প্রিয় নাহিদ,
‘তুমি চলে যাওয়ার পর পৃথিবী যে কতবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে , সুরমা-কুশিয়ারা দিয়ে কত জল গড়িয়ে বঙ্গপসাগরে মিশেছে । কত হাজার বার বাঁশবাগানের মাথার ওপর উঠেছে ধবল পূর্ণিমার চাঁদ ! কতবার দুষ্টছেলের দল নেচেছে প্রিয় জেমসের কনসার্টে । কতবার গ্রাম -বাংলায় এসেছে নৌকা বাইচের আনন্দ। কাদামাখা মাঠে ফুটবল খেলতে গেছে কিশোর-যুবার দল। তোমার প্রিয় দক্ষিণের মাঠে হয়েছে কত শ্বাসরোদ্ধকর ক্রিকেট ম্যাচ। হয়েছে ওয়াজ মাহফিলের রঙ্গিন বাজার !
তোমার কি মনে পড়ে ভরা বর্ষায় ‘বাসুদেবের রথযাত্রা’- অসাম্প্রদায়িক বাংলার অন্যতম এক বর্ণিল উৎসব !
আমার জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি খুব মিস করো-শীতের সকাল। রাতের শিশির , ঢাহুকের ডাক,শরতের আকাশ,কোয়াশা ভেজা ভোর ,রোদেলা দুপুর ,শাপলা ফুল । দুয়েল-শালিক মাঘের কোকিল; ছোট চুড়ুই,আষাঢের মেঘ ,বউ কথাকও পাখি ,রাখালি বাঁশি , রূপালী ইলিশ ,দুর্বাঘাসের মাঠ ,আউশের ক্ষেত,কুমড়ো ফুল ,লাউয়ের মাচা ,মায়ের উঠান !
প্রিয় নাহিদ ,তুমি কি এমন মহাঅপরাধ করেছিলে যে,রাষ্ট্রের বেতনভোগী পুলিশ দরিদ্র জনগণের টাকায় কেনা গুলির টার্গেট বানালো তোমার সদ্য কৈশর উত্তীর্ণ দেহ কে ? কত চোর-বাটপার,ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী পুলিশের নাকের ডগায় দিব্যি ঘোরে বেড়ায় ! অথচ সেদিন গুলির নিশানা হলে তুমি!
তুমি আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতে ।তুমি শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে। তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সূর্যসৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে ।
তোমার অপরাধ ছিল- তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদকারী এক নির্বিক সৈনিক । তুমি শহীদ জি সি দেব আর মনু মিয়ার জাতভাই ,তুমি নানকার বিপ্লবের বিদ্রোহী আত্মা হয়ে ছিলে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ ।
দুঃখ করো না প্রিয়ভাই আমার !এই দেশেরই কিছু অমানুষ তাদের জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল রাষ্ট্রের টাকায় কেনা গুলির আঘাতে।
প্রিয় নাহিদ ,আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ,১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সেই নিষ্ঠুর বিকেলে তোমার গুলিবিদ্ধ শরীর থেকে যখন অঝর ধারায় ঝরছিল তাজা রক্ত ,তখন কি শেষ বারের মত গর্ভধারিণী মায়ের প্রিয় মুখ দেখার জন্য যন্ত্রনায় ফেঠে যাচ্ছিল বুক ?তোমার আদরের চোট ভাই ,খেলার সাথী, বোন -ওদের মায়াভরা মুখ ;তোমার কি চোখে ভাসছিল?
প্রিয় নাহিদ তুমি কি জানো , তোমার সময়ের দুধের শিশুটিও এখন যুবক-যুবতি ।তুমি যান কি তোমার কিশোরী প্রেমিকা এখন আর লাজুক কিশোরী নয় ! যার গভীর কালো চোখে তুমি খোঁজে ছিলে সুখের ঠিকানা। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সে নীরবে অশ্রু মোছে আঁচলের কোনায়।
প্রিয় নাহিদ, তোমার এই আত্নদান একেবারে বৃথা যায়নি ।তুমি জীবন দিয়েছ- তাই প্রতিক্রিয়াশীলতার বদ্ধভূমি থেকে উঠে দাড়াবার সাহস পেয়েছে বাংলাদেশ ।তুমি জীবন দিয়েছ তাই বঙ্গবন্ধু কন্যা তিনবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।পার্বত্য শাস্তি চুক্তি হয়েছে ,গঙ্গার পানি চুক্তি হয়েছে, দেশের ছিটমহল বাসির ৭০ বছরের আহাজারি অবসান হয়েছে ,বার্মার বিপক্ষে সমুদ্র বিজয় হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ । রোহিঙ্গা স্বরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ ।পদ্মার বুকে প্রায় অসম্ভব সেতুটি ও এখন আর স্বপ্ন নয় বাস্তবতা !মেট্রোরেল চালু হলে যানজটের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে ঢাকা শহর ।
বিদ্যুতায়িত হচ্ছে দেশ ।পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তো এখন সময়ের ব্যাপার ! মানবতা বিরোধী অনেকের শাস্তি নিশ্চিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে । বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পাচ্ছেন,বৃদ্ধ ভাতা,বিধবা ভাতা,স্বামী পরিত্যাক্ত ভাতা, পঙ্গু ভাতা নিশ্চিত হয়েছে। বছরের প্রথম দিনে শিশু-কিশোরদের হাতে পৌছে যাচ্ছে নতুন বই !
সুজলা-সুফলা- শ্যামল বাংলাদেশ এখনো জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়নি ।বিদঘুটে আলখিল্লায় পুরোপোরি ভরে যায়নি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের বাংলাদেশ । তুমি জীবন দিয়েছ তাই রাজাকার কমান্ডারের গাড়িতে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা দেখার যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে না । বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উচু করে দাড়াবার স্বপ্ন পূরণে হাটছে সাহসে ও প্রত্যয়ে।
প্রিয় ভাই আমার ,তোমার এই আত্নদানে হয়ত অনেকেই অনেক কিছু পেয়েছেন ।যোগ্যদের মাঝে অনেক অযোগ্যও জায়গা করে নিয়েছে । নিয়মের মাঝে হয়তো কিছু অনিয়মও আছে ।তারপরও বলি ,-তুমি জীবন দিয়েছ তাই বাংলাদেশ আজ জঙ্গিবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত উন্নয়নের এক রোল মডেল !
ইতি
সেদিনের সংগ্রামে ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া
তোমার সহযোদ্ধা ভাই ।
ফজলে রাব্বি সেবুল : নিউ ইয়র্ক , যুক্তরাষ্ট্র