তেইশ জুলাই আমাদের পরিবারের জন্য যেমন বেদনার তেমনি গৌরবের । আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ঠিক এই তারিখে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও আমাদের বাংলাদেশি পাকিস্তানিদের দালাল বিয়ানীবাজারের স্থানীয় রাজাকার ও আল-বদরদের সমন্বয়ে আমাদের মোল্লাপুর গ্রামের বসতঘর সহ বাড়ীর সামনে থাকা টংগিঘরটি সম্পূর্ণ পোড়িয়ে দেয়। এই ঘরটি ছিল আমার দাদার । দাদা সহ আমার বাপ-চাচারা যেহেতু এই ভিটায় একত্রিত বসবাস করতেন, সেহেতু এই ভিটাকেই আমাদের পূর্ব পুরুষের ভিটা হিসেবে মনে করি।
এই ভিটাতে আমি সহ আমার ভাই বোন, চাচাতো ভাই বোন অনেকেই জন্মগ্রহণ করেছি । জন্মমাটির প্রতি প্রতিটি মানুষের যেমন টান রয়েছে, তেমনি আমাদেরও।এই ভিটায় আমরা যারা জন্মগ্রহণ করেছি, লক্ষ্য করেছি, তাদের এই ভিটার প্রতি আলাদা একটি টান রয়েছে ।
এছাড়াও আমাদের পরিবারের যারা এই ভিটায় জন্মগ্রহণ করেনি তাদেরও টান রয়েছে, যেহেতু এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের ভিটা। এই ভিটায় ১৯৬৯ সালে আমার জন্ম হয়। আমাদের ঘরটি পোড়ানোর পূর্বে ঘরের পূর্ণ রূপ কেমন ছিল তা আমার বুঝার বয়স না হলেও সময়ের ব্যবধানে যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি, তখন দেখেছি বসতঘর এবং টংগিঘরের চতুর পাশের পাকার পোড়া দেয়ালগুলো দাড়িয়ে আছে পাকিস্তানীদের পাশবিকতার স্বাক্ষী হিসেবে ।
দেশ স্বাধীনের পর যেহেতু আমার বাপ-চাচারা পার্শ্ববর্তি নতুন বাড়ীতে বসতি স্থাপন করেন, সেহেতু সেই পোড়া পাকা দেয়ালগুলো সরানোর প্রয়োজন না হওয়াতে তা দীর্ঘ কয়েক বছর এভাবে দাড়িয়ে থাকে।
যখন আমার বুঝার একটু বয়স হয়েছে তখন, এই পোড়া দেয়াল দেখে নিজ পরিবার ও আত্নিয় -স্বজন অনেকজনকে প্রশ্ন করতাম- কারা, কোন কারণে আমাদের ঘরটি পোড়িয়ছে ? সেই সময় আমার বয়স কম ছিল, তাই হয়তো তারা বিশদ ব্যাখ্যা না করে বলতেন, পাকিস্তানী মিলিটারি এবং রাজাকাররা পোড়িয়েছে । আরো বলতেন, এই মিলিটারি এবং রাজাকাররা এত হিংস্র ছিল- তারা আমাদেরকেও পেলে প্রাণে মেরে ফেলতো । ছোটবেলা মিলিটারি আর রাজাকার কারা- তা বুঝার ক্ষমতা না থাকলেও মনে হতো- যেহেতু ওরা আমাদেরকে পেলে হত্যা করে ফেলতো সেহেতু ওরা হয়তো কোনো হিংস্র জন্তু হবে।
আমার বোধশক্তি হওয়ার পর হিংস্র রাজাকার আর পাকিস্তানী মিলিটারির হিংস্রতার চিহ্ন নিজ চোখের সামনে দেখে তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি আজোবদি- আসলে ওরা মানুষ ছিলো না হিংস্র জন্তু ছিল।
সভ্য সমাজে মানুষের চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম নীতি রয়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তাই । যুদ্ধ ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশনের ১৯৪৯ এর আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত ধৃত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং যুদ্ধাঞ্চল ও এর কাছাকাছি এলাকার বেসরকারি নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা ।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশিও দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-সামস তা মানেনি । তারা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক লোককে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, ও বাড়ী ঘর পোড়িয়েছ । আসলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের নির্যাতনের কথা জানার যত চেষ্টা করি ততই পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসর পূর্ব পাকিস্তানী রাজাকার,আলবদর, আল-সামছদের প্রতি ঘৃণা জন্মে, মনে হয় ওরা আসলেও মানুষ ছিল না ।
