স্বাভাবিকভাবেই লিপি কিংবা বর্ণমালার প্রসঙ্গ আলোচনা করলে আমাদের প্রথমেই আসবে ওই লিপি ব্যবহৃত হচ্ছে কোন ভাষায়। ভাষা কীভাবে এই পৃথিবীতে এসেছে, এর কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও দেখা যায় মানুষ তার এক্সপ্রেশন কিংবা ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে বিভিন্নভাবেই একজন আরেকজনের সঙ্গে নতুন নতুন ধ্বনির আদান-প্রদান করেছে এবং এক সময় এভাবে বহু উচ্চারিত ধ্বনিগুলোই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থবোধক শব্দে পরিণত হয়েছে এবং এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে নিজস্ব ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। সারা পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠী বিচরণ করছে এবং তাদের প্রয়োজনে তারা তাদের নিজস্ব ভাব বিনিময়ের শব্দ, শব্দ থেকে বাক্য তৈরি করেছে এবং সময়ের বিবর্তন বলি কিংবা ক্রমউন্নয়ন বলি অর্থাৎ মানবজাতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাব বিনিময় কিংবা ভাষা লিপিবদ্ধ করার কাজটাও এক সময় হয়ে যায়। অর্থাৎ হয়তো ভাষা সৃষ্টির পরই শুরু হয়েছে লিপির সৃষ্টি কিংবা বর্ণমালার প্রচলন।
ভাষাবিষয়ক আলোচনা নিঃসন্দেহে এক জটিল ব্যাপার। এ বিষয়ক গূঢ় আলোচনায় না গিয়ে বিলুপ্তপ্রায় একটা উপভাষা কিংবা আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ সিলেটি নাগরী লিপির আন্তর্জাতিকায়ন কিংবা অন্য অর্থে বিশ্বায়ন নিয়ে আলোচনা সভা ছিল লন্ডনে।
সম্প্রতি আয়োজিত এ সেমিনারে প্যানেল আলোচক ছিলেন ড. স্যু লয়েড উইলিয়াম, লয়েড উইলিয়াম, ড. রেণু লুৎফা, গবেষক মোস্তফা সেলিম, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন এবং আমি। যে বর্ণমালাটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তা একটা ভাষারই বর্ণমালা। পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষার মাঝে এখন পৃথিবীর দেশে দেশে প্রায় পঁচিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ ভাষাটি তাদের নিজস্ব। সে কারণেই এই বাংলাভাষীদের তাদের নিজস্ব ভাষা যেমন বাংলা, ঠিক সেভাবেই তাদের নিজস্ব বর্ণমালাও আছে এবং এটা বাংলা, যে বর্ণমালা দিয়ে আমরা লিখি। এই পঁচিশ কোটির মাঝে সবাই যে লিখতে পারি তা নয়, অনেক নিরক্ষর লোক আছেন, আবার বাংলাভাষী অনেক অনেক প্রাজ্ঞ লোকও আছেন, যারা হয়তো বাংলা লিখতে জানেন না। কিন্তু এরপরও এটাই চিরন্তন সত্য যে, বাংলা বর্ণমালা হলো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব বর্ণমালা।
ঠিক সেভাবেই যদি আমরা আলোচনায় যাই, তাহলে দেখব বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীদের একটা নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা চলে আসছে এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে… যে ভাষায় শুধু সিলেট না, ভারতেরও কিছু কিছু অঞ্চল যেমন শিলচর, আসাম, করিমগঞ্জের বিপুলসংখ্যক লোক এ ভাষায় কথা বলে। কত যুগ কিংবা কত শত বছর থেকে এ ভাষা প্রচলিত তা আমার জানা নেই, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই ভাষার মানুষগুলো তাদের লিখনীতে তাদের নিজস্ব বর্ণমালার সৃষ্টি করেছে সেই ছয়-সাতশ বছর আগেই। সভ্যতার ক্রমবিকাশ যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখা যায় পাঁচ-ছয়শ বছর আগেও সিলেটি ভাষার মানুষের শিক্ষায়-প্রজ্ঞায় নিজস্ব একটা বলয় সৃষ্টি করেছিল। সিলেটিদের এ এক নিজস্বতা, তাদের স্বকীয়তা এখানেই। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য এও এক বৈচিত্র্য যে, বাংলা ভাষার দুটো রীতি একটা প্রমিত বাংলা এবং অন্যটা হলো সিলেটি নাগরী।
সুতরাং শুধু আঞ্চলিক হিসেবে এই নাগরী লিপিকে বিবেচনাও করা যাবে না। যদিও এটা রাষ্ট্রীয়ভাবেই অনুচ্চারিতই থেকেছে কোনো এক অজানা কারণে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের জন্য এ এক গর্ব করার মতো ব্যাপারও।
ধারণা করা হচ্ছে এই যে সাত হাজার ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় পৃথিবীর মানুষ কথা বলছে এখন, দেড়শ বছরের মধ্যে এ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর তাই স্বাভাবিকভাবে এ প্রশ্নটি হয়তো আসতে পারে যে, এ ভাষার মাঝে কি বাংলা ভাষাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস রাখি কিংবা আমরা সবাই বিশ্বাস রাখতে চাই, বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হবে না। কারণ এ ভাষা শুধু একটা ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নেই। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিশ্বায়ন ঘটেছে এবং এটা চলতে থাকবে হয়তো আরো কয়েকশ বছর। আমি বাংলা ভাষার সঙ্গে সমান্তরাল কিংবা প্যারালাল হিসেবে দেখি না, তবে বাস্তবতা হলো, সিলেটি মানুষগুলো এই বিশ্বায়নের অগ্রপথিক এবং এরা যেখানেই যাচ্ছে, নিজেদের আঞ্চলিক সংস্কৃতিকেও তারা সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছে। লন্ডন-আমেরিকায় সিলেটি মানুষদের অবস্থান মোট অভিবাসী বাংলা ভাষাভাষীদের কত শতাংশ তা এখন আর বলার আপেক্ষা রাখে না।
সে হিসেবে বাংলা ভাষার সঙ্গেই সিলেটি আঞ্চলিক ভাষাটারও বিশ্বায়ন হচ্ছে ক্রমশ। ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে এটা জায়গা করে নিচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। কিন্তু সেই পাঁচ-ছয়শ বছর আগ থেকে সিলেট অঞ্চলের ভাষার যে নিজস্ব লিপি অর্থাৎ নাগরী বর্ণমালা ছিল, তার অবস্থান এখন কোথায়? এ লিপিটি প্রায় বিলুপ্তির পথেই ছিল। বিগত প্রজন্মের অনেকেই এ লিপিটিকে পুনর্জন্ম দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। সেজন্য ইতোপূর্বে এ নিয়ে এর আগেও অনেকেই কাজ করেছেন। সিলেটে নাগরী লিপির প্রেস কিংবা প্রকাশনার যন্ত্র ছিল এক সময়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন এ প্রেসও ভেঙে দেয়া হয়েছিল। নাগরীকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইতোপূর্বে কাজ করেছেন গবেষক আসদ্দর আলী কিংবা সৈয়দ মোস্তফা কামালসহ অনেকেই। তাঁরা বর্ণমালাটিকে লোকচক্ষের সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন, কিন্তু তা যেন লণ্ঠনের বাতির মতোই টিম টিম করে জ্বলছিল, আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এ নিয়ে খুব একটা গবেষণা হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যাপক আলোচনায় আসেনি। দীর্ঘদিন থেকে দেশে জাতীয় পর্যায়ে যখন এই বিলুপ্তপ্রায় লিপিকে নিয়ে খুব একটা উচ্চভাবে কথা বলা হচ্ছে না, ঠিক এ সময়ে এ জায়গটাতে উৎস প্রকাশনীর মোস্তফা সেলিম হাত দিয়েছেন। তিনি নিজে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত, এ হিসেবে তার সুবিধাটাও আছে। তাই তিনি সাহস করতে পেরেছেন। নিজে সিলেটের মানুষ, তাই হয়তো শিকড়মুখী হয়েছেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে এটা আলোচনায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
