আমি যে উপজেলায় বেড়ে উঠেছি, সেই উপজেলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের একটা কমিটি হয়েছে । এই দলের কর্মীদের এই কমিটি ছিল বহু কাংখিত । কারণ প্রায় দুই দশক পর তারা আওয়ামীলীগের একটা উপজেলার নতুন কমিটি পেয়েছে । তাদের ছাত্র সংগঠনের সেই একই অবস্থা ছিল, ছিল যুবলীগেরও। কারণ তাদেরও কমিটি ছিল না। সুতরাং বহুধা বিভক্ত ছিল দলটি। সেই বিশ বছর ধরে কমিটি না থাকলেও সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল। দলের মধ্যে অন্তর্দন্ধ ছিল । অন্তত সাতটি আভ্যন্তরীণ উপদলে বিভক্ত ছিল ছাত্র সংগঠনটি । এ নিয়ে মারামারি এমনকি খুনোখুনিতে নিরীহ মানুষ মারাও গেছে এই কয়েকটি বছরে।
তবুও সবকিছুই হয়েছে । এই দলটি থেকেই এমপি হচ্ছেন, এমনকি একজন মন্ত্রীও ছিলেন দশটি বছর। উপজেলা চেয়াম্যান থেকে শুরু করে পৌর মেয়র সবকিছুই এই দলটির দখলে । যা এখন বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র ।
আলোচনার শুরু করলাম এজন্য যে, দলটির কমিটিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কিংবা বাদ পড়েছেন তাদের অনুভূতি দেখে । যারা কমিটিতে এমনকি একটা সদস্য পদে স্থান পেয়েছেন, তারা কেন্দ্রীয় নেতা, জেলা নেতা, উপজেলা নেতার স্তুতি গেয়ে এমন সব স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যাতে মনে হচ্ছে এ এক পরম পাওয়া। আমিও মনে করি, রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেয়ার মাঝে একটা সন্তুষ্টি কাজ করে । কাজের মূল্যায়ন পেলে রাজনৈতিক কার্যক্রমে আরও বেগবান হয়ে উঠে একজন কর্মী কিংবা নেতা।কিন্তু না, তাদের স্ট্যটাস সেটা জানান দেয় নি। বরং মনে হয়েছে এ যেন কোন এক অর্জন নয়, এ এক বিরাট সম্পদ । অন্যদিকে যারা বাদ পড়েছেন, তাদের দু:খগুলোও তারা খোলাখুলি শেয়ার করেছেন । তা শেয়ার করতে গিয়ে গোটা সংগঠনকে কখনও রাজাকারের কোলে-পিঠে গড়ে উঠা কিংবা অনুপ্রবেশকারীদের ভাগাড়, কিংবা সাংগঠনিক বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে পারিবারিক সম্পদ বানানোর সার্থক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এবং তাতে দেখা যায় একাধিক দম্পতি আছেন ।
স্থানীয় আওয়ামীলীগ কী করেছে, ভুল করেছে না শুদ্ধ করেছে। আরও শক্তিশালী হয়েছে না দুর্বল হয়েছে, তা তাদের দলের আভ্যন্তরীণ একান্ত নিজস্ব সাংগঠনিক ব্যাপার । তাদের সংগঠন কী কার্যক্রমই বলে দেবে তাদের ভবিষ্যৎ ।
বিষয়টা উপস্থাপন করলাম এজন্য যে, মাত্র দু’তিন দিন (১২ জুন) আগে দেখলাম, সিলেটের দুই তরুণকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ । কষ্ট করে হলেও তারা এটা করেছে। এই তরুণদ্বয় দুই ভাই। তাদের একজন মটর সাইকেল চালাচ্ছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ ন্যায়তভাবেই তাদের বেপরোয়া বাইক চালাতে নিষেধ করেছিলেন এবং আটক করেছিলেন, কিন্তু বিধি বাম । তরুণ চিৎকার করে বললেন , ‘আমি ছাত্রলীগ করি। ফোন দিলে তর অবস্থা বেহাল হবে’-এ কথা বলে ট্রাফিক সার্জেন্টের দিকে তেড়ে গিয়ে মারধর শুরু করেন। এতে ট্রাফিক সার্জেন্ট জসিম আহত হন। শুধু তাই না, তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবার সময় পুলিশ কর্মকর্তাকে তরুণ মারধর করে তার ড্রেস পর্যন্ত ছিড়ে ফেলেন । যে পুলিশেরই এক অফিসার ঐ সিলেটেই কোন অপরাধের প্রমাণ না পেয়েও একজন সাধারণ তরুণকে মেরে ফেলেছিলো মাত্র ক’মাস আগে। অথচ দু’তিন দিন আগের সেই পুলিশেরই একজন মা’র খেয়েছেন, তার ড্রেস ছিড়ছে। তিনি সহ্য করেছেন । অসাধারণ । বিষয় কিন্তু একটাই, পুলিশ দ্বিধাদ্বন্ধেই ভুগছিলেন, যদি ঐ তরুণের জন্য ফোন আসে ।
আরেকটা ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। প্রায় সপ্তাহ আগে (৬ জুন) পাবনায় গণপূর্ত ভবনে আওয়ামীলীগের নেতারা অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে গেছেন । কাকে যেন খোঁজাখুজি করেছেন, প্রকৌশলীর টেবিলে অস্ত্র রেখেছেন, তারপর ফিরে এসেছেন । সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, প্রকৌশলী কিংবা অন্যান্য কর্মকর্তাও এতে বিচলিত বোধ করেন নি, তাদের কেউ কেউ বলেছেন, হ্যাঁ, নেতারা এসেছিলেন, তবে তারা কাউকে ভয় দেখান নি।
