পৃথিবীর দেশে দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল যেন উৎসব হয়ে আসে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, সব জায়গায়ই ফুটবলপ্রেমীরা ব্যস্ত হয়ে উঠে নতুন আয়োজনে। ব্রিটেনের প্রতিটি শহরেও সেই একই উচ্ছাস। তবে ব্রিটেনের রাস্তায় কোনো মিছিল নেই। কোনো কোনো বাড়িতে ইংল্যান্ডের পতাকা উড়ছে। অতি উৎসাহী কিছু ইংল্যান্ড সমর্থক হয়তো ছোট্ট পতাকা টানিয়ে চালাচ্ছে তার গাড়ি। অথচ ইংল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে ফুটবলই হলো মূলত একটা ক্রেজ। ব্রিটেনের নামকরা অন্যান্য ক্লাবের মতো ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড কিংবা ম্যানচেষ্টার সিটির যখন খেলা হয়, তখন টিকেটের মূল্য থাকে চড়া। এক বছর আগে থেকেই নিজ নিজ দলের সমর্থকদের অনেকেই সিজন টিকেট কিনে রাখেন। কোনোভোবেই তারা নষ্ট করতে চান না তাদের নিজ দলের খেলাগুলো। ম্যানচেষ্টারের অধিবাসী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখি, এই দুদলের খেলার দিনে শহরটা কীভাবে উৎসবে মেতে উঠে। যেন মানুষের মিছিল চলে সিটি আর ইউনাইটেডের গ্রাউন্ডের দিকে। ইউনাইটেডের ৭৪ হাজার ৯৯৪টি আসন আর ম্যানচেষ্টার সিটির ৫৫ হাজার ৯৭ আসনের গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ থাকে খেলার দিনগুলোতে। শত শত নিরাপত্তাকর্মী হিমশিম খায় খেলাগুলোতে নিরাপত্তা দিতে। তবুও প্রতিটা গেমই অনুষ্ঠিত হয় ঝঞ্ঝাটহীন। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, ইংল্যান্ডে ফুটবল নিয়ে ঘটেনি কোনো অঘটন। প্রায় ২৯ বছর আগে ১৯৮৯ সালে শেফিল্ড শহরের এক স্টেডিয়ামে লিভারপুল ইউনাইটেড আর নটিংহাম ফরেস্টের খেলায় ফুটবল নিয়ে এক দাঙ্গায় মানুষ মারা গিয়েছিলে অন্তত ৯৬ জন। আহত হয়েছিল ৭৬৬ জন। স্টেডিয়াম ব্যবস্থাপনা এবং পুলিশের তৎপরতা নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিল।
তারপর ইংল্যান্ডের ফুটবলে এসেছে নতুন সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেই থেকে সরকার শিক্ষা নিয়েছে, বড় ধরনের কোনো অঘটন থেকে এখন মুক্ত ইংল্যান্ডের ফুটবল জগৎ। ইংল্যান্ডে ফুটবল হুলিগান নামে শব্দ একটা প্রচলিত আছে। এরা তাদের দেশের সমর্থনে কিংবা তাদের নিজের ক্লাবের সমর্থনে মারমুখী হয়ে উঠে। যেমন এই দেশে, তেমন অন্য দেশেও। কিন্তু নিরাপত্তার কারণেই বড় ধরনের কোনো অঘটন দেখে না এখন আর ইংল্যান্ডের মানুষ।
এবারেও রাশিয়ায় গেছে ৩ হাজার ইংল্যান্ড সমর্থক। শঙ্কায় ছিল তারা। কারণ মাস তিনেক আগ থেকে রাশিয়ার সঙ্গে চলছে ইংল্যান্ডের এক ধরনের শীতল সম্পর্ক। গত মার্চ মাসে সাবেক এক রাশিয়ান গোয়েন্দা এবং তার তেত্রিশ বছরের কন্যার বিষ প্রয়োগের ঘটনার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্কে কিছুটা হলেও ফাটল ধরে। সিরিয়া ইস্যু নিয়ে তেরেসা মে’র সরকার অযথাই কি এই ইস্যুটা বানিয়েছিল, সেটা নিয়ে কানাঘুষা আছে। এবং ইংল্যান্ডে সাধারণ মানুষদের অনেকেই রাশিয়ার এই সাবেক গোয়েন্দা এবং তার কন্যার বিষ প্রয়োগকে সাজানো বলে মনে করে। এবং সে জন্য রাশিয়ার সঙ্গে এই বিশ্বকাপে সম্পর্ক কি পর্যন্ত গড়ায় তা নিয়ে এমনকি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ফুটবল সমর্থকরাও কিছুটা হলেও ছিল সন্দিহান। কিন্তু কিছুই হয়নি। ব্রিটেনের মিডিয়া বরং রাশিয়ার ব্যবস্থাপনার প্রশংসাই করছে। রাশিয়া শুধু তাদের যুদ্ধের মেমোরিয়ালগুলোর প্রতি সম্মানটা যাতে অক্ষুণœ থাকে, তা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া ফুটবল সমর্থকদের তারা এ স্থাপনাগুলো দেখিয়েছে। দেশ আর জাতির জন্য উসর্গীকৃত মানুষগুলোকে তারা তুলে ধরেছে রাশিয়ায় আসা পৃথিবীর অগণিত মানুষের কাছে।
ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের অবস্থান ব্রিটেনে। তবুও ধারণা করা যায় ব্রিটেনের ৯০ শতাংশ ফুটবলপ্রেমীই ইংল্যান্ড দলের সমর্থক। যদিও তারা তাদের দল নিয়ে খুব একটা সন্তোজজনক অবস্থানে নেই। কারণ তারা তাদের দলকে বিশ্বকাপ অঙ্গনে খুব একটা প্রভাবশালী বলে মনেও করে না। সে জন্যই হয়তো এখনো তারা তাদের ফুটবল ইতিহাসের ১৯৬৬ সালটাকেই তাদের গৌরবের অধ্যায় হিসেবেই স্মরণ করে সব সময়। এই একটাবারই তারা ফুটবলের ইতিহাসের বিশ্বকাপ বিজয়ী হয়েছিল।
এমনিতে ব্রিটিশ জনগণ বলতে গেলে ফুটবল নিয়ে মাতোয়ারা হওয়া একটা জাতি। স্বাভাবিকভাবে তাই বিশ্বকাপ নিয়ে উচ্ছ¡াস আছে, আছে আলোচনা। অফিস পাড়া থেকে শুরু করে সব খানেই আছে গছিপ। কিন্তু সে জন্য অফিসের কাজে কেউ ফাঁকি দিচ্ছে না। সব কিছুই স্বাভাবিক। ১৮ তারিখ বিকেল ছিল দেশটির নাগরিকদের উচ্ছ¡াস আর উদ্বেগ মেশানো একটা বিকেল। সামাজিক মেলামেশার প্রধান জায়গাটি হলো তাদের স্থানীয় পাবগুলো। এই পাবগুলো ছিল ওইদিন কানায় কানায় ভরা। টেলিভিশনের সামনে বসেছিল দেশটির জনগণ। ইউনিয়ন জ্যাক (ফ্ল্যাগ) নিয়ে কোনো মিছিলের খবর আসেনি মিডিয়ায়। তারা হৈহুল্লুড় করেছে, পান করেছে, উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে অঘটন ঘটায়নি কোথাও। ২০১৮ সালে মনে করা হয়েছিল রয়েল পরিবারের বিবাহের অনুষ্ঠানটিই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছে ব্রিটিশ জাতি। কিন্তু দেখা গেছে সেই অনুষ্ঠানটি গণমাধ্যম তথা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিল ব্রিটেনের ১৩ মিলিয়ন মানুষ, যেখানে ইংল্যান্ড-তিউনিসিয়ার খেলা উপভোগ করেছে ২১ মিলিয়ন ক্রীড়ামোদী মানুষ এই ব্রিটেনে।
বাংলাদেশও উচ্ছাসে মেতেছে। ৪ বছর পর পর আসা বিশ্বকাপে এক ধরনের আবেগ-উচ্ছ¡াস আছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে ঘিরে। বাংলাদেশে ফুটবল এখন আর ততটা জনপ্রিয় খেলা হিসেবে নেই। কিশোর-তরুণ বৃদ্ধ সবার কাছেই এখন ক্রিকেটারদের নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। ফুটবলের জাতীয় খেলাগুলোতেও স্টেডিয়াম গ্যালারিগুলো খাঁ খাঁ করে। অথচ ওই ফুটবল খেলাটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপে মাতোয়ারা হয়ে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হয় কিনা জানি না, বাংলাদেশই সেই দেশ, যেখানে জায়গা বিক্রি করে জার্মানের পতাকা বানিয়েছেন একজন মানুষ মাইলের পর মাইল। কী এক অদ্ভুত আয়োজন পরিলক্ষিত হয় এই বাংলাদেশে। যেখানে মাইলের পর মাইল লম্বা বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে হাঁটে না এমনকি ক্রিকেটের বিজয় নিয়ে আসার পরও সেখানে হাজার হাজার মিটার লম্বা ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে ধরাধরি করে মাইলের পর মাইল মিছিল করে বাংলাদেশের কিশোর তরুণরা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বাহাস চলছে, তা শালীনতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিউজ প্রকাশিত হয়েছে, এ কারণেই একপক্ষ আরেক পক্ষ কুপিয়ে আহত করেছে।
যারা নিয়মিত ফুটবল অনুসরণ করে না, তারাও হয়তো বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের সময় বাঁচিয়ে বিশ্বকাপের খেলাগুলো উপভোগ করে। পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়দের ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখার জন্য মানুষের এই টানটান উত্তেজনা থাকা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু ওই যে বাড়তি অতি উচ্ছ¡াস, বাড়িতে বাড়িতে ভিনদেশের পতাকার পতপত উড়ে বেড়ানো, কোটি কোটি টাকার অপচয় এ কি শুধুই প্রিয় খেলোয়াড় কিংবা প্রিয় দলের প্রতি সমর্থন নাকি আমাদের তারুণ্যের প্রগলভতা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে কিন্তু সে প্রশ্নটা আমাদের আসতেই পারে।
ফারুক যোশী: কলামিষ্ট, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভিডটকম