সেবার মান আগের থেকে আধুনিক হলেও উপজেলা নির্বাচন অফিস গুলোর লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অধিকাংশ উপজেলা নির্বাচন অফিসের বিরুদ্ধে নাগরিকদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। তবে থানা নির্বাচন অফিস দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে প্রবাসী ভোটাররা ৭ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাবেন বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এ বিষয়ে ইসি সূত্রে জানা যায়, প্রবাসীদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র কম সময়ের মধ্যে প্রদানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের আগারগাঁও হেড অফিসে আলাদা শাখা খোলা হয়েছে। একদিনের মধ্যে ছবি তোলাসহ প্রাথমিক সব কার্যক্রম শেষ করে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য থানা নির্বাচন অফিসে আবেদনটি পাঠানো হয়। উপজেলা নির্বাচন অফিস দ্রুত প্রতিবেদন পাঠালে হেড অফিস ভোটারকে এনআইডি কার্ড দিয়ে দেয়।
এছাড়াও সরাসরি উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়েও প্রবাসীরা ভোটার হতে পারেন। কিন্তু এ দুই প্রক্রিয়াতে উপজেলা নির্বাচন অফিসের কাছে অধিকাংশ নাগরিকরা জিম্মি হয়ে দিনের পর দিন ঘুরছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তদবির না করলে উপজেলা থেকে দেওয়া হয়না তদন্ত প্রতিবেদন। এভাবে মাসের পর মাস ঘুরতে হয় সাধারন মানুষকে।
এখানেই ক্ষান্ত নয় যদি কেউ নতুন ভোটার হতে উপজেলা নির্বাচন অফিসে গেলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে হয়রানি করা হয়। এমনকি এনআইডি অনান্য সেবা নিতে গেলেও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, ইসির হেড অফিসে এনআইডি সেবার মান আধুনিক হলেও মাঠ পর্যায়ে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। আমরা নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনেক সময় বাচানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যস্তবতা হচ্ছে দিন কে দিন দূর্নীতি বেড়ে চলেছে অধিকাংশ থানা নির্বাচন অফিসে। তবে কিছু কিছু থানা নির্বাচন কর্মকর্তা নাগরিকদের দ্রুত সেবা দেন।
সাম্প্রতি রবিউল ইসলাম নামে একজন প্রবাসী বাংলাদেশী সাউথ আফ্রিকা থেকে ইসির হেড অফিসে ভোটার হাওয়ার জন্য ছবি তুলে প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়ে যান। পরে হেড অফিস থেকে অনলাইনে নোয়াখালী বেগমগঞ্জ উপজেলা তদন্ত রিপোর্ট চাওয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর রবিউল উপজেলা নির্বাচন অফিসে নিজে গিয়ে অনুরোধ করেন তার প্রতিবেদন যেন দ্রুত দেওয়া হয়। কারণ তিনি ঐ মাসে শেষের দিকে আবার সাউথ আফ্রিকা চলে যাবেন।
কিন্তু দিনের পর দিন তাকে হয়রানি করা হয়। কখন বলা হয়, হেড অফিসে ডাক যোগে পাঠানো হয়েছে মাস খানেক সময় লাগবে। আবার কখন তাকে বলা হয়েছে আরও নতুন করে অনেক কাগজ লাগবে নয়ত প্রতিবেদন যাবে না। অবশেষে ওই নির্বাচন অফিস থেকে অনৈতিক দাবিও করে বসে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এভাবেই বিভিন্ন তাল বাহনা করে তাকে হয়রানি করা হয়।
দীর্ঘদিন পর এক পর্যায়ে ইসির একাধিক বড় কর্মকর্তাকে দিয়ে ফোন করে তদন্ত পতিবেদন এনে ভোটার কার্ড পান সাউথ আফ্রিকান প্রবাসী বাংলাদেশী রবিউল ইসলাম। ইসির হেড অফিসের সৎ ইচ্ছা থাকলেও থানা অফিসের অসাধু কিছু কর্মকর্তার কারণে এনআইডি সেবা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। দেশের জন্য শ্রম দেওয়া প্রবাসী নাগরীকরা প্রতি নিয়ত বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচন অফিসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
এদিকে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা থানা অফিসে মাসুদুর রহমান নামের এক নাগরিককে হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া যায়। তার সমস্যা ছিলো এনআডিতে একটি অক্ষর ভুল আসে। তার বাড়ি পাথরঘাটা উপজেলায় হলেও তিনি ঢাকা থাকেন। এনআইডি একটি অক্ষর সংশোধনের জন্য তিনি ঢাকা থেকে পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাচন অফিসে যান। এসএসসির সার্টিফিকেট, জন্মসনদ ও নাগরিক সার্টিফিকেট থাকলেও তার অবেদন গ্রহণ করা হয়নি। তাকে অনেক ধরণের কাগজ আনতে বলা হয়। অথচ নামের একটি অক্ষর সংশোধনের জন্য এসএসসির সার্টিফিকেট ও জন্মসনদ থাকলে আবেদন জমা নেওয়ার কথা। ঢাকা থেকে কম সময় নিয়ে পাথরঘাটা গিয়েছেন মাসুদুর রহমান। অনান্য কাগজ সংগ্রহ করতে সময় লাগবে এ কারনে অবেদনটি জমা নিতে অনুরোধ করেন তিনি। কিন্তু আবেদন জমা না নিয়ে এক পর্যায়ে সরাসরি অবৈধ প্রস্তাব দিয়ে বসেন থানা নির্বাচন অফিসের একজন পিয়ন। পরে মাসুদুর রহমান এনআইডি সংশোধনের অবেদন জমা না দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। হেড অফিসে এসে তার এনআইডির দুই নাম্বার ফরম উত্তলন করে দেখেন। তিনি ভোটার হওয়ার সময় সঠিকটা লিখেছিলেন কিন্তু টাইপের সময় একটি অক্ষর ভুল করেছিলন ইসির অপরেটররা। পরে হেড অফিসে একদিনের মধ্যে সংশোধিত কার্ড পান মাসুদুর রহমান।