ওদের মধ্যে যে মানবতা নেই তা পাকিস্তান আমলের তেইশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই তা প্রমাণিত হয় । ১৯৪৭ সালে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারত থেকে পৃথক হয়ে যে রাষ্ট্র গঠিত হয় তার নাম পাকিস্তান । এর দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী । পাকিস্তানের স্বাধীনতা মূহুর্তে এর জনসংখ্যা ছিলো ছয় কোটি নব্বই লক্ষ এর মধ্যে। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল চার কোটি চল্লিশ লক্ষ। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। সেখানে সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার থাকার কথা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে সর্ব ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে । তারা পরিকল্পিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনিতে রূপান্তর করার পক্রিয়ায় এগিয়ে যায় ।
সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সর্ব প্রথম আঘাত আনে আমাদের মুখের ভাষা- বাংলা ভাষায় । পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে একুশে মার্চ সোহরাওয়াদী উদ্ধানে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা । এরপর চব্বিশে মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির তীব্র প্রতিবাদ জানায় । ১৯৫২ সালেরএকুশে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে মিছিল করে। সেই মিছিলে পাকিস্তানিদের মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন রফিক,জব্বার, শফিক, বরকত।
শুধু ভাষা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মূল শক্তি হিসেবে তারা পাকিস্তান শাসন আমলের তেইশ বছর সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা তাদের হাতে ধরে রাখে।
বাঙ্গালীরা যখনই রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাইছে, তখনই তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে। অন্যদিকে মুসলীমলীগ হারিকেন প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করা এই নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ৩০৯টি আসনের মধ্যে ৩০৬ টি আসন যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি।
ঠিক একইভাবে ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের নির্বাচন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে ।
অন্যদিকে পাকিস্তান পিপলস্ পার্ট নির্বাচিত হয় ৮৮টি আসনে। এই নির্বাচনে বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানীরা গড়িমসি করলে বাঙ্গালীর রাখাল রাজা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বাংলার মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান জানান । তার ভাষনের শেষ উক্তি ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ তিনি আরও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে গ্রামে গঞ্জে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে দূর্গ গড়ে তুলতে । যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে । এই ভাষনের পর ২৫ শে মার্চ রাত শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তার পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামে । ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এই স্বাধীনতা ঘোষণার আভাস পেয়ে পাকিস্তানী জেনারেল ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ ১৯৭১ বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত প্রদান করে সন্ধ্যায় পাকিস্তান যাত্রা করলে এই রাতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বাবিচারে পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করে । এর প্রতিবাদে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলে লক্ষ কোটি বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের মত আমাদের পরিবারও অংশগ্রহণ করে।
