সুন্দর চিরকাল-ই সুন্দর । কিন্তু এখানে না আসলে অদ্ভুদ সুন্দর দেখা হতো না। কিছু সুন্দর, কিছু মুহূর্ত, কিছু আবেগ, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আরব আমিরাতের মানবসৃষ্ট প্রকৃতি সৌন্দর্য মিরাকল গার্ডেন দেখার পর অনুভূতিটা ঠিক এমনি! ভূতপূর্ব নন্দন শৈলীর সুন্দর্য্য বা মুহূর্তগুলো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অন্তত আমার কাছে মনে হয়।
লন্ডন থেকে সাত ফেব্রুয়ারী দুই হাজার আঠারো আরব আমিরাতে ‘বাংলা সংযোগ দেশে দেশে‘ শ্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করা ৫২বাংলা টিভি‘র লোগো উন্মোচণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই দুবাই যাত্রা। সেখান থেকে একদিন সময় বের করে ,পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ও বড় ওয়ালে ফুলের বাগান,যা ইতিমধ্যে গিনিস ওয়াল্ড রেকর্ড এ স্থান করে নিয়েছে যোগ্যতম হিসাবে-ই। একই বাগানে, বিশ্বের সবচেয়ে বিরল প্রজাপতির বাটারফ্লাই গার্ডেন এবং একসাথে ৪৫ মিলিয়ন ফুল ফোটা বাগান দেখার দৃশ্যটি আমার কাছে-‘রথ দেখা, কলা বেচার‘ মতোই ছিল। দুবাই প্রবাসী সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম সঙ্গ দিয়েছেন ছায়ার মতো এবং ভালোবেসে, মুগ্ধতা নিয়ে ছবি তোলার কাজটিও তাঁর ছিল।
আরব আমিরাতের দুবাই এর দুবাইল্যান্ড এ মিরাকল গার্ডেনটি তৈরী করা হয়েছে। ভাষাগত পার্থক্যে উচ্চারণটি বাংলা ইংরেজী ও আরবিতে শুনলে কিছুটা তফাৎ মনে হতেই পারে। Miracle Garden Dubai – in Arabic: دبي معجزة حديقة –যার উচ্চারণ আরবিয়ানদের কাছে মিরাক্কেল গার্ডেন। তাই বাংলাভাষী আরব আমিরাত প্রবাসীদের কাছেও আরবীদের মতো এটি-‘মিরাক্কেল গার্ডেন‘ নামেই পরিচিত।
ভূতপূর্ব এই প্রজেক্ট শুরু করেন-দুবাইল্যান্ড এবং দুবাই প্রপাটিজ গ্রুপ ডেষ্টিনেশন। নান্দনিক শৈলীর কাজটি চুক্তিভিত্তিক বাস্তবায়নের কাজ করে বিশ্বখ্যাত আকার ল্যান্ডসক্যাপিং এন্ড এ্যাগরিকালচার কোম্পানী। যার কর্ণধার জর্ডানিয়ান ধনকুবের ও বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী আবদিল নাসের রাহাল।
শুরুর দিকে মিরাকল গার্ডেন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল- ৪০ মিলিয়ন দেরহাম বা ১১ মিলিয়ন ডলার।যদিও ,কয়েক পর্যায়ে এর বর্ধিতকরণ এবং অনেক সংযোজনে এর ব্যয় হয়েছে অনেক বেশী। অবশ্য সফল প্রজেন্ট হিসাবে ব্যয় এর পরিমাণ নিয়ে কারোই বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। বিষ্ময়কর সৌন্দর্য আর বিশ্বের প্রথম থ্রিডি এবং সেরা সৌন্দর্যমন্ডিত বাগানের দেশটির নাম আরব আরব আমিরাত, সেটি নিয়েই জনগণ মহা খুশি এবং গর্বের ঝিলিক তাদের কথাবার্তায়।-‘আমরা অনেক খুশি এইরকম একটি সুন্দর ফুলের বাগান আমাদের দেশে আছে, যেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশী, ফুল-ফল চাষে অনুকুল নয়,অথচ আমাদের আছে পর্যটকদের জন্য অনন্য ভালোলাগার সুন্দরতম বাগান। বাগানে টিকিট কেটে ঢুকার সময় কথা হয়- আহম্মদ নামের অফিস কর্মকর্তার সাথে এবং এভাবেই তার গর্বের প্রকাশ ঘটে। মিরাকল গার্ডেনটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রথম উন্মোক্ত করে দেয়া হয় ১৪ ফ্রেব্রয়ারী ২০১৩ সালে। ভালোবাসা দিবসে।
