আমাদের শৈশবের রমজান মাস আসতো শীতকালে। রমজান মাসের প্রায় অর্ধেকাংশ জুড়ে ছিল আমাদের ঈদ আয়োজন।ঈদ আসছে, সেই আগমনী বার্তায় আমরা আনন্দে আত্মহারা থাকতাম।
ঈদকে ঘিরে ছিল নানা আয়োজন।যেহেতু শীতকালে ঈদ, তাই ঈদের দিন ভোরবেলা গোসল করে খড়ে আগুন জ্বেলে শীত পোহাতাম।এমন নয় যে, শীতের কাপড় ছিলনা। কিন্তু তবুও, ঈদের দিন ভোরবেলা গোসলের পরে যেন খড়ে আগুন জ্বেলে, আগুন না পোহালে ঈদের আনন্দ পূর্ণতাই পেতনা। তাই ঈদের অনেকদিন আগে থেকেই আমরা মাঠে খড় সংগ্রহে নেমে পড়তাম। বিকালে খেলা শেষে এক আঁটি খড় প্রতিদিন সাথে নিয়েই ফিরে আসতাম। কার থেকে কার খড়ের স্তূপ উচ্চতর হবে, সে নিয়ে ছিল এক মধুর প্রতিযোগিতা।
হারিয়ে যাওয়া সেই শৈশবে আমাদের শুধু ‘বিটিভি’ নামক একটি মাত্র চ্যানেল ছিল। বিটিভি’তে ঈদ উপলক্ষে সাতদিনের বিশেষ অনুষ্ঠান হতো। এই সাতদিন কী কী অনুষ্ঠান আছে? কখন দেখানো হবে? -সব খাতায় লিখে রাখতাম; যাতে মিস হয়ে না যায়। তখন বৈদ্যুতিক সমস্যা ছিল প্রকট।বৈদ্যুতিক কারণে বা অন্যকোন কারণে যদি কোন অনুষ্ঠান মিস হয়ে যেত, তাতে কি যে হাহাকার!
‘ঈদের পরে, আমরা কোথায় বেড়াতে যাব’- সেই তর্কে বন্ধুদের সাথে হারিয়ে যেত রমজান মাসের প্রায় সবকটি রাত। তর্কে তর্কে কখনো হাতাহাতি থেকে ইট-পাটকেল ছোড়া পর্যন্ত হয়ে যেত।তবুও তর্ক শেষ হতো না। আলোচনা ও কর্মপরিকল্পনা-ও শেষ হতো না। অথবা আমরাই শেষ হতে দিতে চাইতাম না মনের অজান্তে।কেন চাইব ?এর চাইতে মধুর তর্ক বা আলোচনা অথবা ঝগড়া পৃথিবীতে কি দ্বিতীয়টি হয় ভালোবাসার মায়াজালে মাখা ?
খ.
আমাদের শৈশবে মারবেল খেলা ছিল, ফুটবল খেলা ছিল।আমাদের শৈশব জুড়ে আছে বাড়ির উঠানে টেস্ট ম্যাচ। আমাদের শৈশবে, আমরা বাড়ির উঠানকেই বানিয়েছি সারজা অথবা ইডেন গার্ডেন
ক্রিকেট স্টেডিয়াম। কি টানটান উত্তেজনাময় ছিল সেই সব ম্যাচ।বল ধরার জন্য প্রাণপণ ড্রাইভ। লারা, শচিন, আফ্রিদি, জন্ডিরুডস হয়ে উঠতাম একেকজন।
ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসে, উত্তেজনা এবং আনন্দের মাত্রা বাড়তেই থাকে।উত্তেজনা, আনন্দের ছুটে আমার ঘটাতাম নানান কর্মকাণ্ড। সমস্ত গ্রাম যখন তারাবির নামাজ আদায়ে মগ্ন, তখন বিভিন্ন বাড়ির গাছ থেকে ডাব, জাম্বুরা চুরি হয়ে যেত আমাদের হাতে ।চুরির সেই মাস্টার প্লান ‘সাকসেস‘ হলে আমাদের সে সময়ের আনন্দগুলো বলে বুঝানো যাবেনা।
বাবার হাত ধরে ধুরুধুরু বুকে,কৌতুহলী চোখে ঈদের নতুন কাপড় কিনতে যাবার এক উন্মাদনা ছিল। নির্মল আনন্দ ছিল।কাপড় যেন কেউ দেখতে না পারে তাই কাপড় লুকিয়ে রাখা হতো সতর্কতায়,কড়া নিরাপত্তায়।
এখনো কি ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে নিতে কাপড় নিয়ে লোকচুরি খেলা হয়?
গ.
ঈদের চাঁদ দেখা নিয়েও আমাদের কৌতূহলের সীমা ছিলনা।ঈদের দুদিন আগ থেকেই, প্রতি সন্ধ্যায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম। যদি চাঁদ আজ উঠে যায়! এমনও হয়েছে যে, কোন কোন ঈদে চাঁদ ওঠেনি। আমরা নিরাশ হয়েছি।এখনো কি আমরা আকাশে ঈদের চাঁদ খুঁজি? অথবা চাঁদ না দেখলে নিরাশ হই?
শৈশবের একটি সময় আমরা মেহেদি গাছের পাতা পিষে হাতে মেখেছি।তখন মেহেদী গাছ খুব বেশি ছিলনা।তাই পাতাও প্রচুর পাওয়া যেতনা। তবুও, যা পাওয়া যেত, সবাই ভাগ করেই মেখেছি।তখন মন খারাপ হতো, পাতা ভাগ করতে।কিন্তু এখন বুঝি সেই ভাগাভাগিতেই লুকিয়ে ছিল ঈদের আনন্দ।সেই অপূর্ণতাতেই ছিল ঈদ আনন্দের পূর্ণতা।এখনও কি পাতা, রং কিংবা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি হয়?
অনেক প্রতীক্ষার পরে আমাদের ঈদ আসতো।ভোরের আলোর সাথে-সাথে আমরাও জেগে উঠতাম।কে কার আগে পুকুরের জলে লাফ দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় নেমে একবার আমাদের এক বন্ধু আরেক বন্ধুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।রক্ত ঝরেছিল, তবু আনন্দ থামেনি। লাফ দেয়া থামেনি।কোন অভিযোগ কেউ করেনি।বরং সখানুভুতিতে মনে রেখে আছে এখন পর্যন্ত।
এখনোও কি জল ডুব দেবার সেই প্রতিযোগিতায় ছেলেরা নামে?এখনো কি খড়েরআগুন কত উঁচুতে তুলা যায় সেই প্রতিযোগিতা হয়? নাকি, যান্ত্রিকতার এই যুগের স্রোতে হারিয়ে গেছে আমাদের সেই খুশির নির্মল আনন্দ আয়োজনগুলো।
এখনো ঈদ আসে।আগের সেই ঈদ কেন আসেনা? মনে হয়, জীবন এমনই, যা হারিয়ে যায়; তা আর ফিরে আসেনা? হয়তো বা এটাই জীবনের ধর্ম। জীবনের প্রধানতম আকর্ষণ-ও।
ঘ.
যত-ই বড় হয়েছি, ততো-ই ঈদের আনন্দ থেকে দূরে সরে গেছি।এখন, প্রবাসের এই যাযাবর জীবনে চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায়।যা ইচ্ছা কেনা, অফুরন্ত মেহেদির রং পাওয়া যায়। শীত নিবারণের জন্য খড়ের প্রয়োজন হয়না। কারণ এখন শাওয়ার লাইন দিয়ে গরম-ঠাণ্ডা দুইপ্রকার জল আসে, একই সময়ে,চাইলেই। ।তবুও কি যেন নেই! আছে শুধু- কি সবের হাহাকার। কি সবের শূণ্যতা। কি সবের না পাওয়ার বেদনা।
এখন ঈদ এলেই, ইচ্ছে করে, ভোরের আলোর সাথে সাথে চঞ্চল বা ডানপিঠে ছেলেদের দলে মিশে গিয়ে পুকুরের জলে লাফ দিতে। রাতের আধারে ডাব চুরি করতে। ইচ্ছে হয়, বাবার হাত ধরে আবার ঈদের কাপড় কিনতে যাই।বাবাও কী এই ইচ্ছাগুলো পূরণের জন্য অপেক্ষায় আছেন? মনে আছে তাঁর?
আমেরিকার যান্ত্রিককতার জীবনে ইদানীং খুব নস্টালজিক হয়ে যাই।নস্টালজিক এই সব স্মৃতিদের পেছনে বা পুরনো দিনের স্মৃতির এ্যালবামে জমারেখে ঈদ কিন্তু সময়ের আপন নিয়মে, সমান গতিতে আমাদের জীবনে আসে।শুধু আমাদের শিশুবেলার সেই ঈদ আসে না। আমার সেইসব সুখানুভূতির অমৃতদিনগুলো আর আসেনা। হারিয়ে যাওয়া সেইসব ঈদ আসেনা। তবুও তো ঈদ এসেছে।দেশে-বিদেশে। একই সময়ে, রবিন্দ্রনাথের রেলগাড়ি কবিতার পক্তিগুলো মনে পড়ছে-
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।’
সবাইকে ঈদ মোবারক, ঈদ শুভেচ্ছা।
লেখক: স্যোসাল একটিভিস্ট,সংগঠক। নিউ ইয়র্ক।
১৫ জুন ২০১৮ সাল