প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে হাঁটা এবং কারো ভয় না পাবার মানে কি হতে পারে । এর দুটো ব্যাপার আছে । এক, এরকম অস্ত্র নিয়ে এরা প্রায়ই আসেন, এই কর্মকর্তাদের সাথে হাসি মশকারা করেন এবং সেজন্যই হয়ত তারা এ বিষয়টাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছেন । এবং সেজন্য তারা ভীত হন নি ।যদি তা হয়, তাহলে গণপূর্ত ভবন বলি, আর যা-ই বলি না কেন, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পাবনার কিছু কিছু এলাকা হয়ত এই অস্ত্রবাজদের অভয়ারণ্য এবং এটা ঐ অফিসপাড়ায় গা সওয়া হয়ে গেছে সকলেরই। অন্যদিকে আরেকটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার যে, গণপূর্ত বিভাগ কিংবা অফিস পাড়ায় যারা চাকুরী করেন তাদের সবকিছু টিকটাক রাখতে, নিজেদের নিরাপদ রাখতে এই কর্মকর্তাদের কেষ্ট হাসির কোন বিকল্পও নেই ।
যা-ই হোক সিলেটের ঐ দুই তরুণ কিংবা পাবনার অস্ত্রবাজরা ক্ষমতাসীন দলেরই মানুষ । পুলিশের ড্রেস ছিড়ে নেয়ার স্পর্ধা দেখানো চাট্টিখানি কথা নয়।কিংবা অফিস পাড়ায় অস্ত্র উচিয়ে হাঁটা (বৈধ অস্ত্র হলেও) কোন সভ্যতার মাঝেই পড়ে না । এবং আইনের সীমার মাঝেও পড়ার কথা নয় । কিন্তু তারা এটা করেছেন শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের দাপট দেখিয়েই । আমরা বিশ্বাস করি দল তাদের এটা করতে বলে নাই । কিন্তু দল যে তাদের নিষেধ করছে না, তা-ও এসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।
প্রসংগত একটা ভাল সংবাদ এখানে উল্লেখ করছি । সিলেট ৩ আসনের সাংসদ ক’মাস আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন । মারা যাবার পর থেকেই এই আসনের সম্ভাব্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয় দলের অভ্যন্তরে । দৌড়ঝাপ শুরু হয় এই এলাকার কর্মী-নেতাদের। অনেক বাঘা বাঘা নেতা আছেন এই সংসদীয় আসনে । ২৫ জন দলীয় নেতা-কর্মী দলের মনোনয়ন চেয়েছেন । এবং সবকিছু পেরিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন লন্ডন প্রবাসী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক । অন্যান্যদের তুলনায় তিনি বয়সে নবীন, তবে জেলায় তার ছাত্র নেতৃত্বের অবদান আছে একসময় । প্রবাসী হলেও কাজ করছেন এলাকা নিয়ে । এমনকি গত নির্বাচনগুলোতে তিনি প্রার্থী হিসেবে প্রয়াত সাংসদের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতায় থাকলেও দলের সিদ্ধান্তেই তিনি সেই এমপি’র সাথে কাজ করেছেন বলে তাঁর দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে । হয়ত সে কারণেই অর্থাৎ দলের কাছে তাঁর সামগ্রিক দায়বদ্ধতার যে উদাহরণ তিনি দেখিয়েছেন, সেজন্য দলীয় প্রধান শেষ পর্যন্ত তাঁকেই মনোনয়ন দিয়েছেন । স্থানীয় এমনকি আওয়ামীলীগের মনোনয়ন মানেই এই এলাকার এমপি। সুতরাং তিনি এখন প্রশংসার সাগরে ভাসছেন । শুধু তাই না, যুক্তরাজ্যে আবাস গড়া অনেক ডাকসাইটে নেতারা কোমর বাঁধছেন, হয়ত তাদেরও ডাক পড়বে । তারুণ্যের এই উদ্দাম সময়ে । তবে ভাবনায় রাখতে হবে, যুক্তরাজ্যের ঐ ডাকসাইটে নেতাদের কেউ কেউ কিন্তু দুর্বৃত্তায়নের বাইরে নন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন প্রশংসা যখন স্থাবকতায় পৌছে, তখনই শুরু হয় বিড়ম্বনা । প্রশংসাকারীরা তখন দুর্বার হয়ে উঠে । যত্র-তত্র তারা তখন ঐ সিলেটের তরুণের মত ফোনের ভয় দেখায় কিংবা পাবনার মত অস্ত্র দিয়ে মহড়ার সাহস দেখায় ।
তবুও আশাবাদ, এভাবেই পাল্টে যাবে। দুর্বৃত্তায়নের বাইরে থাকা তরুণরা নেতৃত্বে এসে দলীয় প্রধানের মনোনয়ন কিংবা সিদ্ধান্তের যথাযোগ্য সম্মান দেখাবে । মাস্তান আর অস্ত্রবাজদের কাছ থেকে ক্রমেই সরে আসবে দল । দেশ উন্নয়নের দিকেই এগিয়ে যাবে ।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম ।
আরও পড়ুন-