ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে ব্রিটেন তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে এখন। গত দুবছরেও ব্রিটেনের পার্লামেন্টে এ নিয়ে কোন সুরাহা হয় নি। পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যদের একটা অংশ এখন এমনকি আবারও গণভোট চাইছেন। বার বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে তার বিল নিয়ে এসেছন এবং এমপিদের ভোটে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ ব্রিটেনের সংসদই কোন সিদ্ধান্তে পৌছুতে পারছে না, গত দুবছর থেকে। সিদ্ধান্তহীনতার কারনেই গত ১০ এপ্রিল আবার ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে ব্রিটেনকে। এবং ব্রেক্সিটের সময় বাড়ানো হয়েছে আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত।এটি দ্বিতীয়বার সময় পিছানোর ঘঠনা। প্রথম দফায় ২৯ মার্চ থেকে পিছিয়ে ১২ এপ্রিল করা হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছে দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এরকম রাজনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে পড়েনি ব্রিটেন।
ব্রিটেনের এই ক্রান্তিকালে কিভাবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবে দেশটি, চুক্তিগুলো কি হবে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে ব্রিটেন কি বাণিজ্যিক চুক্তি করতে গিয়ে হেরে যাবে। আসলেই কি হার্ড ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে ব্রিটেন। অর্থাৎ ইউরোপের সাথে কোন যুক্তিসঙ্গত চুক্তি ছাড়া কিংবা কোনপ্রকার চুক্তি ব্যতিরেকেই কি বেরিয়ে আসতে হবে ব্রিটেনকে।
নাকি সফট ব্রেক্সিটের চুক্তিতে ব্রিটেন আবদ্ধ করতে পারবে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকে। প্রধানত ইউরোপীয়ান অর্থনৈতিক জোন ও ইউরোপীয়ান ফ্রি ট্রেড এসোসিয়েশনের সদস্য দেশগুলো সিঙ্গল মার্কেট নীতির আওতাভুক্ত। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ হিসেবে বর্তমানে ইউরোপের ২৮টি দেশ এ সুবিধার মাঝেই চুক্তিবদ্ধ আছে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বাইরে থেকে একমাত্র নরওয়ে সীমাবদ্ধ চুক্তির মাঝ দিয়ে হলেও এই সুবিধা নিচ্ছে। এই সুবিধায় পৃথিবীর অন্যন্য দেশেও বাণিজ্যিক সুবিধা নিচ্ছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নরওয়ে মৎস্য এবং কৃষি খাতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দেশ। দেশটি ঐ খাতগুলোর জন্য আমদানী রপ্তানীতে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে। ব্রিটেনও চাইছে তারাও কিছু গুরুত্বপূর্ন বণিজ্যিক খাতে এভাবেই বিশেষ সুবিধা ভোগ করার চুক্তি, যা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথেও বাণিজ্যিক সুবিধা কাজে লাগাতে পারবে রাষ্ট্রটি। সফট ব্রেক্সিটে ব্রিটেন চাইছে, সীমান্তে তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এছাড়া আছে বেকস্টপ, যেটা একটা প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবেও কাজ করছে । নর্দান্ড আয়ারল্যান্ড এবং রিপাবরিক আয়ারল্যান্ডের মাঝে সীমান্ত নীতিমালা নিয়ে বিতর্কটাই মুলত বেকস্টপ। এই বেকস্টপ বিতর্কটা আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ব্রেক্সিট সমঝোতায়। কারন নর্দান্ড আয়ারল্যান্ডের সাথে বাণিজ্যিক ব্যাপারটা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
