যে যুদ্ধ করে আর যে যুদ্ধের বয়ান তৈরি করে- এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম, তারা তৈরি করা বয়ান দিয়েই তো যুদ্ধ, যোদ্ধা, ইতিহাসকে চিনেছি। তাহলে এই ফারাকটা ভরাটের পথ কী?
ঠিক এই জায়গাটা থেকেই একসময় ভাবি, যোদ্ধার প্রকৃত বয়ানটাই বোধহয় সেই ফারাকটা ভরাট করে দিতে পারে। একসময় যোদ্ধার বয়ান শোনা শুরু করি। সত্যিকার অর্থেই তখন অন্য এক যুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করি যোদ্ধার চোখে। সেই ঘোর আজও কাটেনি।
কিন্তু যোদ্ধাও তো মানুষ, সময়ের ব্যবধানে সেও নিজেকে যে পাল্টে ফেলেনি- তাই বা কে বলবে! তবু আজও মুক্তিযোদ্ধার, বীরাঙ্গণার, শরণার্থীর গল্প শুনি ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার মতো সরলতা, মুগ্ধতা আর শিহরণ নিয়েই।
সেই অচেনা, অজানা, অখ্যাত যোদ্ধা, যারা মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপ দিয়েছিল, তাদের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এই উত্তাল মার্চের দিনগুলোতে শুনাতে চাই ৫২বাংলায়।
প্রভারাণীর জীবনের কোনোকিছুই তার নিজের মতো করে হয়নি। শিশু বয়সে মাত্র ৫০০ টাকার লোভে বোনজামাই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করেছিলো। গরিব মায়ের মেয়ে প্রভার বয়স তখন ১৪/১৫; আর স্বামীর বয়স তখন ৬৫ থেকে ৭০। এ বিয়ে প্রভা চাননি।
বিয়ের মাত্র নয় মাসের মাথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়েছিলো প্রভাকে। স্বামীর ঘরে থাকা অবস্থায় যুদ্ধের পর তাঁর প্রথম সন্তান কাজলের জন্ম। সেই কাজল ছোটবেলা থেকে মানুষের কাছে শুনে এসেছে সে ‘পাঞ্জাবীর সন্তান’। তাঁকে প্রতিটি মুহূর্ত একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে, সে কার সন্তান? একদিনের জন্যও এটা বন্ধ হয়নি। এটাই সমাজ, বাস্তবতা। কিন্তু প্রভা এটা চাননি।
প্রথমবার পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রভারাণী চলে যান দূরে বোনের গ্রামে। সেখান থেকে একদিন সন্ধ্যায় হানা দিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় হানাদাররা। শমসেরনগর ডাক বাংলোতে সারারাত ধরে নির্যাতন চলে তাঁর উপর। একপর্যায়ে প্রভা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কাকডাকা ভোরের দিকে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু তিনি মরার মতো করে পড়ে থাকেন। পাকিস্তানিরা তাঁর মাথা তুলে দেখে তিনি মরে গেছেন কি না। একপর্যায়ে তারা ভাবে প্রভা বোধহয় মরে গেছে।
প্রভাকে বাড়ি ফিরতে দেখে বোন ও ভগ্নিপতি খুবই অবাক হয়। তাঁরা রাতে গুলির শব্দ শুনেছে। তাদের ধারণা, তখন প্রভাকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বেঁচে থাকার এমন জীবনবাস্তবতা চাননি প্রভারাণী।
সমাজের বিশ্বাস-মান্যতা-লোকলজ্জার চিরাচরিত বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আমার সামনে কথা বলে যাচ্ছেন প্রভারাণী।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার প্রভারাণীর গ্রামের বাড়িতে এই সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। ছবি: চন্দন সাহা রায়