দীর্ঘ দিনের দুর্ভোগ, প্রশাসনিক অবজ্ঞা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের খেয়ালিপনা এবং অবহেলা সত্বেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন একটি গ্রামের তৃণমূলের মানুষ।
চোখে ও বোধে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছে করলে কোন কাজই অসাধ্য নয়। বলা যায়, কাজটি সমাজে একটি আলোর দুয়ারও খুলে দিয়েছে। আরও সোজাকথায়- রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে স্বেচ্ছারিতায় চলা স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের দেখিয়ে ও কাজে বুঝিয়ে দিয়েছে- দাম্ভিকতার বিপরীতে মানবতার প্রকৃত স্বরুপটি। ঘৃণা অবহেলায় আসলে নিজের বা সমাজের অমানবিক এবং অসৎ চিন্তা ও কাজের বিষ ছড়ানো যায়। মানুষের শ্রদ্ধা ও মন জয় করা যায় না। উল্টো ঘৃণা অভিপাশে নিজের আসল রুপটি প্রকাশ পায় সবচেয়ে বেশী। প্রতীকি অর্থে এই কাজটি গ্রামের মানুষরা করে দেখিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পৌরশহরে শহীদ টিলা থেকে বড়দেশ গ্রাম পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তা দীর্ঘ দিন থেকে ভেঙ্গে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। এই এলাকার মানুষের উপজেলা সদরে আসার প্রধান রাস্তাটি মূলত তাদের বিয়ানীবাজারের সাথে প্রতিদিনের সংযোগ করে রেখেছে। বড়দেশ হতে বিয়ানীবাজার হলো তাদের নিত্য দিনের সব কাজের অবিচ্ছেদ্য স্থান। এই রাস্তাকে বাদ দিয়ে তাদের জীবনযাত্রা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক কোন কাজে সংযোগের কোন সুযোগ নেই। রাস্তাটির প্রায় অর্ধেক স্থানীয় সরকারের এলজিডি অন্তর্ভূক্ত হলেও রেকর্ডে থাকা পিচ রাস্তায় অনেক জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে পিচ তো দূরের কথা, কোন ইট-ই চোখে পড়ে না। সামান্য বৃষ্টি হলেই হাটুকাদা তো হয়ই। বর্ষা মৌসুমে এ পথে যানবাহন যেতেই চায় না।
শহীদ টিলা থেকে বড়দেশ রাস্তার সিংহভাগ এর অবস্থান পৌরসভার অধীনে। বাকীটুকু স্থানীয় সরকারের এলজিডি‘র আওতাধীন। দীর্ঘ দিন থেকে জনদুর্ভোগে থাকা এই গ্রামের মানুষই শুধু এই পথে যাতাযাত করে না। এ পথের পথিক পূর্বাঞ্চলের মুড়িয়া, ঘুঙ্গাদিয়া ইত্যাদি গ্রামের ২৫/৩০ হাজার মানুষ।
গ্রাম তথা এই অঞ্চলের ভোক্তভূগি মানুষরা দীর্ঘদিন থেকে রাস্তাটি সংস্কারের দাবী জানিয়ে আসলেও পৌরসভা ও এলজিইডি কর্তৃপক্ষ কোন আমলে নেয়নি। উপরন্ত রাস্তাটি যেহেতু দুই বিভাগের অধীনে, তাই এটা নিয়ে দুই বিভাগ একে অপরের কাধে ‘দোষ‘ বা ‘খুড়াযুক্তি’ দিয়েই যাচ্ছিলেন।
তথ্য বলছে- প্রায় আড়াই বছর আগে রাস্তাটি নামমাত্র পিচ ঢালাই করা হয়েছিল। যার ছিটে ফুটা দৃশ্যমান না দেখেই বুঝা যায়. দূর্নীতির ব্যারোমিটার এখানে কত মাত্রা ছিল।
১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার বড়দেশ গ্রামের মানুষ এই অঞ্চলের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের বোধে সজরে ধাক্কা দিয়েছেন। বড়দেশ গ্রামের হাজী আলা উদ্দিন, হাজী মখলিছুর রহমান, তুতা মিয়া, হাজী মস্তফা উদ্দিন,আব্দুল কাইয়ুম মেম্বার, আব্দুল বাসিত খান ,শফিউর রহমান, ফারুক আহমদ, ইমাম হাসনাত সাজু মিলে গ্রাম থেকে চাঁদা তুলে রাস্তা পাকা করণের উদ্যোগ নেন। এতে সহযোগিতা করে যুক্তরাজ্যস্থ বড়দেশ সমাজ কল্যাণ সমিতি ইউকে।
উদ্যোক্তাদের একজন শফিউর রহমান জানিয়েছেন,গ্রামবাসীর টাকায় পাথর,বিটুমিনসহ নির্মাণ সামগ্রী এনে রাস্তা পাকার কাজ শুরু করা হয়। আড়াই কিলোমিটার রাস্তা পাকা করতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।পুরো কাজে তদারকি ও সেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করেছেন গ্রামবাসী। প্রবাসীদের সহযোগিতা ছাড়াও গ্রাম থেকে চাঁদা তুলে এ কাজ করা হয়েছে।
বড়দেশ গ্রামের এই রাস্তাটি প্রতিবছরই বৃষ্টির সময় তলিয়ে যায়।রাস্তার দুপাশের ড্রেনগুলোও খুব ছোট। উপরন্ত রাস্তার দুপাশের বাসা-বাড়ির বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এই ছোট ড্রেনটির উপর। যা ড্রেনটি ৫০% ধারণ করতে পারেনা। ফলত প্রতি বছর কাদা-জলে মাখামাখি হয়েই এই রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার পথচারিকে যাতায়াত করতে হয়।
এটা সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন থেকে স্থানীয়দের দাবী জনপ্রতিনিধিদের কাছে উপেক্ষিত হয়েই আসছে। স্কুল, কলেজে শিক্ষার্থীদের যেতে অবর্ণনীয় দূর্ভোগ পোহাতে হয়। বর্ষা মৌসুমে প্রায় অর্ধেক হাটুজল দিয়ে পার হতে ছাত্রীরা আসা যাওয়ায় ভিজে যায়। ছাত্রীদের প্রতিদিন তাদের ইউনিফর্ম বদল করতে হয়। নিম্ম মধ্যবিত্তের জন্য যা নিদারুণ কষ্টের।
গ্রামবাসীর জন্য এটা বলা যায় গা সওয়া কষ্টের মতো হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। অথচ এই জনপথের সংখ্যাগরিষ্ট ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন সংসদীয় আসনের এমপি। যিনি মন্ত্রী হিসাবে দশ বছর দায়িত্বে ছিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র সব থাকলেও তাদের জন্য ছিলেন উপেক্ষিত। উপরন্তু নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে ‘এটা আমার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পড়ে না‘, ‘রাস্তার অর্ধেক আরেক মন্ত্রণালয়ের‘, ‘আমার মন্ত্রনালয়ে বরাদ্ধ নেই‘ ইত্যাদি বাক্য চালাচালিতেই সংশ্লিষ্টরা ব্যস্ত আছেন এখনও।
রাস্তাটিতে কাদাজলে মাখামাখি সময়ে অনেক করুণ ঘটনা ঘটে চলেছে। স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি যাতায়াত খরছ। রিক্সা, অটোরিক্সা থেকে উল্টে অনেকে হাত,পা, কোমর ভেঙ্গে দীর্ঘদিন হাসপাতালে সয্যাশায়ী হয়েছেন। এই রাস্তায় ন’টা পাচটার যাতায়াতে অনেক পেশাজীবি মহিলার গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটেছে।
অথচ রাষ্ট্রের টাকায় জনপ্রতিনিধিরা প্রায় দেড় বছর আগে যে কাজ করিয়েছেন, সেখানেও যে মোটাদাগে দুর্নীতি হয়েছে, সেটাও তদারকী করা হয়নি।
শিক্ষা, সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সচেতন বিয়ানীবাজার অঞ্চলের মানুষ দেশ বিদেশে বিভিন্ন পেশায় বিয়ানীবাজার তথা বাংলাদেশকে আলোকিত করে আসছেন। এককভাবে এই বড়দেশ গ্রামই গোটা বাংলাদেশে বিয়ানীবাজারবাসীকে অনেক ভাবে আলোকিত করে আসছে।উল্লেখযোগ্য থেকে মাত্র তিনটি প্রাসঙ্গিক তথ্য উদৃত করছি।
এক. বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রসূতি বিভাগে, সিলেট বিভাগ সেরা হওয়া হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে জলতি বছরসহ টানা ৮বার । বাংলাদেশে প্রসূতি মায়েদের ‘নরমাল ডেলিভারী’রীতিমতো বিরল সংবাদ। সে তুলনায় বিয়ানীবাজার আশার আলো ছড়িয়েছে।পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাভাবিকভাবে (নরমাল ডেলিভারি) ২ হাজার ৩০৫জন শিশুর জন্ম হয়। এছাড়া অস্ত্রপচার (সিজার) এর মাধ্যমে ১৭৯জন শিশু জন্ম লাভ করে। এই ভূতপূর্ব সাফল্যের নেপথ্যে কাজ করেছেন একজন মানবতাবাদী ডাক্তার। প্রফেসর (এমিরেটাস) ডা: সুফিয়া রহমান। তিনি তত্তাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে স্বপ্রনোদিত হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিয়ানীবাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর গাইনী বিভাগে পর্যাপ্ত মেডিকেল সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করে দেন। প্রফেসর (এমিরেটাস) ডা: সুফিয়া রহমান এর বাড়ী বড়দেশ গ্রামে।
দুই. সিলেটের মধ্যে অন্যতম বৃস্তৃর্ণ জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিয়ানীবাজার সরকারী হাসপাতাল। এই হাসপাতালের ভূমিদাতা মখলিছুর রহমান এর বাড়ীও বড়দেশ।
তিন. বাংলাদেশের ঐতিহ্যে টেংরা রাজার দীঘি উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে। যা বড়দেশ গ্রামে অবস্থিত। সিলেট জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওর মুডিয়া হাওর বড়দেশ গ্রামে অবস্থিত; যা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
এই উজ্জততম অঞ্চলের মানুষের নাগরিক অধিকার পূরণ না করে রীতিমতো এভিউজ করা হয়েছে দিনের পর দিন। মানুষের বোধে সহজে ধাক্কা দেয়া যায় না। এই কাজটা আসলে সহজও না। এখানে প্রতারণা করার মতো কলাকৌশল খুবই সীমিত। আল্লাহপাক এই যোগ্যতা মানুষকে অসীম ভাবে দেননি। বড়দেশ গ্রামের মানুষের এই সামাজিক কাজটি দেশ বিদেশে আলোড়ন তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও কম হয়নি। সাথে সাথে এ সংশ্লিষ্ট বিভাগ এলজিইডি এবং বিয়ানীবাজারে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি অমানবিক ব্যবহারটিও মোটাদাগে আলোচনা, সমালোচনা ও মন্তব্যে উঠে আসছে।
পর্যবেক্ষকরা এই গ্রামবাসীর দেয়া ‘ধাক্কা‘র প্রভাব, প্রতিফলন দুভাবে দেখছেন- এক. এইরকম অনুকরণীয় কাজে সমাজের মানুষরা ভালো কাজে উৎসাহিত হবেন।
দুই. জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, ভোটারদের দাবীকে উপেক্ষা, বিদ্রুপ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নিতীবাজ কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতার বিপরীতে অত্যন্ত শ্লীলভাবে ‘আতে ঘা‘ দেয়ার দৃষ্টান্ত বিয়ানীবাজারের জনবান্ধব রাজনৈতিক ও সামাজিকতা চর্চার বিপরীতে ইতিহাসে রেখে যাওয়া ঘটনা।
দেশ সত্যিকার অর্থেই এগুচ্ছে। যদিও মৌলিক অর্থে প্রতিদিন বিশালভারবাহী ঋণের বুঝা বহন করে পা টেনে টেনে আগানোটাও অর্থনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষকদের কাছে প্রবল সমালোচনা মুখর। তবে দেশ এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। এই সচেতন নাগরিকরাই আসলে ভোটার। তাদের হাতেই নেতাদের ক্ষমতা অদল-বদলের ট্রামকার্ড। এই ট্রামকার্ডটাকেই আগামী নির্বাচনে সচেতন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যবহার করা দরকার বলছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
দেশে প্রবাসে বসবাসরত বড়দেশ গ্রামবাসীকে এই অনুকরণীয় কাজের জন্য ধন্যবাদ দিতেই হয়। পাশাপাশি রাস্তার আশপাশের বাসিন্দাদের সচেতন করার উদ্যোগটিও নেয়া দরকার। আশপাশের বাসা- বাড়ির ড্রেনেজ ব্যবস্থাটি সংস্কার করা জরুরী। এখানে জলাবদ্ধতার ৫০% পানি অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি থেকেই ড্রেনে পড়ে বলে সকলেই বলছেন। এইসব পানি যার যার দায়িত্বে সঠিকভাবে ড্রেনে সংযুক্ত করলে এই জলাবদ্ধতাও অনেকাংশে কমে যাবে। নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করা এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকরা অপরাধ ; সে বিষয়েও ঐক্যবদ্ধ কাজ করা প্রয়োজন।
ভালোবাসা, বড়দেশ গ্রামবাসী।
লেখক: কবি, সাংবাদিক