ভ্যাপসা গরমে শাহবাজপুর স্কুল এন্ড কলেজের লাইব্রেরী ভবনের পাশে দাড়িয়ে ঘামছি। আকাশের গায়ে হাসি, মুচকি হাসি কিংবা কান্না কোনটাই নেই। মেঘাচ্ছন্ন ঘোমড়া চেহারা দেখে দেখে অপেক্ষার পালা থামল শিবু দা’র বাইকের হরনে। শাহবাজপুর বাজারের একটি দোকানে ফ্যানের বাতাস আর কোমল পানীয়ের ঠান্ডা পরশের পর বাইকের পিঠে চেপে বসি। শিবু দা আর আমার একসাথে এবারই প্রথম বেড়ানো। আগের দিন ফোনে কথোপকথন, সেই সূত্রে আজ বেরিয়ে পড়া। যাব দূর পাহাড়ের সীমান্ত জনপদ পাল্লাতল।
বড়লেখার দিকে চলে যাওয়া সড়ক থেকে বায়ে মোড় নিয়ে চিকন পথ। একপাশে বনঘেরা পাহাড়, আরেকপাশে জলার ঘাসবন। পাহাড়ী মুলি বাঁশে ছাওয়া সিড়ি হলদেটে মাটির পথ বেয়ে ওঠে গেছে কোনো টিলার মাথায়। পথের পাশে পাম গাছের বাগান দেখে থামলাম। পাম গাছের কোনটিতে ফুল এসেছে। কান্ড থেকে বেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে গুচ্ছফুল। অনেকটা কেয়াফুলের মত। পাম বাগানের পাশ জুড়ে পড়ে থাকা একটি সেতুর ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। বুড়াগুল নামের এই সেতুর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর স্থানীয় ক্যাম্প ছিল শাহবাজপুর বাজারে। তাদের অস্ত্রের মজুদও ছিল সেখানে। সীমান্ত এলাকার দিকে পাক বাহিনীর অভিযান রুখে দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালিয়েছিল এই সেতুর ওপর। তবে শক্তিশালী বিস্ফোরক না থাকায় সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। পাক বাহিনী তখন ক্ষতিগ্রস্থ সেতুর ওপর কাঠের তক্তা ফেলে পারাপার হতো। তবে যুদ্ধের শেষ দিকে পালানোর সময় পাক হানাদাররা শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস করে যায়। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা সহজে তাদের ধাওয়া করতে না পারে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ফেলে এসে সামনে পড়ে অহিদাবাদ চা বাগান। দুপুরবেলা ঘেমে নেয়ে চা পাতা চয়নে নারী চা শ্রমিকদের বেশ ব্যস্ততা চোখ কাড়ে। কাজের ফাঁকে কেউ আবার ছাউনিতে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। চা বাগানের পর সামনে পড়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে কেটে বানানো পথ। সেই পথে ডাউনহিল ধরে আচমকা মোড় নিয়ে নেমে আসতে চোখের সামনে দৃশ্যপটে এসে দাড়ায় রাবার বাগানে সারি। আঁকাবাঁকা পথের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে খাসিয়া পুঞ্জি দেখে থামলাম। বেরেঙ্গা পুঞ্জি দাড়িয়ে আছে বড়সড় এক পাহাড়ের চূড়ায়। বাইক থেকে নেমে চারপাশে চোখ বুলিয়ে আনমনে দাড়িয়ে থাকি কিছু সময়। মনের চোখ তখন খুঁজে ফেরছে পেছনের কিছু স্মৃতি। প্রায় সতের বছর আগে সাইক্লিং করে স্কুল পড়ুয়া তিন কিশোর এসেছিল এখানে।