চলুন, ঘুরে আসি মিরাকল গার্ডেন
মেট্রো, বাস, প্রাইভেট বা ভাড়া করা ক্যাব যেভাবেই আসুন না কেন আপনাকে মিরাকল গার্ডেন রোডে এসে, প্রায় মিনিট পাঁচেক হেটে মূল ফটকে আসতে হবে। অনলাইনে অথবা সরাসরি যেভাবেই টিকিট কাটা হোক, ঢুকতে হবে একটি গেইট দিয়েই।যেখানে আছে সুন্দর ব্যবস্থাপনা।
তারপর সময়টা শুধুই উপভোগের। উপরে আকাশ আর ডান-বাম-সামনে -পেছনে সবদিকে শুধু রঙ বেরঙের ফুল, আর নন্দনশৈলীর চোখ ধাঁধাঁনো খেলা।
বলে রাখা ভালো যে, অনেক উঞ্চ আবহাওয়া, মরুভূমি আর বালুময় মাটির দেশ আরর আমিরাত। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বিশেষ করে থ্রিডি প্রযুক্তিতে মিরাকল গার্ডেনটি তৈরী করা হয়েছে। সাথে আছে দূরের পাহাড় ও খোলা আকাশকে ব্যবহারের নান্দনিক কলা কৌশলও।
অপার সুন্দর্য্য, ভাষাহীন মুগ্ধতা….
বাগানে ঢুকেই সোজা সামনে চোখে পড়বে- ভালোবাসার চিহ্ন-আঁকা লস্বা প্রসস্থ পথ। রাস্তার নাম সেভেন হাটর্স। রাস্তার উপর দিয়ে লাভ সেইপ রাস্তাটি জুড়ে আছে অনেকগুলো তোরণ এর মতো। নানা রঙের ফুলেই এইগুলো দাড় করানো হয়েছে; আপনি বিগলিত হয়েই পার করবেন হেটে যাওয়া সময়।
তবে ডানে বামে চোখ গেলে দাড়াবেন নিশ্চিত। হাটার পথ এর দুই ফাঁকে চোখে ভাসবে আরেক বিস্ময়। বাম দিকে দাঁড়িয়ে আছে ফুলের পাহাড়।ছোট ছোট উচু নিচু পাহাড় হলেও তা তৈরী করা হয়েছে থ্রিডি প্রযুক্তির সহায়তায়। ফুলে ফুলে ভরা পাহাড়গুলো আপনার চোখ আটকিয়ে রাখবে হলফ করে বলতে পারি।
এই রাস্তাটি হেটে যেতে বড়জোর মিনিট পাঁচেক এর সময় হলেও আপনার বিগলিত মন-চোখ আপনাকে আটকাবেই।আপনি চাইলেও যেন সামনে এগুতে দেবে না অপার সুন্দর্য্য। কারণ ডান দিকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে বিশাল এমিরাটস বিমান। দৃশ্যটি এমন যে, এইমাত্র উড়ালের প্রস্তুতিতে আছে। উড়াল প্রস্তুতির ইঞ্জিনের শব্দ, পাখাগুলো গুরছে, ভিতরে আলো জালানো, পাইলট, কেবিন ক্রুর ব্যস্তসময় সবগুলোই আছে। এইসব সত্যির মতো হলেও আপনাকে আশপাশের দর্শনার্থীদের ক্যামেরার ক্লিকগুলো জানিয়ে দেবে –এটা মানব সৃষ্ট, প্রাকৃতিক ফুলদিয়ে তৈরী দুবাই এর ঐতিহ্যের প্রতীক এমিরাটস বিমান। মনের আকাশে উড়াল দিতে এটি ব্যবহার করা গেলে এর চেয়ে সুখকর কি হতে পারে! বিভিন্ন এঙ্গেলে এখানে সবাই ছবি তুলতে ভিড় করেন। ’আগে ঘুরে দেখে আসি, পরে তুলব ‘- এই দ্বিধায় যেন না পড়েন,তুলে ফেনুন ছবি ইচ্ছে মতো। কারণ মিরাকল গার্ডেনে অনেক কিছু ‘মিরাকল’ এর মতো ঘঠতে পারে সামনে….
