খেয়া নৌকায় নদী পার হলেই হাঁটা পথ। ধূলাময় মেঠোপথ ধরে হেঁটে এগুলেই ছোট একটি সেতু। তার পাশে গাছতলায় একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসি। দুইপাশে বিস্তৃত পাকা ধানক্ষেত। সঙ্গী জুবায়ের আঙ্গুলের ইশারায় একটা ধানিজমি দেখিয়ে বলল, ‘ঠিক এই জায়গাটিতে বাঘ মারা হয়েছিল!’ শুনে অবাক হয়ে বললাম ঘটনা খুলে বলতে।
শীতের শুরুর দিকের ঘটনা। এক রাখাল বেরিয়েছিল গরুর খোঁজে। আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নলখাগড়ার ঝোপে চোখে পড়ে কিছু একটার নড়াচড়া। গরু মনে করে এগিয়ে যায় সে। তার পরই চক্ষু চড়কগাছ! ভীতসন্তস্ত্র চেহারায় ছুটে গ্রামে পৌছে খবর দেয়, নলখাগড়ার ঝোপে বাঘ লুকিয়ে আছে। দ্রুত সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে চারপাশ থেকে ঝোপটিকে ঘিরে ফেলা হয়। বাঘটি আর পালাতে পারেনি। শিকারের খবর শুনে কয়েক মাইল হেঁটে ওরা দেখতে এসেছিল। ওর গল্প শুনে মনে পড়ল কয়েক বছর আগে এই এলাকায় বাঘ ধরা পড়েছিল। পত্রিকায় বেরিয়েছিল খবরটা।মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা উপত্যকার নুনাছড়া চা বাগানে ধরা পড়েছিল বিরল প্রজাতির একটি ব্ল্যাক প্যান্থার। সিলেটের কানাইঘাটের লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল। চিতা বিড়াল ধরা পড়ার খবরও পত্রিকায় পড়েছিলাম কিছুদিন আগে। বিশ্রাম শেষে আবার হাঁটতে শুরু করি।
বন্ধু জুবায়েরদের আরেকটি বাড়ি ডোনা উপত্যকার গহীনে। সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি এলাকার বাড়িটিতে পরিবারের কয়েকজন থাকেন। কয়েক মাইল চড়াই উৎরাই ট্রেইলের হাঁটা পথ। বাড়িতে বাড়িতে আছে কমলার বাগান। ভাগ্য ভাল হলে বন্যপ্রাণী দেখার সুযোগ হতেও পারে। এতোসব শোনার পর আর তর সইছিল না! এক সকালে বেরিয়ে পড়ি আমরা। ধূলাময় মেঠোপথ, পাথরের বোল্ডার ছড়ানো বন্ধুর ট্রেইল, জলাভূমির নলখাগড়ার ঝোপ, ধানক্ষেতের আল, নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে ক্লান্ত শরীরে ওদের বাড়িতে পৌছলাম।
দেশি মুরগের সুস্বাদু তরকারিতে পেটপুরে খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম। সন্ধ্যার পর চাচার খাটে লেপের ভেতর আয়েশ করে বসলাম বাঘের গল্প শুনতে। বছর পঞ্চাশেক আগেও রাতবিরাতে এখানে প্রায়ই বাঘের গর্জন শোনা যেত। সন্ধ্যার পর কেউ খুব একটা বাইরে বের হতো না। এখনো বাঘের আনাগোনা কদাচিৎ শোনা যায়। সীমান্ত একেবারে কাছে হওয়ায় মেঘালয় পাহাড় থেকে বাঘসহ বন্য প্রাণীরা নেমে আসে। কিছুদিন আগেও পাহাড়ের ঢালে ভোরবেলা বাচ্চাসহ মা হরিণকে ঘাস খেতে দেখা গেছে। মেঘালয় পাহাড়সংলগ্ন কানাইঘাট উপজেলার এসব এলাকা এক সময় ছিল জৈন্তিয়া রাজ্যের অধীন। পাহাড়, টিলা, ঝোপ-জঙ্গল আর উপত্যকার নলখাগড়ার বনে ঘেরা এলাকায় শীতকালে বাঘ নেমে আসত। রাজার আদেশে তখন বাঘ মারতে পারা ছিল দারুণ বীরত্বের ব্যাপার। বাঘ শিকারের আয়োজন হতো ঢাকঢোল পিটিয়ে। আশার কথা, সেই চল এখন আর নেই। এলাকায় বাঘ আসার খবর পেলে জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে ধরা হয়। এই পদ্ধতির নাম ‘বাঘ কেওড়’।
পরদিন ঘুম ভাঙ্গল বেশ সকালে। পুব আকাশ ফুঁড়ে সূর্যের আলো সবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে উপত্যকার বুক জুড়ে। শিশির ভেজা ঝরাপাতা মাড়িয়ে ওঠে গেলাম ওদের বাড়ির পেছনের টিলার চূড়ায়। টিলাময় সুপারিগাছের বাগান। ভেজা ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে আছে ঝরে পড়া পাকা সুপারি। কমলার পাতাও শিশিরে নেয়ে চিকচিক করছে। টিলার পূর্বপাশে যেখান থেকে ঘন জঙ্গল ঢাল বেয়ে নেমে গেছে, সেখানে খানিকটা ফাঁকা। সে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জানাল, এ জায়গাটিতে একটি ছাগল বাঁধা ছিল। টিলার নিচে পুকুরপাড়ে বসে গল্প করছিল ওরা কয়েকজন। হঠাৎ ছাগলটির গগনবিদারী আর্তনাদ। তার দৌড়ে এসে দেখে, ছাগলের গলা কামড়ে ধরে আছে একটি বাঘ! তাদের দেখে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাড়ায় বাঘটি। তারপরই ঝাঁপ দেয় ঝোপের ভেতর। গলায় রক্তের দাগ রেখে ততক্ষণে অবশ্য মারা গেছে ছাগলটি।
গা শিউরানো সেই গল্প শুনতে শুনতেই নিচে উঠান থেকে চা-নাস্তার হাঁক। নাস্তা শেষ হলে গাছ থেকে কমলা পাড়ার তোড়জোড় পড়ে। গাছে চড়ে বাঁশের কাটি দিয়ে টেনে টেনে ডাল থেকে কমলা পেড়ে রাখা হয় ঝুড়িতে। কিছু কমলা একটু ঝাঁকুনিতেই ঠুস করে খসে পড়ে মাটিতে। ফাটা খোসার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে টসটসে তাজা রস। গাছতলায় বসে তাজা কমলার স্বাদ নেই আমরা। কমলা বাগানের পরই টিলার ন্যাড়া পাদদেশ।
জমিটিতে এক সময় আনারস বাগান ছিল। রাতে সজারু, বন্য শূকর আর দিনে বানরের পাল পুরো বাগান সাবাড় করে ফেলেছে। শূকরের উৎপাতে কচু, আনারস এসব কন্দজাতীয় উদ্ভিদ এখানে চাষ করা মুশকিল। তবে বন্য শূকর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ধানের। ধান পাকার সময় তাই ক্ষেতের মাঝে মাচাঘর বানিয়ে রাতের বেলা পাহারা দেয় এখানকার বাসিন্দারা।
পরের গন্তব্য রাতাছড়া খাসিয়াপুঞ্জি। পথে দূর থেকে চোখে পড়ে পুঞ্জির পাহাড়ে মাথা উঁচু করে থাকা সুপারি বাগান। হলদেটে মাটির পথ উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। খাসিয়াদের তকতকে পরিষ্কার ঘর-বারান্দা। পথের মাঝে একটি গির্জা। পাশে বড় বড় পাথরের চাঁই। চঞ্চল খাসিয়া শিশুরা আপনমনে খেলছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। নানা জাতের পাহাড়ি ফুল, লম্বা লেজ আর ঝুটির মোরগ, পানের বরজ আর কথাবলা পোষা পাহাড়ি টিয়া মন জুড়িয়ে দেয়।
বিকালবেলা বের হলাম ডোনার একমাত্র বাজারের উদ্দেশে। সন্ধ্যার পর বাজারটি বেশ জমে ওঠে। গরম পিয়াজু আর চায়ের কাপে শীত তাড়ানোর সাথে গল্প জমে ওঠে। জানলাম একজনের সুপারি বাগানে বুনো খরগোশ চরার কথা। ফেরার সময় একটি টিলা দেখিয়ে সে জানাল, বছর কয়েক আগে টিলার জঙ্গল থেকে কাঠ আনতে গিয়েছিল এক কিশোর কাঠুরে। ঝোপ কেটে ঢুকে পড়েছিল গভীরে। হঠাৎ বুনো কলার ঝোপের ভেতর কিছু একটার ফুঁসফুঁস ঘঁরঘঁর শব্দ শুনে দৌড়ে নেমে আসে। ঘটনার পর ওইদিকে সবাই সাবধানে চলাফেরা করত অনেকদিন।
রাতে খেয়েদেয়ে ঢালুপথ ধরে গেলাম বাড়ির নিচে পুকুরের পাশে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। শীতের রাতে ঘুমিয়ে পড়া পাহাড়ি জনপদ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসে নাইট জার্সের চৌঙ্ক চৌঙ্ক ডাক। পুকুর পারের পরপরই ঘন জঙ্গল নিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে পাহাড়ের ঢাল। টুকটাক গল্পের ফাঁকে হঠাৎ ঢালের পাদদেশ থেকে কুকুরের জোরালো চিৎকার। জুবায়ের কানখাড়া করে দাড়িয়ে পড়ে। কুকুরের অনবরত ডাক ভেদ করে পাহাড়ের ভেতর থেকে আসে শুকনো পাতা মাড়ানোর চড়চড় চড়াৎ চড়াৎ শব্দ। এবার সে হাতে হ্যাঁচকা টান দিলে দৌড়ে উপরে উঠে আসি। মনের ভেতর আতঙ্ক আর রোমাঞ্চ নিয়ে সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ি একসময়।
কিভাবে যাবেনঃ বাসে কিংবা ট্রেনে সিলেট এসে তারপর জকিগঞ্জগামী বাসে আটগ্রাম বাজার। সেখানে সুরমা নদীর খেয়াঘাটে খোঁজ করলে গাইড পাওয়া যাবে। থাকার সুব্যবস্থা নেই তাই দিনে দিনে ফিরতে হবে।
লেখক : ভ্রমণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা।
shimulkhaledbd@gmail.com