একইভাবে শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা পেতেই ব্রিটেন চাইছে কাস্টম ইউনিয়নের নীতির সুবিধাটাও। গোটা বাণিজ্যিক আদান প্রদান ব্যাবসায়িক ট্যারিফ কিংবা নীতিমালা মুলত প্রনয়ন করে থাকে কাস্টমস ইউনিয়নই। সুতরাং বলতে গেলে, কাস্টমস ইউনিয়ন কিংবা সিঙ্গল মার্কেটই গোটা ব্রেক্সিটের মূল আলোচনার বিষয়। অথচ ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এ নিয়ে মতৈক্যে পৌছাতে পারছে না। বার বার প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন, ব্রেক্সিট ডিল নিয়ে তিনি বিরোধী দলতো বটে, এমনকি তাঁর দলের এমপিদের বিরোধীতার মুখে পড়েছেন, পার্লামেন্টে তার দলের এমপিরাই তার বিপরীতে ভোট দিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবে তাই ইউরোপীয়ান ইউনিয়নও এ সুযোগে ছাড় দিচ্ছে না ব্রিটেনকে। তারা চাইছে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ হোক হার্ড ব্রেক্সিটের মধ্যি দিয়েই।
অথচ ব্রিটেন যখন বিচ্ছেদ নিয়ে জনগণের মুখোমুখি হয়েছিলো ২০১৬ সালে, তখন জনসম্মুখে এ ইস্যুগুলো রাজনীতিবিদরা তোলে ধরতে পারেন নি। কিংবা সচেতনভাবেই তোলে ধরেন নি। ব্রেক্সিট পন্থিরা শুধুই জনগণকে দেখিয়েছেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সাথে ব্রিটেনের একীভূত থাকায় ব্রিটেন বছর বছর মিলিয়ন-বিলিয়ন পাউন্ড গচ্ছা দিচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে কি নিয়ে আসছে, বাণিজ্য করতে গিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু পাচ্ছে, তার বিস্তারিত তারা তোলে ধরেন নি। তারা শুধুই বিচ্ছেদ চেয়েছেন। সামনে এনেছেন তখন কিছু সমসায়িক ইস্যু, যা তারা জনসাধারনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বানের পানির মতো আসা ইউরোপের লোকগুলোতে ভর্তি হতে থাকে ব্রিটেন। ব্রিটেনের সহজ পদ্ধতিকে এরা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের সামাজিক অনুদান (অর্থনৈতিক বেনিফিট), ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। বিশেষত ইষ্টার্ন ইউরোপ থেকে আসা গ্রীস, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশের মানুষে সয়লাব হযে যায় গোটা দেশ। বাংলাদেশ-পাকিস্থানের একটা বড় ইউরোপীয়ান জনগুষ্টিও বিশেষত ইটালী,স্পেন,পর্তুগাল থেকে এই সুযোগে ব্রিটেনে এসে বসবাস শুরু করেছেন। তাদের সবাই এদেশের অর্থনৈতিক সুযোগকে ব্যবহার করছেন, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। অন্যদিকে এদের মাঝে কেউ কেউ স্পেন-ইটালী কিংবা ইউরোপের অন্যান্য দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক সুবিধাটুকুও এ দেশে বসেই ভোগ করছেন। আইনের ফাকফোকর ব্যবহার করে এও এক ধরনের অপরাধ, দু রাষ্ট্রের কাছ থেকেই অনৈতিক লাভালাভ। যা নিয়ে কেউ কেউ ইতিমধ্যে দন্ডিত হচ্ছেন। এসব বিষয়কেই ব্রেক্সিট পন্থি নেতা তৎকালিন ইউকিপ পার্টির নাইজেল ফারাজ কিংবা টোরী পার্টির বরিস জনসনরা সামনে এনেছিলেন অত্যন্ত চতুরভাবে, এবং বলতেই হয় তারা সার্থকতাও পেয়েছেন। মূলধারার রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ নেতারাই ব্রেক্সিট চাননি। তাই তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ডেবিড ক্যামেরুন, আজকের বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবীন সহ দেশের সংখ্যাগরিস্ট রাজনীতিবিদ ব্রেক্সিটের বিরোধীতা করেছেন। তারা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে থাকার পক্ষেই তাদের ক্যম্পেইন চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা হেরেছেন।
ব্রিটেনের সাধারন মানুষ বিশেষত মধ্যবিত্ত এবং শ্বেতাঙ্গ জনগুষ্ঠির একটা বিশাল অংশ বিদেশীদের হুট করে ব্রিটেনে আবাসন গড়াকে ব্রিটেনের জন্য এক বিশৃংখল অবস্থা হিসেবেই বিবেচনা করেছে, যা তারা মেনে নিতে পারে নি। কারন ইউরোপীয়ান জনগুষ্ঠির কারনে স্কুলে আসন সংকট দেখা দেয়,আবাসন সংকট বৃদ্ধি পায়, কিছুটা হলেও অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। একটা ধারনা তৈরী হয়েই যায়, এদের কারনেই দেশে বেকারত্বও বেড়েছে। সেজন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিস্ট সংসদ সদস্যদের ব্রেক্সিট সমর্থন না করা সত্তে¡ও ব্রিটিশ জনগণের অধিকাংশ ভোটার বিচ্ছেদের পক্ষেই ভোট দেয়। বিচ্ছেদের বিপরীতে অবস্থান নেয়া তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার হার মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এমনকি রাজনীতি থেকেই বলতে গেলে তিনি অন্তর্হিত হয়ে আছেন।
সেই থেকেই সংকট শুরু। ব্রিটেনের এই বাস্তবতায় মাত্র কদিন আগে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ ব্রেক্সিটের বিপক্ষে লন্ডনে মিছিল করেছে। তারা এমনকি নতুন গণভোটের দাবীও তোলেছে তাদের মিছিলে। কিন্তু মিছিলের মানুষ যাই বলেন না কেন, ইতিপূর্বে অর্থাৎ দুবছর আগে ব্রিটেনের গনভোটে প্রদত্ত ভোটের ৫৩ শতাংশ মানুষ ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সুতরাং চাইলেই কি মানুষগুলোর ম্যান্ডেটকে অবজ্ঞা করতে পারবেন রাজনীতিবিদেরা কিংবা তেরেসা মে‘র সরকার। আর এটাতো গনতান্ত্রিক নীতি-নৈতিকতার মাঝেও পড়ে না। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘রাজনীতি কোন খেলা নয়’। অথচ ব্রিটেনের চলমান সংকট এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, মনে হচ্ছে ব্রিটেনের রাজনীতিবিদরা আসল খেলাই খেলছেন। জনগণের আবেগ-অনুভ’তি-আকাংখা এমনকি ব্রিটেনের রাজনীতির মজবুত ভিত গনতন্ত্রকে নিয়েই যেন তারা খেলছেন। তা না হলে তারা কিভাবে আরেকটা গনভোটের জন্য ব্রিটিশ জনগুষ্ঠিকে উসকে দেন। বিগত গনভোটে রাজনীতিবিদরা জনগণের দ্বারা যেভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, ব্রিটিশ জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যানের শোধ যদি তারা নিতে চান এই সুযোগে, তাহলে রাজনীতিবিদরা হয়ত আরেকটা ভুলের দিকেই আগাতে থাকবেন। কারন ব্রিটেনের সম্প্রতি রাস্তায় নামা ব্রেক্সিট বিরোধী এই এক মিলিয়ন মানুষই সারা ব্রিটেন না। বরং গণভোটে ৫৩ শতাংশ মানুষের সাথে আরও যোগ হতে পারেন, এই আভাস আছে।
কি হতে পারে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ—ব্রেক্সিট হওয়াটাই হয়ত যৌক্তিক, কারন জনগণ তা-ই চেয়েছে। কিন্তু জনগনের সেই আস্থার জায়গাটা রাজনীতিবিদরা রক্ষা করতে পারছেন না। আর সেজন্যেই ব্রেক্সিটের পক্ষে রাতদিন নিরন্তর কাজ করা তেরেসা মে’র দলের জনপ্রিয়তা নেমে আসছে প্রতিনিয়ত। দেখা যাচ্ছে, আসন্ন ইইউ নির্বাচনে মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ কনজারভেটিভ প্রার্থীদের ভোট দেবে। লেবার দলকে দেবে ২৪ মতাংশ মানুষ। অন্যদিকে শুধুমাত্র ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে নবগঠিত দল নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি বিস্ময়করভাবে ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েই যাবে।
গনতন্ত্রের পথচলায় যদি নাইজেল ফারাজের দল একটা প্রধান ফ্যক্টর হয়ে বেরিয়ে আসে, তাহলে তা ব্রিটেনের রাজনীতির জন্য কোন ইতিবাচক ঈঙ্গিত নয়। কারন নতুন দল গঠন করে ইউকিপ ত্যাগ করার সময় নাইজেল ফারাজের গড়া ইউকিপকে তিনি নিজেই বলেছেন, সেখানে ডানপন্থিরা ভর করেছে। আর সেজন্য ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে ধারন করেই ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিকেও সেই ডানদের যে কোন এগিয়ে যাওয়াকে রুখতে হবে।
২৩মে থেকে ২৬ মে অনুষ্ঠিতব্য ইইউ নির্বাচনে ব্রিটেন যাতে অংশ না নিতে পারে, সেজন্য তেরেসা মে এর আগেই ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘঠাতে চান। আদৌ কি পারবেন ? উত্তরটা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের হাতেই। কারন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের মতৈক্যই ব্রিটেনের এই লেজেগোবরে অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই দুঃসময় থেকে উত্তরনে সেজন্যে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক , প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।