জাগো নিউজের (২৫ ডিসেম্বর) একটা রিপোর্ট বলছে, ‘নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোতে প্রাণ চাঞ্চল্য নেই’। পোর্টালটির বিশেষ সংবাদদাতা ঢাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লা ঘুরে দেখেছেন, দেখেছেন পুলিশ বসে বসে পপকর্ন খাচ্ছেন। কোন কর্মতৎপরতা নেই তাদের।
এই নিউজটা দেখে ব্রিটেনের নির্বাচনগুলোর চিত্রই আমাদের সামনে উঠে আসতে পারে। ব্রিটেনের নির্বাচন এলে দেশের মানুষগুলো চোখ রাখে টিভি আর কাগজগুলোতে। কোন উত্তাপ নেই, নেই কোন নির্বাচনী ডামাডোল। সকালে, দুপুর কিংবা বিকেলের কোন এক সময়ে বাসার পোস্টের ফোড়ায় দল কিংবা প্রার্থীর সমর্থনে কিছু লিফলেট এবং আগামীর কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের সার সংক্ষেপ পাই আমরা।
এখানে দলের আমলনামাই আগামীর কাণ্ডারি নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। স্থানীয় প্রার্থী নির্বাচনেও দলগুলো কঠোর নীতিমালাই অবলম্বন করে পার্টির অভ্যন্তরে। একজন প্রার্থীর জন্য দল যাতে সমালোচিত না হয় সেটি ভেবেই মনোনীত করা হয় দলের প্রতিনিধি। এবং গোটা দেশেই দলের মেনুফেস্টোই ভোটারদের আকৃষ্ট করে। এবং সেজন্যে দেখা গেছে, দলীয় ইশতেহার জনগণের মনের সাথে মিলাতে না পারলে নিজ দলেও যে নেতারা বিমুখ হন তার প্রমাণ ব্রেক্সিট নিয়ে গত গণভোট। লেবার কনজারভেটিভের বাঘা বাঘা অধিকাংশ নেতাই ব্রেক্সিটের বিপক্ষে গিয়েও ব্রেক্সিট রক্ষা করতে পারেন নি। সেজন্যে একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগও করতে হয়েছিলো তার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে।
জাগো নিউজের রিপোর্টের প্রতিধ্বনিই শোনেছি গত এক সপ্তাহ আগে। বাংলাদেশের প্রভাবশালী একটা জাতীয় দৈনিকের বার্তা সম্পাদকের সাথে নির্বাচন নিয়ে আলাপ করেছিলাম। বলেছিলেন, উত্তাপ নেই নির্বাচনে। ঢাকার মতো শহর অর্থাৎ খোদ রাজধানীতেই নেই ভোট নিয়ে কোন বড় ধরনের ক্যাম্পেইন। আমাদের এলাকা সিলেট -৬ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নির্বাচন করছেন।
আওয়ামী লীগের এক নেতার সাথে কথা হলো , ক্যাম্পেইন হচ্ছে। কোন কিছুতেই যেন কোন সাড়া শব্দ নেই। সভা-সমাবেশ হচ্ছে, তবে নিরুত্তাপ। সেখানে মহাজোট আর ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী বসে নেই। তারা হাঁটছেন, যাচ্ছেন ভোট যুদ্ধ জয় করতে নয়। ভোট শুধু চাইতে যাচ্ছেন তারা নেতাগোছের মানুষের বাড়ি বাড়ি। এবং তারা যে বিজয়ী হবেন, এটা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করেন।
সহজ কথায় ৩০ তারিখের নির্বাচন ঘিরে চলছে উত্তাপহীন ক্যাম্পেইন। ২০০৮ সালের পর বলতে গেলে এটাই বাংলাদেশের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
রাজনৈতিক ভুল-ভ্রান্তি কিংবা হঠকারিতায় ২০১৪’র সংসদ নির্বাচনে ভোট কিংবা ভোটারের অংশগ্রহণ ছিলো না। সে হিসেবে এবারের সংসদ নির্বাচনে একটা আকাঙ্খা মানুষের মনে কাজ করেছিলো। কিন্তু সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন নেই। নির্বাচনী মাঠ নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে তাদের নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকতে দিচ্ছে না নিরাপত্তা বাহিনী।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বামগণতান্ত্রিক জোটও প্রকাশ্যে পুলিশ-র্যাবের সমালোচনা করছে। তারা অভিযোগ করছে পুলিশ একটা বিশেষ দলের হয়ে কাজ করছে। প্রতিদিন প্রতিরাতে বিরোধী দলের শত শত কর্মী বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করা হচ্ছে। তারা দাবি করছেন, নির্বাচন কমিশনও তালগাছের মতো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
২৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন ঐক্যফ্রন্টের প্রধানসহ নেতৃবৃন্দ। কিন্তু একটা অসফল আলোচনা হয়েছে তাদের। হয়ত রাগে-ক্ষোভে ড. কামাল খেই হারিয়ে ফেলেন এবং পুলিশকে ‘জানোয়ার’ বলে সম্বোধন করে নির্বাচন কমিশনারকে এদের থামাতে বলেন। ড. কামালের অভিযোগের হয়ত ভিত্তি আছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা সারা দেশেই গেপ্তারের শিকার হচ্ছেন। এমনকি যেদিন ইসি‘র সাথে তাদের বাক-বিতন্ডা হয়েছে, এদিনই গণফোরামের নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
হাস্যকর হলেও এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে যে, তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগও আছে। বিএনপি বার বার অভিযোগ করছে তাদের মাঠে নামতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের এ অভিযোগ সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় শুধু ‘নালিশ’হিসেবে ধরে নিলেও এটা বলতেই হবে প্রতিপক্ষ মাঠে না থাকলে কোন খেলাই জমে উঠে না।
ইসি‘র সাথে ঐক্যফ্রন্টের আলোচনায় নির্বাচন কমিশনার একে এম নুরুল হুদা তার জায়গায়ও নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি অপমানই করেছেন ড. কামাল হোসেনকে। কিন্তু বর্ষীয়ান কামাল একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হয়েও নিজেকে কিন্তু আটকে রাখতে পারলেন না।
সভায়-সমাবেশে এমনিতেই তারা পুলিশ তথা নিরাপত্তা বাহিনীদের তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। ঐ পুলিশদের আইনের মাধ্যমেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন এবং সেজন্যেই তারা ইসির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু বিচার চাইতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে গালি দিলে এটাতো আর বিচার থাকে না। আর বিচার প্রার্থী যদি বিচারকের কাছে অন্য পক্ষকে গালি দিয়েই থাকেন, তাহলে প্রতিপক্ষের পক্ষ নিয়ে ঐ বিচারপ্রার্থীদের অপমান করাতো বিচারকেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যা নির্বাচন কমিশনার করেছেন। হয়ত অজান্তেই এখানে ইসি নিজেকে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট করে তোললেন।
নির্বাচন কমিশন এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ককে আরও উসকে দিলো ড. কামাল হোসেনের সাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাক-বিতন্ডা।
প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীদের উপর এমনিতেই ক্ষেপে আছে বিরোধী দল। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন একটু কঠোর হলেই পারে। বাংলাদেশের নির্বাচনতো আর ব্রিটেনের নির্বাচন নয়। এখানে মিছিল-সমাবেশ এবং এর অনুষঙ্গ হিসেবে হাঙ্গামা থাকবেই। কিন্তু মামলা কিংবা ধড়-পাকড় রোধে ব্যবস্থা নেয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।
প্রতিদিন যেভাবে আটক-গ্রেপ্তারের জালে আটকা পড়ছে কর্মীরা, সে হিসেবে নির্বাচন উত্তাপহীন থাকাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের নির্বাচনের সংস্কৃতি যেহেতু উৎসবের, সেখানে যদি কোন আমেজই না থাকে এবং মামলা-হাঙ্গামায় শুধু বিরোধী দলীয় কর্মী-নেতারা রক্তাক্ত হয়, তাহলে নির্বাচন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠবে না। নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল কিংবা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে কথা বলতে শুরু করেছে। নির্বাচনের সহিংসতার আশংকায় ব্রিটেন সতর্কতা জানিয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুপা হক ইতিমধ্যে তাঁর এক প্রবন্ধে কমনওয়েলথের সংযুক্তির মধ্য দিয়ে অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্রিটেন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক একটা অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান নিয়ে সমালোচনা করেছেন এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ দেখিয়েছেন। পূর্বে পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে না আসার কথা উল্লেখ করলেও দেখা যাচ্ছে, খোদ আমেরিকা থেকে অন্তত ৩২ মার্কিন পর্যবেক্ষক দল যাচ্ছে। নির্বাচনী মাঠ ঘুরে ঘুরে দেখতে রাজধানীর বাইরে যেতে আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকরা।
শত কূটনীতিক ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা সরকারের কাছে যথাযথ নিরাপত্তাও চাইছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনও ঢাকার আশেপাশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় উত্তাপহীন নির্বাচনী মাঠই বিদেশীদের এই আগ্রহ বাড়িয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। যেহেতু আমেরিকা ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী, সে হিসেবে এদের এ পর্যবেক্ষণের গুরুত্বও ছোট করে দেখার কোন উপায় নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন কংগ্রেসের প্রস্তাবনাকেও খুব একটা হালকা হিসেবে আমরা নিতে পারি না।
কংগ্রেস তাদের এক পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের সাথে মিলে দেশটির মানবাধিকার সুরক্ষা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র সুসংহত করণে কাজ করে যাচ্ছে, তাই বর্তমান সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি ও দেশটির অস্থিতিশীল পরিবেশে আমেরকিা উদ্বিগ্ন হিসেবেই তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া অনেক কিছুতেই ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সাহসের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই প্রত্যাখ্যাত হবার প্রতিশোধ নিতে একটা সুযোগ তারা নিতে চেষ্টা করতেই পারে এ নির্বাচনকে সামনে রেখে। নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলে তারা সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মার্কিনী অবরোধ দেয়ার চেষ্টা চালাতে পারে বলে কংগ্রেসের প্রস্তাবনার খবর চাউর হয়েছে।
বাংলাদেশ তার স্বাধীন সার্বভৌমত্ব নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ সময়টাতে। দেশটার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বলে প্রচার আছে সারা পৃথিবীব্যাপীই। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছিয়েছে বিগত সরকার। নিজ শক্তি দিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিগত দিনগুলোতে দৃঢ় অবস্থান নেয়ায় বাংলাদেশ ভিন্ন মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু এরপরও অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার নিয়ে কোন কোন দেশের সমালোচনা জোরেশোরে উচ্চারিতও হচ্ছে। আর তারই হয়ত প্রকাশ মার্কিন কংগ্রেসের উষ্মা কিংবা ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত এমপি রুপা হকের প্রবন্ধ।
ব্রিটিশ নির্বাচনের মতো নিরুত্তাপ নির্বাচন হবে আমাদের এ আশাবাদ করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন উৎসবমুখর হওয়াটাই ছিলো জনগণের আকাঙ্খা। সে কারণেই বলা যায়, সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
কমিশন একটু কঠোর হলেই নির্বাচন আন্তর্জাতিভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া কোনভাবেই অসম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদ কিংবা সরকার এ বিষয়টাতে একটু নজরদারি বাড়ালেই কাঙ্খিত নির্বাচন পেয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ এ বিশ্বাসটুকু আমরা রাখতেই পারি।
ফারুক যোশী : কলামিস্ট, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।