলী’র। খুব মন খারাপ হলো তার।
বাড়িতে কীভাবে জানাবেন যে একমাত্র ছোট বোনের বিয়েতে ও সবার সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে যেতে পারছে না তিনি! বাড়ির সবাই আশা করেছিলেন, ঈদের আগেরদিন হলেও মইন আলী বাড়িতে যাবেন। একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে, মইন আলী কিছুতেই না গিয়ে পারবেন না। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত মইন আলী যেতে পারলেন না। ঈদের দিন তিনি নিজেই ছুটি পেলেন না। ঈদের পরদিন তার ছোট বোন ও ছোট্র মেয়েটার অস্পষ্ট কথাগুলো শুনে তার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেলো। মইন আলী ছোট বোন ও ছোট্র মেয়েটার কথা শুনছিলেন আর হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছিলেন। আমি ফোন করতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলছিলেন, খুব মিস করছি সবাইকে। খুব মিস করছি আমার ছোট বোনটাকে। বিয়েতে পারলাম না নিজের হাতে তাকে শপিংটা করে দিতে। ঈদে পারলামনা আমার ছোট্র মেয়ে আর ছোট বোনটার ছোট ছোট আবদারগুলো পূরণ করতে।
আমরা যারা যুক্তরাজ্যে বা প্রবাসে থাকি তাদের বেশির ভাগেরই ঈদের গল্পগুলো প্রায় একইরকম। অথচ ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই উৎসব। ঈদ আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, পারিবারিক মিলনের উৎসব, সামাজিক মিলনের উৎসব, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। বছরের এই একটি সময়ে সবাই একত্রে মিলিত হন এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন বলে এই উৎসবের মধ্যে নানা পারিবারিক ও সামাজিক কাজও সম্পন্ন হয়ে যায়। যেমন- বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য অনেক সময় দুর হয়ে যায়। আবার জমিজমা সংক্রান্ত নানা সমস্যা বা পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য ঝামেলাও অনেক সময় মিটে যায়।
কিন্তু যুক্তরাজ্যে বা প্রবাসে ঈদ মানে বেদনা, ঈদ মানে যন্ত্রণা। কারণ মুসলিম প্রধান দেশ না হওয়ায় এখানে ঈদের দিন সরকারি বা বেসরকারি কোন ছুটি থাকে না। এমনকি মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও ঈদের দিন বন্ধ রাখে না। কর্মস্থলের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতভাবে ছুটি নিতে হয়। রেস্টুরেন্ট ও গ্রোসারী শপের মত কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আবার চেয়েও ছুটি পাওয়া যায় না। ঈদের দিনেও কাজ করতে হয়। মালিক যদি দয়াবান হয় তবে কয়েক ঘন্টার জন্য ছুটি নিয়ে ঈদের নামাজ শেষ করে আবার কাজে দৌড়াতে হয়। অল্প কিছু মানুষের কাছে এখানে ঈদ আনন্দের হলেও অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে ঈদ মানেই কান্না। সারা বছরের জমিয়ে রাখা কান্নার বাধভাঙা স্রোত যেন ঈদের দিন আর কোনো বাধা মানতে চায় না। এভাবেই কেটে যায় যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের ঈদ নামের কষ্টের দিনটি।
এদেশে জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলোর ঈদ উদযাপন দেখলে আমার আরও বেশি খারাপ লাগে। এদেশে জন্ম নেয়া বাচ্চারা ক্রিসমাসে তাদের বন্ধু বান্ধবদের বাবা-মা, ভাই-বোন ও পরিবারের সকলকে নিয়ে উৎসব করতে দেখে এবং আনন্দগুলোকে ভাগ করে নিতে দেখে। কিন্তু নিজেদের ঈদ উৎসবের সময় বাবা-মায়ের ছুটি না থাকায় তারা একাকিত্ব আর বিষন্নতায় ভোগে।
আমি সুইংডনের সেই রেস্টুরেন্ট মালিকের ভিজিটিং কার্ড দেখে যেমন তাকে চিনেছিলাম। তেমনি পূর্ব লন্ডনের সেই গ্রোসারী শপের মালিককেও আমি চিনেছিলাম এবং তাদের দুজনের সাথেই এই ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, আপনারা অনেক চ্যারিটি ওয়ার্ক করছেন, ‘চ্যানেল এস’ এর ফান্ড রেইজিং আপিলে হাজার হাজার পাউন্ড দান করছেন। বিয়ানীবাজারে অত্যাধুনিক একটা ক্যান্সার হাসপাতাল করে ফেলেছেন। ঈদের এই একদিন আপনাদের রেস্টুরেন্ট ও শপ বন্ধ রাখলে আমার মনে হয় আপনাদের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। বরং আপনাদের স্টাফদের যদি আপনারা ঈদের দিনটা পেইড হলিডে দেন তাহলে তারা যে দোয়া করবেন, সেই দোয়ার বদৌলতে দুনিয়া এবং আখিরাত এই দুই জায়গাতেই আপনারা লাভবান হবেন।
তারা বলেছেন, ইংলিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তো এখানে বন্ধ রাখে না। আপনি আগে ইংলিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলেন। আমি বলেছিলাম, আমাদের ধর্মীয় উৎসবে আমরাই যদি না করি, তারা কেনো করবেন! আগে আমাদের করতে হবে, তারপর তাদের কাছে দাবী করতে হবে। আমাদেরকে করতে দেখলে তারাও তখন করবেন, আমাদের দাবী মানবেন। আমার কথা শুনে তারা বলেছেন, সকল বাঙালি রেসটুরেন্ট ও গ্রোসারী শপ মালিকদের সাথে কথা বলেন। সবাই করলে আমরাও করবো। দেখা গেলো আমি বন্ধ রাখলাম, আমার নেক্সট ডোরের জন খোলা রাখলো, তাহলে তো হলো না।
তাদের কথা শুনে আমি তখন ভেবেছিলাম, গ্রেইট বেঙ্গলের পক্ষ থেকে এটা নিয়ে একটা সামাজিক আন্দোলন শুরু করবো। প্রায় ২০ বছর আগে সাপ্তাহিক সুরমা ঈদের দিন ছুটি নিয়ে একটা এওয়ারনেস প্রোগাম শুরু করেছিলো। মাঝখানে কেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, জানিনা। সুরমাকে সাথে নিয়ে এটা আবার শুরু করতে হবে। আমি যখন এসব ভাবছিলাম, ঠিক এর মাঝেই দেখলাম সাপ্তাহিক পত্রিকা ও ৫২বাংলা’র উদ্যোগে একটি যৌথ সামাজিক আন্দোলন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমি এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। এই মহতী আন্দোলন সফল হোক, স্বার্থক হোক এই কামনা করছি। ঈদের দিন আমাদের সকল বাঙালি ও মুসলিম মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার অনুরোধ করছি এবং এই দাবী পূরণে রেস্টুরেন্ট ও শপ মালিকদের সদিচ্ছাই যথেষ্ঠ বলে মনে করছি। আগামী ঈদ আমাদের সবার জন্য অনেক বেশি আনন্দের হোক। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক।
মুহাম্মদ এ এইচ খান : গবেষক, এডিটর ইন চীফ, দ্যা গ্রেইট বেঙ্গল টুডে