এই স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস অন্যান্যদের মত আমাদের পরিবারের জন্য অতি কষ্টের ও বেদনার । আমার দাদা-দাদির ছয় ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছিল পরিবার । সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক। এর মধ্যে স্বকীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন আমার মেঝো চাচা মিম্বর আলী । তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন । এবং ছোট চাচা ছাদ উদ্দিন আহমদ ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্বকীয় নেতা , সিলেট এম,সি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র । মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে আমাদের পরিবারের অবস্থান ছিলো – আমাদের দাদা-দাদি’র সাথে আমার আব্বা- আম্মা ভাই-বোন ও মেঝো চাচা মিম্বর আলী সাহেবের স্ত্রী ও সন্তানরা বসবাস করতাম গ্রামের বাড়ীতে। আমার মেঝো চাচা মিম্বর আলী ও ডাক্তার আলাউদ্দিন চাচা ছিলেন যুক্তরাজ্যে। বড় চাচা ভারত থাকলেও যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে চলে আসেন । প্রকৌশলী সিরাজ উদ্দিন আহমদ চাচা চাকুরির সুবাদে স্ব-পরিবারে পাবনায় বসবাস করতেন । তিনি পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং আমাদের ছোট চাচা ছাদ উদ্দিন আহমদ আমাদের সিলেটের শাহী ঈদগাহের বাসায় থাকতেন। একমাত্র ফুফু ছুফিয়া খানম কুসুম স্ব -পরিবারে সিলেট শহরে বসবাস করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে আমাদের পরিবার স্বাধীনতার সংগ্রাম ত্বরান্বিত করতে স্বকীয় হয়ে উঠে । আমাদের পরিবার যেহেতু আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিবার, স্বাভাবিক কারণে পাকিস্তানীদের কাছে আমাদের তথ্য ছিল ।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান কে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হলে দেশ থেকে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লেখা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্যদের মামলা থেকে মুক্ত করতে যুক্তরাজ্যে শেখ মুজিব ডিফেন্স কমিটি করা হলে মিম্বর আলীকে সেই কমিটিতে সহ-সভাপতি করা হয় । এই কমিটিতে মিম্বর আলীর স্বর্কীয় ভূমিকার তথ্য ও পাকিস্তানী গুয়েন্দাদের কাছে ছিল। তাই ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের সিলেট শাহী ঈদগাহের বাসায় হানা দেয় । বাসায় কাউকে না পেয়ে তারা ফিরে আসে ।
অন্যনিকে আমার ছোট চাচা শাহী ঈদগাহের স্থানীয় স্বাধীনতাকামি মানুষদের নিয়ে পাকিস্তানীদের চলাচল ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ভুবিছড়ার পারের রাস্তা ও টিভি হাসপাতালের রাস্তার মধ্যে গর্ত খনন করেন এবং বাসার সামনে পাকিস্তানী বর্বরতা প্রতিবাদে কালো পতাকা উত্তোলন করেন।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ভারতে অবস্থানরত মুক্তি বাহিনী ও আমাদের দেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাধারণ মানুষের জন্য সর্বপ্রথম ব্রিটেন থেকে যে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল ভারতে সাহায্য নিয়ে পৌছায় সেই দলে ছিলেন মিম্বর আলী। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেন এবং সাহায্যের টাকা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে সমঝিয়ে দেন।
