অবশেষে স্বপ্ন হলো সত্যি। উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে গোটা দেশ। স্বপ্ন পুরণের ঝিলিক লেগেছে প্রতিটি মানুষের মুখে। চালু হলো বাঙালির গর্ব পদ্মা সেতু, গতি বাড়ল বাঙালির।
আজ শনিবার (২৫ জুন) বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে লাখ লাখ মানুষের পদচারণা মুখর ও খুশির জোয়ার লাগা প্রমত্তা পদ্মা প্রান্তে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বহুল প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করেন দেশের টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ স্থাপনাটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে উম্মোচন হলো যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দ্বার। খুলে গেলো বহুমুখি অর্থনৈতিক বিকাশের নতুন দিগন্ত। অবসান হলো প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দেয়ার হাজার বছরের দুর্ভোগের। পদ্মার দুই তীরে থেকে আনন্দের জোয়ার দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত প্রবাসীদের মনেও জাগিয়েছে আনন্দ দোলা। এ সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটবে।
শনিবার সকাল ১০টা ৩ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে সেতুর মাওয়া প্রান্তে এসে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন নানা ধরনের শ্লোগান লেখা পোস্টার প্লেকার্ড হাতে সব পেশা আর সর্বস্তরের লাখো লাখো মানুষ। অপেক্ষা করছিলেন দেশ বিদেশের অতিথি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের মাঝে হাসির উষ্ণতা ছড়িয়ে উপস্থিত হলেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন তিনি।
এর আগে ১৫ একর জায়গা জুড়ে প্রস্তুত রাখা হয় বর্ণাঢ্য জনসভা। নারীদের জন্য রাখা হয় আলাদা বসার ব্যবস্থা। তিনটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, সভাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানের দর্শকদের জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর, ৫০০ মাইকসহ অত্যাধুনিক সাউন্ডসিস্টেম স্থাপন করা হয়। উদ্বোধনের আগে থেকেই ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের উভয় পাশে, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের পদ্মাপাড়ের বিভিন্ন স্থানের রাস্তার উভয় পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল সাইজের ছবিসহ নানান ধরনের বিলবোর্ড শোভা পায়। মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার পদ্মাপাড়ের ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত করা হয়।
সেতু উদ্বোধনীর পর জাঁকজমকপূর্ণ সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে গাড়িতে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরে দলীয় জনসভায় অংশ নেবেন তিনি। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে জনসভার জন্য এগারোটি পিলারের ওপর ১০টি স্প্যান বসিয়ে পদ্মা সেতুর আদলেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের ঠিক সামনে পানিতে ভাসছে বিশাল আকৃতির একটি নৌকা। দেখে মনে হয় পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে বড় একটি নৌকা চলছে।
সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয় পুরো দেশে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়। সেতু এলাকায় বসানো হয় র্যাবের ওয়াচ টাওয়ার। নজরদারি চালায় ফুট পেট্রল, মোটরসাইকেল পেট্রোল, বোম স্কোয়াড, ডগ স্কোয়াড। স্পেশাল ফোর্স নিয়ে র্যাবের হেলিকপ্টারও তৎপর হয়। সেতু উদ্বোধনের তিনদিন আগে মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর দুদিকে দুইটি থানার উদ্বোধন করা হয়। সেতুর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এক বছর আগেই জাজিরা প্রান্তে শেখ রাসেল সেনানিবাস উদ্বোধন করা হয়। এক ব্রিগেড সেনা সদস্য রয়েছে সেখানে। গুজব ও অসন্তোষ ছড়িয়ে নাশকতা আশঙ্কায় সারাদেশেই সতর্কতা জারি করা হয়।
উদ্বোধনের দুই দিন আগে গত বুধবার পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) বাংলাদেশের সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে সেতুটি হস্তান্তর করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আবদুল কাদের জানান, সেতুর মূল কাজ শেষ হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষকে বুধবার সেতুটি বুঝিয়ে দেয়। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সেতুর সব কাজ বুঝে নিয়ে ঠিকাদারকে টেকিং ওভার সার্টিফিকেট দেয়। তবে পদ্মা সেতুর অবকাঠামোগত ছোট ছোট কিছু কাজ এখনো বাকি রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আগামী এক বছর ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ হিসেবে কাজ করবে।