একই বাগানে ৪৫ মিলিয়ন ফুল
মিরাকল গার্ডেন এর ফুল বাগানের মোট আয়তন ৭২,০০০ স্কয়ার মিটার। যেখানে জুড়ে আছে শত শত রকমের শুধু ফুল আর ফুল। হাটার রাস্তা চার কিলোমিটার। আর মিরাকল গার্ডেন এর অফিসিয়াল তথ্যমতে, গোটা পার্কে সবসময় ফুটে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির দৃষ্টি নন্দন ৪৫ মিলিয়ন ফুল।
সামনেই বাম দিকে চোখে পড়বে আরেকটি বিস্ময়। পৃথিবীর দীর্ঘতম আয়তনের এবং সবচেয়ে বড় ওয়ালের ফুলের বাগান এর অপার দৃশ্যটি এখান থেকেই মুগ্ধতা ভরে দেখতে পাবেন।। একারণেই মিরাকল গার্ডেনটির নাম উঠেছে গিনিস বুকে।
ফ্রেন্ডস অব আরব আমিরাত হিসেবে বিভিন্ন দেশ এর ইতিহাস,ঐতিহ্যগত কিছু ছবি যেমন- পতাকা,ফুল,পাখি, ফল ইত্যাদি তৈরী করে রাখার সুন্দর একটি জায়গা আছে এক পাশে। যা প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে বদল করা হয়। বাংলাদেশের পতাকা এবং শাপলাও কর্তৃপক্ষের ভালোবাসায় সেখানে স্থান পেয়েছে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে। জায়গাটি নিদৃষ্ট আর বন্ধুদেশ এর তালিকা বিশাল হওয়ায়-বন্ধুত্বার বিশালত্বও এখানে মানা হয়ে থাকে,দেশের প্রতি দেশের বন্ধুত্বের গভীরতার ছাপও দেখা যায়;বছর বছর নতুন দেশ যোগ হয়।আর আগের বন্ধুদেশগুলো ক্রমধারায় কয়েক বছরের জন্য বাদ পড়ে।
এক বাগানে চোখ জুড়ানো সব ফুল
মিরাকল গার্ডেনে আছে সাতটি পিরামিড, বিশাল আকৃতির আরব আমিরাতের পতাকা। সেভেন হাটর্স, সেভেন সাটার, সানফ্লাওয়ার। দুটি ঝুলন্ত পথ এবং নানা শৈলীর ঝুলন্ত টবের ফুল বাগান। একটি রোমান্টিক ভাইভ, সেখানে আছে অনেকগুলো যুগলদের বসার জায়গা। আছে ছাতা সদৃশ্য ফুলের ‘আমব্রেলা পাথ‘। একটি ফুলের ট্যানেল, লিলিয়াম ফ্লাওয়ার ল্যাম্প ও জন্মদিন কর্ণার ইত্যাদি।
বা-দিক দিয়ে এভাবে হেটে গেলে দেখা যায়- দাড়িয়ে আছে ফেরারী কার। মুখে হাসি ছড়ানো ড্রাইভারসহ অপূর্ব নন্দনশৈলীতে ফুলদিয়ে ডিজানইন করা কার। আছে ফুল দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরী। বিভিন্ন প্রাণী,বাচ্চাদের পছন্দের কার্টুন এর জনপ্রিয় চরিত্রের প্রতিকৃতি, ফুলের বোট ও বিভিন্ন ইসলামী আর্চ ডিজাইন।যেখানেই দাড়াবেন,মন ও সময় দিতেই হবে আপনাকে।
এছাড়াও পার্কে আছে ফ্লরাল ক্লক। থ্রিডি প্রযুক্তির ব্যবহারে পুরোটি ফুল দিয়ে তৈরী। অর্থাৎ তের মিটারের দৃষ্টি নন্দন একটি ঘড়িরবাড়ি। প্রতি ১৫ মিনিট পরপর পাখির ডাকে সবর হয়ে পুরো এলাকা মুগ্ধতায় মাতিয়ে রাখে।সাথে ফুয়ারা দিয়ে এমন ভাবে পানি বের হয়, দেখে মনে হয় ফুলের উপর পাখি এক সাথে উড়ে, নেচে নেচে কুজন করছে।
আছে বিশাল আকৃতির দুটি ময়ূর। পেখম মেলে সপ্রতিভ দাড়িয়ে আছে। সাথে আছে কয়েকটি বাজপাখি ও তোতাপাখি-ও। মনে হয় সামনে যাওয়া মাত্র উড়াল দেবে।সবকিছুই নানা রঙ ও জাতের তাজা ফুলের তৈরী।
বিরল ২৬ প্রজাতিসহ প্রজাপতির গার্ডেন
দুবাই মিরাকল গার্ডেন এর অন্যতম আকর্ষণ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘বাটারফ্লাই গার্ডেন‘।
গার্ডেনের ঠিক মাঝখানটায় আছে এই বাটারফ্লাই পার্ক। ১৮০০০ স্কয়ার মিটার পার্কটি বিশাল মূল পার্ক থেকে একটু উপরে। এমন ভাবে ডিজাইন করে করা হয়েছে, মূলত: প্রজাপতির অভয়ারণ্য হিসাবে রাখার জন্য। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিরল ২৬ প্রজাতির প্রজাপতি আছে। বাটারফ্লাই পার্কে উঠতে সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
পঞ্চাশ উর্ধ দুজন পুরুষ-মহিলা উপরে উঠতে অনেক সময় নিচ্ছেন,কষ্টবোধ হচ্ছে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলাম। স্মিত হেসে ভদ্রমহিলা হাতটি ধরলেন, আরেক হাতে সিড়ির হাতলটি। জানা গেল;দুবাইতে ব্যবসায়ীক কারণে দীর্ঘদিন থেকে আসা- যাওয়া। তাঁর কাছে খুব আপন মনে হয় আরব আমিরাত। বললেন –‘প্রজাপতিগুলো দেখলে সৃষ্টির সৌন্দর্য ও অপার রহস্যগুলো আমার মনকে শুদ্ধ করে। এখানে কষ্ট করে উপরে উঠছি , আরেকটি কারণও আছে ;পায়ে ব্যাথার কারণে হেটে ইচ্ছে মতো সব দেখতে পারি না। এখানে উচু জায়গা থেকে খুব সহজে মিরাকল গার্ডেনটি উপভোগও করা যায়।’
বিশেষ দিন ও বিশেষ মূহুর্তের স্মৃতিচিহ্ন…
প্রিয়জন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এটা অসম্ভব রোমান্টিক জায়গা। ছোট লেকের ধারে ঝুপড়ির মতো করে লতানো ফুল দিয়ে তৈরী আছে সময় উপভোগের অনেকগুলো জায়গা। জন ও ন্যান্সি ইংল্যান্ড থেকে হানিমুনে দুবাই এসেছেন। কথার ফাঁকে জানালাম আমিও এসেছি লন্ডন থেকে। ‘আসলে প্রিয়মুহুর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতেই এখানে আসা। আমরা প্রকৃতি ভালোবাসি,ইন্টারনেটে খোঁজ নিয়েই মিরাকল গার্ডেনে এসেছি। কিন্ত এতো বড় সারপ্রাইজ-লাভিং ছিনারিইও দেখবো, কোন ভাবেই আন্দাজে ছিল না! এক কথায় ষোলআনা মুগ্ধ। আমাদের জীবনের অন্যতম সেরাদিন-ই হবে আজকের দিনটি।‘–ন্যান্সি তার হবু বরের হাত ধরে,তার দিকে চেয়ে চেয়েই বলছিল কথাগুলো। আর আনন্দের হাসি ছড়িয়ে উপর নিচে মাথা নেড়ে তার প্রিয়তম জন সায় দিচ্ছিল কথাগুলোর।
গার্ডেনে ’লাভ ভাইব’ নামে আছে মন ভালোকরা একটি জায়গা। প্রকৃতি ভালোবাসলে-ই যে আপনাকে রোমান্টিক হতে হবে, এমন কথা নেই! এই রকম বিশ্বাসীরাও এখানে হার মানবেন হলফ করে বলতে পারি। ছোট ছোট ব্যালকনির মতো ঘর সদৃশ্য বসার জায়গা। আছে সামনা সামনি ক্যান্ডেল লাইট চেয়ার-টেবিল। সামনে দোল খাবার চেয়ারগুলোও চমৎকার সাজানো। অনেক ধরণের ডিজাইনে-পিন্ক-লাল-গোলাবী- নীল-হলুদ-পারপ্যল সব রঙেরই আছে- লাভ ভাইবে। বসার জন্য,প্রিয়দের নিয়ে বিশেষ সময় উপভোগ করার জন্য দ্বিতীয় সেরা জায়গা খোঁজার কোন প্রয়োজন পড়বে না।