শৈশবের বন্ধু ফরহাদ আর মসকুরের সাথে সেদিন বাইসাইকেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। ফেরার পথে মুড়িয়া হাওরে পড়েছিলাম ঝড়ের কবলে। বেরেঙ্গা পুঞ্জির পর বিস্তীর্ণ পাহাড়ের গা জুড়ে জংলী কাঁশের ঝোপ। এই কাঁশের বেশ কদর। এর ফুল থেকে বানানো হয় ফুলঝাড়–। যার স্থানীয় নাম- টালির ফুরোইন। পাহাড়ের ওপরে উঠে যাওয়া পথের পাশে পাহাড়ী ঝিরি। পথ আর ঝিরির মাঝে ঝোপ জঙ্গলের ঠাস বুনোট। ঝিরিতে নামতে গিয়ে তাই বেশ বেগ পেতে হল। স্বচ্ছ পানির স্রোতে নুঁড়ি পাথর দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে। পানির তলায় পঁচা কাঠের নিচ থেকে কুচকুচে কালো কিছু একটা বেরিয়ে আসতে দেখি। ভাল ঠাহর করতে দেখি, এ যে বড়সড় একটি চিংড়ি! একটু পর পাথরের খাঁজ থেকে বেরিয়ে আসে আরো কয়েকটি চিংড়ি। কালো আর লাল রংয়ের চিংড়ি গুলোর মাথার দিকে শিকারকে আঁকড়ে ধরার জন্য কাঁকড়ার মত ধারালো চিমটে।
ঝিরি থেকে ফিরে পাহাড়ের ভেতর হয়ে নেমে এসে সামনে পড়ে পাল্লাতল চা কারখানার প্রবেশ পথ। কারখানার কর্মকর্তা অঞ্জন দা শিবু দা’র পূর্ব পরিচিত। চা বিস্কুটে তার আতিথেয়তা গ্রহণের পর আমরা ঘুরেফিরে দেখতে থাকি। পাল্লাতল চা কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল প্রায় শতবর্ষ আগে, ১৯৩৪ সালে। কারখানার নিমার্ণশৈলীতে তাই ব্রিটিশ ঘরানার ছাপ। নির্জন এই জায়গাটি তখন কতই না গহীন ছিল জানি! ভেতরে চা পাতা গুড়ো করার কাজ চলছে। স্তুপ করে রাখা গুড়ো চা পাতার বস্তা। খালি চোখে দেখা না গেলেও শ্বাস টানতে বাতাসে চা গুড়োর ঘ্রাণ বুঝা যায়।
কারখানা থেকে বিদায় নিয়ে আবারও চলতে থাকি। থামলাম গিয়ে পাল্লাতল খাসিয়া পুঞ্জি। একটি মিশনারি স্কুল পুঞ্জির টিলার নিচে। পাকা সিঁড়ি খাড়া পথ বেয়ে ওঠে গেছে পাহাড়ের চূড়ায়। সেই চূড়াতেই পুঞ্জি। উঁচুনিঁচু পথ পুঞ্জির ভেতর। মাটির দেয়াল আর টিনের চালার কুটির। তবে মাচাঘর কোথাও নেই, সবগুলো ঘরের ভিত্তি মাটির ওপর। এরকম একটি ঘর থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এলেন এক খাসিয়া তরুণী। তাকে দেখে শিবু দা’র চেহারাও হাসি হাসি হয়ে ওঠল! অ্যাঞ্জেলিনা দিদি শিবু দা’র পূর্ব পরিচিত। তার ঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। নিজের জুমের পান সুপারির থালা বাড়িয়ে দেন। তার সংসার চলে এই পান সুপারিতে। স্বামী সহ পানজুমে কাজ করেন। সীমান্ত বিনিময় চুক্তির ফলে তার চারটি পানজুমই চলে গেছে ভারতের সীমানায়। তবে চুক্তির শর্ত মোতাবেক সীমান্তের ওপারে হলেও বললেন পান চাষে সমস্যা হয়না।
পুঞ্জির মন্ত্রীর ঘর থেকে ফেরার পথে পাতার ফাঁকে ঝুলে থাকা পাকা পেয়ারা দেখে পাড়তে মন চাইল। কাঠবিড়ালি আর বুলবুলি গাছের শাখা মাতিয়ে রেখেছে। ঝোপের কাছে খুঁজে একটা শুকনো বাঁশের লাটি পেলাম। তার সাথে বুনোলতা দিয়ে কাটি বেঁধে আংটার মত বানিয়ে চলে পেয়ারা পাড়ার ফন্দিফিকির। বেশ কসরত করে তিন চারটে পেয়ারা পাড়লাম বটে; তবে সেগুলো পড়েছে টিলার ঢালের নিচে ঝোপজঙ্গলের ভেতর। বিফল মনোরথে নেমে আসার পথে ঝোপের পাশ থেকে কে যেন বেরিয়ে এলো! দু’হাতের মুঠোয় ভরে ঝোপের ভেতর পড়া পেয়ারাগুলো নিয়ে দাড়িয়ে আছে থেইচেন। ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া থেইচেন অ্যাঞ্জেলিনা দিদির মেয়ে। পুঞ্জিতে সে আমাদের নিয়ে ঘুরলো। থেইচেনের মায়ের বাড়ি আর মামার বাড়ি পাড়ার এমাথা ওমাথায়।
পুঞ্জি থেকে নেমে অমসৃণ এবড়োথেবড়ো পথে কিছুদূর গিয়ে সামনে পড়ে বেশ বড় এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে কেটে খাড়া এক ফালি পথ বানানো হয়েছে। মাত্র কয়েক ফুট চওড়া। পথের ওপরে খাড়া দেয়াল পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়া গাছপালা আর জংলীলতা দুইদিক থেকে ঢেকে দিয়েছে। সেই বুনোট ভেদ করে সূর্যের আলো নিচে মাটি স্পর্শ করতে পারেনি। পাহাড়ের ভেতরে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পথটি অনেকটা সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেছে তাই। বালু পাথরের সাথে চাকার ঘর্ষণের আওয়াজ মাড়িয়ে সুড়ঙ্গ পথটি থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে যায় খাসিয়া সম্প্রদায়ের দুইজনের সাথে। কুবিনাল আর সূর্য দা পাহাড়ে পানের বরজে কাজ সেরে পাড়ায় ফিরছে। টুকটাক গল্প আর ছবি তোলার পর- যাওয়ার পথে যেন তাদের পাড়ায় পান খেয়ে যাই সেই নিমন্ত্রণ করল। তাদের থেকে বিদায় আর ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে আবারও চলতে থাকি।
এরপর পথটুকু জনমানবহীন। পাহাড়ের বাঁক ঘুরে আবার শুরু হয়েছে চা বাগান। যেতে যেতে যতদূর চোখ যায় সেই একই ছবি একই রং- চা বাগান আর নানা বর্ণের সবুজ! এক সময় ক্লান্ত দেই আমরা। ফেরার পথে অহিদাবাদ চা কারখানায় একটু ঢুঁ মারলাম। কারখানার উঠোন জুড়ে চয়ন করে আনা কাচা চা পাতার স্তুপ।প্রক্রিয়াজাত করার জন্য সেখান থেকে শ্রমিকরা ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছে শেডের ভেতর। কথা হয় একজন টিলা বাবুর সাথে। কারখানা, চা আর বাগান সম্পর্কে জানা হয় নানা কিছু। তারপর সেখান থেকে ফেরার পথ ধরি ব্যস্ত কারখানার হৈচৈ পেছনে ফেলে।
কিভাবে যাবেনঃ পাল্লাতল যেতে প্রথমে আসতে হবে বড়লেখায়। বড়লেখা বা শাহবাজপুর বাজার থেকে পাল্লাতল চা কারখানা পর্যন্ত রিজার্ভে সিএনজি অটোরিক্সা পাবেন। রাতের থাকার জন্য কিছু হোটেল পাবেন বড়লেখা বাজারে।
ছবি: লেখক
শিমুল খালেদ : কর্মকর্তা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, সিলেট শাখা ও সদস্য,বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন।
আরও পড়ুন: