ক.
১৮ মে ২০১৮ আমাদের প্রানের সংগঠন হৃদয়ে ৭১ ফাউন্ডেশনের ১১৮ তম সাপ্তাহিক পাঠচক্রে স্নেহাস্পদ মামুন আহমদে যখন উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ঔডারল্যান্ডের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরছিলেন তখন, আমরা সমবেতরা কেবল অবাক হইনি, হয়েছি বাকরুদ্ধও! একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সাবেক সামরিক কামান্ডিং অফিসার, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঢাকায় বাটা সু- কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ১৯৭০ সালের যোগ দেন।
বাংলাদেশে এসে এই সামরিক কমান্ডার প্রত্যক্ষ করেন বাংলাদেশ এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিভিন্ন দিকগুলো। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যখন, তিনি প্রত্যক্ষ করেন ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা; ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ । ঘৃণ্য জাতিগত বিদ্বেষ এর মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট এবং পরবর্তীতে নৃশংস, বর্বরতা যা তাকে কেবল মর্মাহত করেনি, তার হৃদয় কে এতটাই নাড়া দিয়েছিলো যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- জয় বাংলা স্লোগানের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে যাওয়া এ জাতিকে সাহায্য করার। তিনি এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তি করার মত জীবন ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে বিশেষ কৌশলে সংবাদ গ্রহন করে তা গোপনে প্রেরণ করতেন তৎকালীন ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ.টি.এম হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের কাছে। শুধু তা-ই নয়! তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে গেরিলা কমান্ড হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশিক্ষণ দিতেন ২নং সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাদের। এক পর্যায়ে নিজের জীবন কে বিপন্ন করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেল-লাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু অপারেশন সংগঠিত হয়। পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্থানী বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোক চিত্র তুলে বহি:বিশ্বে বিভিন্ন তথ্য মাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযু্দ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানে স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে বীর প্রতীক সম্মানে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
উইলিয়াম এ.এস ঔডারল্যান্ড কে নিয়েই আমি এই সময়ে ভাবছি। এই দেশ গঠনে কেবল বীর বাঙালীর রক্ত, ঘাম ঝরেনি। ভিনদেশী, ভিন্নভাষী ঔডারল্যান্ড সহ অন্যান্য অনেকের ঘাম ও রক্ত ঝরেছে। আজকে তাঁদের ভূমিকা থেকে জাতি হিসেবে আমরা কী কোন শিক্ষা নিয়েছি বা নিচ্ছি?- এই মোটাদাগের প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে। ৭১ এ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে, স্বাধীনতার স্বার্থে, আত্ম-স্বীকৃতির স্বার্থে, সার্বভৌমত্বের স্বার্থে, সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সামগ্রিক জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল; সেই ঐক্যকে শক্তিতে রুপান্তরিত করে ৩০ লক্ষ শহীদ আর ৩ লক্ষাধিক মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশে আজকে আমরা কী দেখছি? কী সব শুনছি? রাজাকারকে রাজাকার বলা যাবে না। দুর্নীতিবাজ কে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সাদাকে সাদা বলা যাবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা কে চেতনা ব্যাবসা বলেও অপবাদ শুনতে হয় অনেককে। সমাজের অনিয়ম অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই বিপদ। এমন বাংলাদেশের জন্য আমাদের পূর্বসূরীরা নিশ্চই আত্মত্যাগ করেননি।
খ.
সমাজের কোন অসামঞ্জস্য এর বিরুদ্ধে কথা বললে একশ্রেণীর সমাজপতিদের চুলকানি বেড়ে যায়। এই কয়দিন আগে; এক সময়ের জাদরেল ছাত্র নেতা বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ছরওয়ার আহমদ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমাজের বাস্তবতার আলোকে “ইফতারী রমজানে প্রচলিত একটি অমানবিক প্রথা” শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন- ‘বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে ইফতারী একটি ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। ইফতারী না দিলে যেন ইজ্জত যায়।’…. ‘অনেক ক্ষেত্রে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে স্বাদ ও সাধ্যের বাহিরে গিয়ে মেয়ের বাড়িতে ইফতারী পাঠাতে হয়…’। তাঁর এই লিখার সাথে একাত্বতা পোষণ করছি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর দেয়া পোষ্টে অনেকের বিরুপ মন্তব্যে দেখে মনে হল যে, ভিন্ন নামে বা সামাজিক আচারে এ জাতির উপর ঔপনিবেশিক ‘ডিভাইড এন্ড রোল’ প্রথা এখনো চালু আছে। যেখানে অন্যকে ইফতার করানো সওয়াবের কাজ সেখানে আমরা এটাকে জুলুমে পরিণত করছি।
কিছুদিন আগে আলাপ হচ্ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৃণমূলের পরিচ্ছন্ন কর্মী নাজমুল ইসলাম রাহাত, মো:মুসলেহ উদ্দিন, তারেক আহমদ ও নাছিরুল ইসলাম মাহেরের সাথে । তাদের আকুতি, “ভাই, আপনি মাঝে মধ্যে সমাজের অসঙ্গতি, অনিয়ম নিয়ে লিখেন। আপনার আগামী লিখায় সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে নিহত মুজিব অন্ত:প্রান মেধাবী ও পরিচ্ছন্ন ছাত্রলীগ নেতা ওমর মিয়াদ এবং তার পরিবার কেন এখনো ন্যায় বিচার বঞ্চিত? কেন তার হত্যাকারী প্রকাশ্যে ক্ষমতার উপরওয়ালাদের আশীর্বাদে আস্ফালন করে বেড়ায়? সাধারণ জনগণ তাহলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে কী আর মুক্ত হবে না?‘ ইত্যাদি। রাহাত, মুসলেহ, তারেক, মাহেরের, একটাই চাওয়া; প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাতে গিয়ে আর যেন কোন মায়ের কোল খালি না হয়। মিয়াদের বাবার মতো আর কোন বাবা ছেলের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষায় না থাকে।
প্রশ্ন থেকেই যায়- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবীদার দল বা শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাদের দ্বারা বা তাদের নিয়ন্ত্রণে বিচারহীনতার রাজনীতি চলে কী ভাবে। তাহলে রাষ্ট্র কার দ্বারা সঠিক পথে চলবে?
গ.
গত ৩রা মে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ফ্রেন্ডস্ ক্লাবের আয়োজনে সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগীতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে ছুরক আহমদ, নাকিব খান,শিমুল ইসলাম, সুজিত চন্দ, রানা পাটওয়ারী, শাহিদুর রহমান বাবলু’দের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চর্চায় উদ্যোগী করার কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে- সারা বাংলাদেশে এমন সংগঠন ও উদ্যোগ কিংবা সামাজিক শক্তি থাকলে মাদক আর ইয়াবার বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধে নামতে হতো না। আমার ভাই মাহমুদ আলী এইসব আশা-নিরাশা দেখে একটি কথা প্রায়ই বলেন – ‘কোথাও নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। সেটা হোক সামাজিক সংগঠন অথবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।’ তার কথায় মিথ্যা খোঁজার সুযোগ নেই। নিয়মিত সম্মেলন আর সংগঠন চর্চা ছিল বলেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের চারটি কমিটির অংশ হতে পেরে ছিলেন- হৃদয়ে ৭১ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ও বর্তমান সিলেট নগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সিলেটের রাজনীতির ক্লিনম্যান অধ্যাপক মো: জাকির হোসেন। অপরদিকে, ভাইগিরি ,গ্রুপিং আর আত্মীয়করণের ঘৃণ্য চর্চায় অনেক ছাত্রলীগ কর্মী থেকে যাচ্ছে পদ বঞ্চিত, পরিচয় বঞ্চিত।
সময় এসেছে আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার । সমাজের সকল অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অনাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সর্বোপরি জাতীয় ক্ষেত্রে ঐক্যমত সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার জরুরী। নিজেকে বিরব, গুটিয়ে রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই।