পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘট একটা আতংকের নাম। দেশে সম্ভবত এই একটা ক্ষেত্র আছে, যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের নিত্যদিনের টিকে থাকাটা সম্পর্কিত। বিরোধী দলের হরতাল অনেক সময় মানুষ শতস্ফুর্তভাবে নেয় না। তবুও ভয়ে-আতংকে কিংবা দলীয় কর্মীদের সমর্থনে হরতাল সার্থক হয়ে যায়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা হরতালে সত্যিকার একটা দেশ অচল হয়ে উঠে।
যখন বিরোধী দল তাদের দলীয় কর্মসূচী হিসেবে জাতির কথা বলে হরতাল ডাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকার হরতাল-অবরোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক ছুতো খোঁজে পায়। কত শত-হাজার কোটি টাকা একটা হরতালে দেশ ও জাতির ক্ষতি হয়, কত শ্রমিক কাজ করতে না পারায় তাঁদের বাসায় হাড়ির নীচে আগুন জ্বলে না প্রভৃতি শব্দে আবেগ উছলিয়ে তোলা হয়।এ আবেগকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। কারণ একটা অবরোধ কিংবা হরতালে সত্যিকার অর্থেই শ্রমিক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষের একটা দিনকে ভাবলেশহীন তিথে করে তোলে। তাছাড়া অতীতের কিছু আন্দোলনতো জ্বালাও-পোড়াও’র মধ্য দিয়ে মানুষের নির্মম মৃত্যুও ‘নিশ্চিত’ করেছিল, জ্বালিয়েছিল জীবন্ত মানুষদের।
সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সেরকম আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুখকর নয় সেকারণে হয়ত বিএনপি‘র সরকার বিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনগুলো এখন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। সেজন্যে যখন সরকারী পক্ষ থেকে বলা হয়, জনগণের পেটে লাথি মারার আন্দোলন তারা চলতে দিতে পারেন না। আর জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বের পুলিশ-র্যাবকে মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়, তখন একধরণের করুণা পেয়েই যায় সরকার।
এসব আবেগী কথা বলে কিংবা আন্দোলন-সংগ্রামের নেতিবাচক দিক তোলে ধরে এমনকি অত্যন্ত যুক্তিসংগত আন্দোলনকে দমন করতেও উঠে পড়ে লেগেছে সরকার বিভিন্ন সময়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ধোঁয়া তুলে কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের মত সার্বজনীন ইস্যু’ গুলোকে বিপরীত ধারায় নেয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে কিভাবে, তা দেখেছে বাংলাদেশ। এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মদতে লাঠিবাহিনী, হাতুড়ীবাহিনী দিয়ে কিভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসাজসে এসব আন্দোলনকে ঠেঙ্গিয়ে বিদায় করার চেষ্টা চালানো হয়েছে, তাও দেখেছে সারা দেশের মানুষ।
জাতি এবার দেখলো অন্যরকম আরেকটি আন্দোলন। শ্রমিক শব্দটার সাথে আবেগ জড়িত। খুবই স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকদের দাবী-দাওয়াকে প্রাধান্য দেয়াটা মানবিক একটা ব্যাপারও। পরিবহন শ্রমিকের নিজস্ব দাবী দাওয়া নিয়ে তাঁরা মাঠে নেমেছে। জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাশ হওয়ার প্রতিবাদে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘঠ পালনের ডাক দিয়েছিলেন। তারা এ আইন সংশোধনসহ ৮ দফা দাবি দিয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্যে গতকাল সারা দেশ অচল হয়ে যায়, আজ সোমবারও অচল।
এই অচলাবস্থায়ও বিশেষ প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার প্রয়োজনে কেউ কেউ গাড়ি ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই চেষ্টাকে দমন করতে শ্রমিক নামধারী ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী যে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে. তা দেশবাসী দেখেছে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায় এক শিশুও মারা গেছে এই শ্রমিকদের এগুয়েমির কারণেই। তাই মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে, এসময় সরকারী নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল ? লুঙ্গি পরিহিত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে সন্ত্রাস চালানো যে যুবক, সে-তো পুলিশের সামনেই তা করেছে । পরিবহন শ্রমিকদের নাম নিয়ে চালানো সন্ত্রাসে অভিনব নির্যাতন চালিয়েছে তারা। গাড়ির চালক, সাধারণ মানুষ, নারী, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের গালে-গায়ে-পোষাকে কালো মবিল, আলকাতরা লেপ্টে দিয়েছে ঐ সন্ত্রাসীরা ।
নারীদের কপালে লেপেছে কালিমা, অথচ এ নিয়ে নারী নেত্রীরা সরব হতে পারেন নি। নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিকার, সরকার বিস্ময়কর ভাবে নিরব। পরিবহন শ্রমিকদের প্রধান নেতা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই যদি এখন জনগণ ধরে নেয় রাষ্ট্রীয় মদত আছে এসব কিছুতে, তাহলে কি বেশী বলা হবে ? এখন তারা ৯৬ ঘন্টার হরতালের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে। কি হচ্ছে এটা । সরকারের গায়ে-গতরে লেপ্টে থেকে নাগরিকের জীবনকে বিপন্ন করে তোললে সরকারের দিকেই আঙ্গুল তুলবে মানুষ।
মানুষ সরকারের উপর নির্ভর করতে চায়। নাগরিক চায় না জনজীবন বিপর্যস্ত হোক। বন্ধ হোক কালো মবিলের সন্ত্রাস।