এছাড়াও মিম্বর আলী তার ব্যক্তিগত ছয় হাজার পাউন্ডে কেনা উচ্চক্ষমতা সম্পূর্ণ একটি রেডিও ট্রান্সফরমার আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে হস্তান্তর করেন। যা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই তথ্যগুলো পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছালে পাকিস্তানী জান্তারা সক্রিয় হয়ে উঠে। এবং পাঁচ এপ্রিল আমাদের সিলেট শাহী ঈদগার বাসা পুড়িয়ে দেয়।
বাসা পোড়ার পূর্বে আমার ছোট চাচা পাকিস্তানী মিলিটারি ও রাজাকারদের গতিবিধি আঁচ করতে পেরে তার কাছে থাকা দু লক্ষ টাকা বাসার পাক ঘরের বিশেষ ব্যবস্থায় মাটিতে পুঁতে রেখে, অন্যান্য সব কিছু রেখে ২৮ মার্চ শুধু আমাদের প্রাইভেট হিলমেন কারটি জিন্দাবাদ বাজার ইষ্টান ইঞ্জিনিয়ারিং শপে রেখে টাউন ছেড়ে গ্রামের বাড়ী মোল্লাপুর গ্রামে চলে যান।
৫ এপ্রিল বাসা পোড়ার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর লোকেরা গাড়ীটির সন্ধান পেয়ে সেটিও নিয়ে যায় । বাসার সবকিছু পুড়ে গেলেও অক্ষত রয়ে যায় মাটিতে পুঁতা দুই লক্ষ টাকা । এই টাকা আমাদের আয়ত্বে আসে ।
এদিকে সরকার ঘোষণা করে, যাদের কাছে অতিরিক্ত টাকা সংগৃহীত আছে তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে জমা না রাখলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। তখন ভয়ে দু লক্ষের সাথে আমার আব্বার কাছে নগদ ষাট হাজার টাকা থাকায় এই দু লক্ষ ষাট হাজার টাকা বিয়ানীবাজার ব্যাংকে জমা দেওয়া হলে টাকাগুলো আর পাওয়া যায় নি । সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে ফেলে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে সিলেট শহর আমাদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠলে নিজ গ্রামকে কিছুটা নিরাপদ মনে হতো । আমার চাচা মিম্বর আলী এপ্রিলের প্রথম দিকে ভারত থেকে দেশে আসলে নিজ বাড়িতে থাকা নিরাপদ না মনে করে দু- তিন দিন বিভিন্ন জায়গায় থেকে বারো এপ্রিল ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে লন্ডন যান।
দেশ থেকে যাওয়ার সময় সাথে ছোট চাচা ছাদ উদ্দিন আহমদকেও নিয়ে যান । তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । মিম্বর আলী ভারত থেকে লন্ডন পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধে জনমত সৃষ্টি ও যুদ্ধের তহবিল সংগ্রহে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের সভায় অংশগ্রহণ করেন।
এদিকে আমার চাচা সিরাজ উদ্দিন আহমদ যুদ্ধে ভয়াবহতা বুঝতে পেরে তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে এপ্রিলের প্রথমদিকে পাবনা থেকে চাকরি ছেড়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও অনিরাপদ থাকায় প্রায় দুই মাস পায়ে হেঁটে ভ্যানে চড়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সিলেট পৌছান ২ জুলাই ( এই দীর্ঘ দুই মাস চলার পথে অচিন মানুষের কাছ থেকে যে আত্নিয়তা ও নিরাপত্তা পেয়েছেন, তার জন্য এখনও তিনি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেন অপকটে এবং গর্বচিত্তে । যা আমাদেরও গর্বিত করে )।
সিলেট পৌছেই স্ত্রী সন্তানদেরকে সিলেট শহরে রেখে তিনি গ্রামের বাড়ী চলে যান । আমাদের বড় চাচা তার পরিবার নিয়ে অন্যত্র থাকতেন । ইতিমধ্যে গ্রাম ও আমাদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠে । পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বিয়ানীবাজার আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন মুসলীম লীগ নেতা কালা মিয়া মোল্লাপুর,মোল্লাগুষ্টি নিবাসি জনাব নজিব আলী’কে বিয়ানীবাজার পেয়ে বলে দেন, আমাদের পরিবারকে সংবাদ পৌছে দিতে যে, আমরা গ্রাম ছেড়ে দ্রুত চলে যাবার জন্য। অন্যতায় ক্ষতি সাধন আসন্ন । এই সংবাদটি নজিব আলী আমাদের বাড়ীতে নিয়ে যখন আসেন তখন আমার দাদি ও মা- চাচি মিলে রান্নার জন্য তরকারি প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিলেন। নজিব আলী বলেন, ‘এখনো তোমরা বাড়ীতে আছ? তাড়াতাড়ি পালাও, পাকিস্তানী আর্মি আসতেছে।