ইউরোপীয় এক দম্পত্তি ছবি তোলছি দেখে,মনভালো করা হাসি ছড়িয়ে, তাঁর মোঠফোনটি বাড়িয়ে দিলেন- অনেকগুলো ক্লিক দিয়ে যখন তাঁর হাতে মোঠফোনটি দিচ্ছি-জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছি ? -তারপর মিনিট পাঁচেক কথা বলা- জানালেন বিবাহের পঁচিশ বছরটাকে স্বরণীয় করে রাখতে মিরাকল গার্ডেনে আসা। ভদ্রমহিলা বললেন-আমাদের একমাত্র মেয়ে দুবাই ভ্রমণের টিকিট করে এই দিনটি যেন এখানে কাটাই তাও নিশ্চিত করে দিয়েছে। কাছের একটি হোটেলে থাকার বুকিং করে। দম না নিয়েই আরও বললেন- সে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে গতবছর বেড়িয়ে গেছে। এখন আমার মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যেতে….’।
এক কাপ চায়ের সাথে নানান দেশের গাছ দেখা…
গার্ডেনটিতে আছে পৃথিবীর ২০০টির বেশী দেশের বিভিন্ন রঙের ফুল ও ঔষধি গাছ । ভিতরে একপাশে আছে একটি মৌসুমী ফলের বাগান। আছে একটি ষ্টবেরি বাগানও।সেখানে মৌসুমি ভেজিটেবল চাষ করা হয়েছে-বিভিন্ন দেশের ফলগুলো নিজ হাতে পেড়ে বা তুলে খেতে পারবেন কেবল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ও নিদৃষ্ট সময়ে-ই।বাগানের একপাশে আছে বসার মনোরম জায়গা। আপনি চাইলেও এককাপ গ্রীনটি খেতে পারেন অথবা সেখান থেকে ফুল বা পাতার গন্ধ শুকে দেখতে পারেন। এসবের একটি নিদৃষ্ট কর্ণারও আছে,যা আপনাকে তৃপ্তি দেবে।
এই মহাসৌন্দর্য যজ্ঞে কাজ করছেন অনেক শ্রমিক। সুন্দর পরিপাটি এবং অত্যন্ত ভালো ব্যবহার মনে দাগ কাটবে পর্যটকদের সন্দেহ নেই। ফুল পরিচর্যার কাজটি বাগান খোলা অবস্থায় দেখা যায়না। এই কাজটি কর্তৃপক্ষ গার্ডেনটি বন্ধ সময়েই অর্থাৎ খুব ভোরে ও রাতে সেরে ফেলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রমিকরা সেই সময়েই থাকেন সবচেয়ে বেশী।
প্রতিদিনের সৌন্দর্য ধরে রাখার আসল নায়কেরা
দিনে অনেক শ্রমিক পোশাক পরে বিশাল বাগানের বিভিন্ন দিকে স্ব স্ব কাজের পোশাকে কাজ করছেন। বাংলাদেশী অনেক শ্রমিক কাজ করছেন চোখেও পড়েছে। কেমন আছেন-জিঙ্গেস করলেই হাসি মুখে ‘ভালো আছি‘ শুনে ভালো লাগলেও কেউই কথা বেশী দূর আগাতে চান না- ‘ভাই, এখানে কড়া সিকিউরিটি,আপনার হাতে ক্যামেরা, সিকিউরিটির লোক দেখলে অসুবিধা আছে। এখানে কাজের দায়িত্বে বাইরের কথা বলা যাবে না‘-চট্রগ্রামের মিরশরাই এর বাংলাদেশী ভাইটি এই বলেই অন্যদিকে চলে যাওয়াতে আর অন্যদের কাছে যাওয়া হয়নি। তবে কাজে ইন্ডিয়ান শ্রমিকের প্রাধান্য চোখে পড়েছে অনেক বেশী।
ফুলগুলো পরিচর্যার জন্য ব্যবহার করা হয় ওয়েষ্ট ওয়াটার, ড্রিপিং ইরিজেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতিদিন যে ৭,৫৭,০৮২ লিটার পানি বাগানে ব্যয় করা হয় ৪৫ মিলিয়ন ফুল পরিচর্যায় তা, ব্যবহারে কোন মালি কাজ করেন না।
হাতের কাছেই সব সুবিধা, অতৃপ্তি , মন খারাপের কারণ নেই
আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া আছে প্রায় সব গুলো সুন্দর ব্যবস্থাপনায়-ওপেন কার পার্কিং, ভিআইপি কার পার্কিং, বসার জায়গা, প্রার্থনা কক্ষ, বানিজ্যিক কর্ণার,শারিরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা সবগুলোতে আছে আন্তরিকতার ছোঁয়া, পরিচ্ছন্ন ও সৃজনশীলতার ছাপ।
মিরাকল গার্ডেনটির চারধারে আছে বিশাল ফুটপাত। বয়স্ক,শারিরিক প্রতিবন্ধী ও শিশুদের বাগান ঘুরে দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাটিও ভালো। বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের নিদৃষ্ট চার-চাকার খোলা গাড়িতে তুলে তাদেরকে পুরো বাগানটি দেখাবার ব্যবস্থা থাকায় কারোই না দেখার অতৃপ্তি বা মন খারাপের কারণ নেই।
মাঝে মাঝে রাখা হয়েছে বসার জায়গা। জায়গাগুলোও চমৎকার- সবগুলোই প্রকৃতি ঘনিষ্ট-যেমন প্রজাপতি ,ময়ুর, হাঁস,বাঁজপাখি, ফুলের টব ইত্যাদি নান্দনিক ডিজাইনে থিডি প্রযুক্তিতেই তৈরী করা। অনেকে ক্লান্ত না হলেও বসেন,শুধু অপার সৌন্দর্য উপভোগ ও স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে ছবি তুলার জন্য।
বাগানের মাঝখানে আছে কয়েকটি খাবার ষ্টল। সেখানেও চমৎকার নান্দনিকতার ছাপ। সরাসরি খোলা আকাশ দেখা যায় না। ফুল আর নানা রঙের ছাতা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে এই ছাদটি। ষ্টলগুলোও পরিবেশ বান্ধব।খাবারের দামগুলোও গলাকাটা নয়। তবে দোকান সবগুলোই এ্যারাবিয়ান, ড্রাই-ফাষ্ট ফুড এর দোকান।
বছরে বার বার ফুলের সৃজনশৈলী বদলে যাওয়া আরেক বিস্ময়…
গার্ডেনটিতে যদি প্রতি বছরই আসেন, তাহলেও এর নতুনত্ব আপনাকে চমকে দিবে। আসলে শুরুতেই এর পরিকল্পনা এভাবেই করা হয়েছে। অ্যাকার ল্যান্ডস্কেপিং এন্ড এ্যাগরিকালচার এর প্রধান আবদেল নাসের রাহাল শুরুতেই জানিয়েছেন যে- মিরাকল গার্ডেন এর ফুলের দৃশ্যপটগুলো প্রতি বছর সমান থাকবেনা। আমরা বছরে বছরে নতুন দৃশ্যপট তৈরী করে আকষনীয় করে রাখতে চাই।
দুবাই এরাবিয়ান রানচেস এর খুব কাছে, দুই হাজার তের সালে ভেলেন্টাইনস ডে তে মিরাকল গার্ডেন প্রথম খুলে দেয়া হয়। যদিও টিকিট কেটেই দর্শনার্থীদের বাগানটি দেখতে হয়। তথ্যমতে, প্রথম বছরেই ১.৫ মিলিয়ন ভিজিটর গার্ডেনটি দেখেছেন। আর বর্তমান তথ্যানুযায়ী,দুইহাজার সতের সালে প্রায় ৭মিলিয়নের উপরে দর্শনার্থী অদ্ভুদ সৌন্দর্যর মানবসৃষ্ট আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর মিরাকল গার্ডেনটি দেখতে এসেছেন।দর্শনার্থীদের সংখ্যা যে প্রতি বছর বাড়বে সন্দেহের অবকাশ নেই। যার সিংগভাগ বিদেশী, বিশেষ করে ইউরোপীয় পর্যটক।
গার্ডেনের সাফল্যের পালক
সাফল্যের পালকে আছে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পার্কটি প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় দুই হাজার পনের সালে ‘আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওয়ালের ফুলের বাগান’ হিসাবে গিনিস বুকে নাম লিখিয়েছে। দুই হাজার পনের সালে মিরাকেল গার্ডেন অর্জন করেছে বিশ্বের অনেক মর্যাদাপূর্ণ আন্তজাতিক পুরস্কার। দ্যা গার্ডেন ট্যুরিজম এ্যাওয়ার্ডস ২০১৫ (the International Garden Tourism Network (IGTN) Awards)।সহ অসংখ্য নামি- দামী পুরস্কার।
মিরাকল গার্ডেন দেখার সময় ও দিনগুলো
মিরাকল গার্ডেন খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ছুটির দিনে রাত এগারোটা পর্যন্ত। তিন বছর বয়েসী শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ফ্রি রাখা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৪৫ দিরহাম। আর দুই বছরের বড় বয়সীদের ৩৫ দিরহাম।
অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত খোলা থাকে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকার কারণ হলো প্রচন্ড গরম। গড়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুলগুলো জীবন্ত রাখা কষ্টসাধ্য এবং দর্শনার্থীদের এই তাপমাত্রায় বাগানের ফুল পরিচর্যা ও জীবন্তরাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়াও মানুষের মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করেই সরকারের নির্দেশেই মূলত এই সময় বন্ধ থাকে।
মিরাকল জার্নি বাই বাস , ট্রেইন…
যাতায়াত ব্যবস্থা খুব ভালো। ইচ্ছে করলে আপনি ক্যাব ভাড়া করেও যেতে পারবেন। কম খরচে সহজ পথও আছে। দুবাই মেট্রো দিয়ে MOE (Mall of the Emirates) ষ্টেশনে নেমে, প্রায় ৫ মিনিট দূরত্বে ১০৫ বাসে DMC অথবা Bus F30 এ ভায়া Arabian Ranches বাসে দুই নম্বর বাস ষ্টপে নামতে হবে । সেখান থেকেই সরাসরি দেখা যায় মিরাকল গার্ডেন। রবি থেকে সোমবার দুইটা থেকে রাত আটটা। এবং শুক্র-শনি দুপুর বারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত প্রায় ১৫ মিনিট অন্তর বাস চলে।
মন খারাপের উপকরণগুলো সাথে নিয়ে আসবেন না, প্লিজ
এখানে বেড়াতে আসলে- সময় নিয়ে আসা জরুরী। অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচাদের জন্য পুশচেয়ার থাকলে খুব ভালো। দীর্ঘ পথ হাটায় বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে আনন্দটাই অনেকাংশে ফিকে হয়ে যায়। হাতে প্রত্যেকে পানির বোলত অবশ্যই রাখবেন। হালকা নরমসোল এর জুতা পরলে স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারেন। আপনি যদি ইউরোপের ঠান্ডা দেশ থেকে আসেন, তাহলে , অবশ্যই সানক্যাপ সাথে রাখবেন, বন্ধুর মতো কাজে লাগবে।
রুপ সচেতন হলে বিশেষ করে, বাচ্চাদের গায়ে সানক্রিম দেয়া খুব ভালো। সাথে বাবা -মা বা হাটতে কষ্ট হয়, এমন স্বজন-প্রিয়জন থাকলে, ভেতরে গার্ডেন কর্তৃপক্ষের খোলা গাড়িতে বসে ঘুরে দেখার সুযোগটি নিতে ভুলবেন না।
আর অসম্ভব সুন্দর, অসম্ভব ভালোলাগার সময়কে ধরে রাখার জন্য পূর্ব থেকে ক্যামেরার চার্জ ও মেমোরিকার্ডটি যে ছবি তুলার জন্য শতভাগ পারফেকক্ট তা নিশ্চিত করেই যাত্রা করবেন।যাতে ছবি তোলা এবং সময়কে ধরে রাখার কাজটি থেকে বঞ্চিত না হোন। যা সারাদিনের মন ভালো থাকা- না থাকার সাথে সরাসরি সম্পর্কিতও বটে। মন-প্রাণ ভরে দেখার তৃপ্তি মিটাতে অন্তত তিনঘন্টা সময় নিয়েই মিরাকল গার্ডেন এ আসা উচিত।
অনেক ধন্যবাদ, আরব আমিরাত
আরব আমিরাত এখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ আধুনিক দেশ। ইউরোপ-আমেরিকার জন্য অন্যতম ‘বিজসেস হ্যাব‘ বলা হয়ে থাকে আরব আমিরাতকে। ইউরোপীয় নাগরিকদের জন্য দুবাই তো অনেক আগেই অন্যতম পছন্দের তীরস্থান হয়ে আছে। সুন্দর, পরিপাটি আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণে এখানে তৈরী হয়েছে পর্যটন বান্ধব পরিবেশ। প্রচন্ড গরম আবহাওয়া বাদে এখানের সিংহভাগ দিকগুলোতে প্রশান্তির ছোঁয়াও খুঁজে পাওয়া যায়।
গেল বার, দুই হাজার চৌদ্দ সালে লন্ডন থেকে স্বপরিবারে হলিডে এসেও দেখার সুযোগ হয়নি মিরাকল গার্ডেন। জুলাই মাসে প্রচন্ড গরম সময়ে পার্কটি বন্ধ ছিল।এইবার, ফ্রেব্রুয়ারীর সতের তারিখ ৫২বাংলার আমিরাত প্রতিনিধি সাংবাদিক আমিনুল ইসলামকে নিয়ে দুবাই মেট্রো ও বাস চড়ে যখন পৌঁছি মিরাকল গার্ডেনের সামনে, তখন সময় ছিল একটা বেজে দশ।
আমাদের হাতে ছিল দুটি ক্যামেরা। শত শত ক্লিপ, মুগ্ধতায় ‘ওয়াও – ওয়াও‘ বলে বলে দুজনে মিলে, কম করে হলেও পাঁচশ ছবি তোলা হয়েছে। সাথে নিউজ এর জন্য ভিডিও ক্লিপও। অসম্ভব ভালো মনের আমিনুল- ‘এখানে একটু দাড়ান,….. এইভাবে, এইখানে দাড়ান…‘। অথবা তাকে জোরে দাড় করিয়ে ছবিবাজি আর দুজনের এক সাথে সৌন্দর্য দর্শন ছিল শ্রেষ্ট সময়গুলোর অন্যতম একটি।
খাবার দাবার এর জন্য আধ-ঘন্টা সময় ধরলে বাকী থাকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। এই দীর্ঘ সময়ে একবারও মনে হয়নি- একবারের জন্য একটু জিরিয়ে নেই। অল্প কান্তিও বোধ করিনি। মনে তাড়া আসেনি- হোটেলে ফেরার। অথচ মোঠফোন বেজেছে বহু বার। মন চায়নি ধরে বলি-পরে ফোন করছি বা একটু ব্যস্ত আছি।অনিন্দ্য ভালোলাগানুভূতির কাছে পরাজিত ছিলাম। অন্যরকম মুগ্ধতায় কেটেছে সময়।
মুগ্ধতা এবং মন খারাপের অনুভূতি
যা শুরুতেই বলেছিলাম- কিছু কিছু সৌন্দর্য ,আবেগ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; নিরবে, উপভোগে বুঝে নিতে হয়। মিরাকল গার্ডেনে আমিও বিহঙ্গ ছিলাম। মনের দিক দিয়ে আবার একাও ছিলাম। বার বার সঙ্গহীনতা অনুভব করেছি ! খুব বড় সৌন্দর্য নাকি মানুষের মন খারাপ করে দেয়। আমার বেলায়, তা সত্যি হয়েছিল- আমার অর্ধেকজীবন, অর্ধাঙ্গীনিকে লন্ডনে রেখে আসতে হয়েছে বলে।
আপনি যদি যুগল হোন, অবশ্যই একা মিরাকল গার্ডেন দেখতে আসবেন না। হৃদগহীনে ডুব দিতে এই অদ্ভুদ, অপার এবং অসম্ভব রোমান্টিক পরিবেশ উপভোগে ‘প্রিয়জন’ খুব-ই দরকার। সাধ আর সাধ্যে কুলালে হানিমুন অথবা এ্যানিভার্সারি জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা খুব কমই পাবেন। অন্তত আমি মনে প্রাণে বলতে পারি।
ছবি: আমিনুল ইসলাম ও লেখক
আ নো য়া রু ল ই স লা ম অ ভি; কবি,সাংবাদিক,লন্ডন।