তবে সাম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংক্রান্ত সব ধরনের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দেশের নির্বাচন কমিশন অফিসগুলোতে কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে গেলে তাদের হয়রানি না করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে ইসির এনআইডি অণুবিভাগের সহকারী পরিচালক আরাফাত আরা স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ওই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ইদানিং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে মাঠ পর্যায়ে এনআইডি সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে সেবাপ্রার্থীকে যথাযথ সেবা প্রদান করা হচ্ছে না। সেবাপ্রার্থীকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বা সেবা প্রদানে অহেতুক গড়িমসি বা দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। এনআইডি সংক্রান্ত কোনো আবেদন প্রার্থী নতুন অন্তর্ভু্ক্তি (নতুন ভোটার হওয়ার আবেদন), এনআইডি সংশোধন, কর্তন বা স্থানাস্তর বিষয়ে সেবার জন্য অফিসে আসলে তাকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের চেষ্টা করতে হবে। সেবাপ্রার্থী যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়, বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
নির্দেশনাটি বাস্তবায়নের জন্য তিনটি করণীয় নির্ধারণ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এগুলো হলো:-
১. জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধন সেবা পেতে কোনো ব্যক্তি আবেদন করলে তা প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টসহ ৩ দিনের মধ্যে সার্ভারে আপলোড করে চেক বাই উপজেলা করে দিতে হবে। আবেদনকারীর কাছে বারবার ডকুমেন্ট চাওয়া যাবে না। আবেদনকারীর প্রত্যাশিত সেবা অনুযায়ী যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন তা সুস্পষ্টভাবে উ করে স্বাক্ষরিত পের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার কাছে দিতে হবে। ভিবিআরএস কার্ড ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারটিতে কোনো আবেদনকারীর কাছে নোটে কোনো ডকুমেন্ট চাওয়া হলে তা আবেদনকারীকে দ্রুত জানাতে হবে।
এছাড়া তদন্তে থাকা আবেদন দ্রুত তদন্ত করে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবেন। অন্যথায় আবেদনকারীর পক্ষে জানা সম্ভব নয় তার আবেদনটি কী অবস্থায় আছে এবং সেবা থেকে বঞ্চিত হবে ও ভোগান্তির শিকার হবে।
২. নতুন অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উপজেলা থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যাচাই বাছাই করে জেলায় পাঠাতে হবে এবং জেলা হতে প্রিন্ট করে সাত দিনের মধ্যে ভোটারের কাছে পৌঁছাতে হবে।
৩. উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তার অফিসের কর্মচারীরা কিভাবে মানুষকে সেবা দিচ্ছে এবং এ বিষয়ে কত সময় নিচ্ছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনিটর করবেন। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা নিজের অফিসের পাশাপাশি তার আওতাধীন উপজেলা নির্বাচন অফিস মনিটর করবেন এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা অফিস এবং তার আওতাধীন জেলা নির্বাচন অফিসগুলো মনিটর করবেন।
মাঠ পর্যায়ে উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারাই এনআইডি সেবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু অনেক আবেদনেই দীর্ঘদিন পড়ে থাকে মাঠ পর্যায়ে। কারো আবেদন ফরোয়ার্ড করা হয় না। কাউকে আবার বারবার সময় দিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ আসছে বলে জানিয়েছে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।