অন্যদিকে এই বিশ্বায়নে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছেন দুজন মানুষ, ব্রিটেনের এক দম্পতি ড. সু লয়েড উইলিয়াম এবং জেইমস লয়েড উইলিয়াম। এই দুজন সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভিন্ন ভাষার মানুষ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অবসরপ্রাপ্ত অঙ্কের শিক্ষক গবেষক লয়েড উইলিয়াম আলোচনাও করেছেন সেদিন, সম্পূর্ণ সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায়। এই দম্পতি এ নিয়ে গবেষণা সেন্টার ( star ) করেছেন ব্রিটেনে। দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টডিজ (সোয়াস) ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে নাগরী লিপি নিয়ে গবেষণা করা জেমস লয়েড দম্পতি জাতিসংঘে এ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন, এ ভাষাটাকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি নিয়ে আসার জন্য কাজ করছেন। তারা কম্পিউটারে এই লিপির ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন, সফটওয়ার ইনভেন্ট করেছেন এবং এই লিপির আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে এই সিলেটি নাগরী লিপির যোগাযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন তারা।
এখন কথা হলো এই লিপিকে আমরা বাঁচাব-ই বা কেন? এ একটা প্রশ্ন আসতেই পারে। উৎস প্রকাশনী থেকে সম্ভবত ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত বইগুলো থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই লিপির বহুল প্রচলন ছিল এক সময়। এই লিপি দিয়ে বাংলা সাহিত্যের অনেক মরমী সাধক তাদের আধ্যাত্মিক ধ্যান রচনা করেছেন। এই লিপি দিয়ে প্রেম-ভালোবাসা সমাজ-সংস্কার-বৈষম্য তুলে ধরেছেন অনেক লেখক সাহিত্যিক। এই লিপির মধ্য দিয়ে শিতালং শাহ মুন্সী ইরফান আলী, আকরম শাহ, মুন্সি সাদেক আলী, আফজল শাহ, ফকির আমান, পীর মজিদ প্রমুখ লেখকরা যে সাহিত্য রচনা করে গেছেন, তা এখনো উচ্চারিত হচ্ছে আমাদের সাহিত্যে। তাদের সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত জগতে একটা বিশাল জায়গা করে নিয়েছে। কেতাবে হালুতননবি মরমি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এখনো সেই মরমি লেখকদের গান উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের মেঠো পথ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর দেশে দেশে বাঙালিদের বিভিন্ন মঞ্চে। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের জমিনে এ লিপির পরিধি বিস্তৃত।
সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমরা এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সিলেটি নাগরী লিপি হলো- বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের যে সংস্কৃতির কথা বলা হয়, সিলেটি নাগরী এ লিপিও ছিল সেই হাজার বছরের সংস্কৃতির চর্চার কিংবা বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এই লিপির মাধ্যমে সৃষ্ট সাহিত্য চর্চিত হচ্ছে এখনো, গবেষণার কাজ হচ্ছে হয়তো প্রমিত বাংলায়। শুধু লিপিটা ব্যবহৃত হচ্ছে না। কিন্তু এই নাগরী লিপির সৃষ্ট সাহিত্য আমাদের বাঙালি মানসে চির উজ্জ্বল।
সিলেটি নাগরী লিপি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং অনেকদূর এগিয়েছে এ কাজটা। বিশ্বায়নের বাণিজ্যায়নে আগামী একশ বছর পরে পাঁচ হাজার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার যে শঙ্কায় আছে এই পৃথিবী, সেই শঙ্কাকে আমরা জয় করব। আমাদের বিলুপ্তপ্রায় সিলেটি নাগরী লিপি তার আগেই অর্থাৎ নিকট-ভবিষ্যতে আবারো বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমের একটা বিষয় হয়ে নতুনভাবে চর্চিত হবে, এ আশা আমরা রাখতেই পারি। বাংলাদেশের পাশাপাশি লন্ডনে যেভাবে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে সেই কাজের সুফল হয়তো আমরা এক দশকের মধ্যেই পেয়ে যেতে পারি। দেশে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায়-পরিশ্রমে জাতিসংঘের একটা স্বীকৃত ভাষা হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় আবারো পুনর্জন্ম হবে সিলেটি নাগরীর, এই আশাবাদ জোর দিয়েই উচ্চারিত হয়েছে লন্ডনের সেমিনারে।
লেখকঃকলামিস্ট, প্রধান সম্পাদক ৫২বাংলাটিভি ডটকম