সংবাদটি শুনে সবকিছু এলোমেলো রেখে আমার দাদা-দাদি, মা –চাচি, ভাই- বোন বাড়ী ছেড়ে দৌড়ে আশ্রয় নেন আমাদের বাবার মামা নূর উদ্দিন সাহেবের বাড়িতে। গ্রামে নূর উদ্দিন ও মজখা গুষ্টির আব্দুল জলিল সাহেবের বাড়ি প্রায় দু সপ্তাহ থাকা হয় । এর মধ্যে বিভিন্ন সময় সংবাদ আসত পাকিস্তানী মিলিটারি গ্রামে আসছে । সংবাদ পেলে আমার মা- চাচি আমাদের ভাই বোনকে নিয়ে জংগলে আশ্রয় নিতেন। এই সময় আমার বাবা ও চাচা সিরাজ উদ্দিন আহমদ গ্রামে বিভিন্ন বাড়ীতে লুকিয়ে থাকতেন । রাত্রিবেলা কিছু সময়ের জন্য বাড়ীতে যেতেন ভারত থেকে সাতটায় প্রচারিত জয় বাংলা রেডিও তে মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতার সংবাদ শুনতে।
আমার বাবা-চাচার বাড়ীতে আসার সংবাদ হয়তো কোনোভাবে পাকিস্তানী আর্মির কাছে পৌছে যায় । ২২ জুলাই বৃহস্পতিবার বাড়ীতে উনারা দুজন সংবাদ শুনতে গেলে পাশের বাড়ির মস্তফা উদ্দিন তাদের সাথে সংবাদ শুনতে বসেন ।
ঐদিন সংবাদ যথাসময়ে শুরু না হয়ে সাতটা ত্রিশ মিনিটে শুরু হয় । সংবাদ শুনে ঝটপট উনারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। মস্তফা উদ্দিন বামদিকে উনার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন আর আমার বাবা চাচা ডানদিকের রাস্তা হয়ে দাদা-দাদির আশ্রয় ঠিকানা নূর উদ্দিনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন ।
এদিকে পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা আমার বাবা-চাচাকে গ্রেফতার করতে নিরবে নিভৃতে বাড়ী সামনের রাস্তা দিয়ে খুব কাছাকাছি চলে আসে । মস্তফা উদ্দিন তাদের টর্চ লাইটের আলো দেখতে পেয়ে আত্ন রক্ষায় মাটিতে শুয়ে পড়েন। পাকিস্তানী আর্মি ডান বাম না চেয়ে দ্রুত আমাদের ঘরে প্রবেশ করে। যদি তারা বাম দিকে টর্চ লাইট মারতো তাহলে আমার বাবা চাচাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হতো।
আমার বাবা চাচারা আর্মির এই আগমন মোটেই টের পাননি। আর্মি বাড়ীতে ঢুকে আমার আব্বার চাচাতো ভাই হারিছ আলীকে জিঙ্গেস করে আমাদের পরিবারের অবস্থান কোথায়। তিনি আমাদের রক্ষার প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নেন, বলেন, তারা তাদের সিলেটের বাসায় আছেন। পাকিস্তানীদের কাছে আমাদের সিলেটের বাসার পুড়িয়ে ফেলার তথ্য থাকায় তিনি যে তাদেরকে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন তা তারা বুঝতে পেরে তিনিকে শারীরিক নির্যাতন করে এবং পরদিন শুক্রবার সকাল আট ঘটিকার বিয়ানীবাজার ডাক বাংলায় উপস্থিত থাকার নির্দেশ করে চলে যায় ।
পাকিস্তানী আর্মিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলো রাজাকার কুটুমনা। আর্মি যখন বাড়ীতে অবস্থান করে, তখন এই সংবাদটি দ্রুত আমার বাবা-চাচার কাছে পৌছান বাবার চাচাতো ভাই মনির উদ্দিন । সংবাদ পেয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাদা-দাদিকে নিয়ে তারা আশ্রয় নেন জঙ্গলে। আর্মি চলে যাবার সংবাদ নিশ্চিত হলে তারা জঙ্গল থেকে ফিরে আসেন।
পরদিন সকালবেলা হারিছ আলী চাচা যেহেতু ডাকবাংলোয় উপস্থিত হওয়ার কথা তখন সকাল বেলা তার সাথে দেখা করেন আমার বাবা ও চাচা সিরাজ উদ্দিন আহমদ। এবং হারিছ আলী সাহেবকে বলে দেন আমাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে নতুবা ওরা তাকে নির্যাতন করবে । এই বলে উনাকে গ্রামের মূল রাস্তা নাগেশ্বর তলায় এগিয়ে দিতে সাথে যান আমার বাবা ও চাচা । তারা নাগেশ্বর তলায় পৌছার পূর্বেই দেখেন পাকিস্তানী মেলেটারির গ্রামে প্রবেশ করছে। তাই দেখে তারা যার যার মত ছটকে পড়েন ।
আমার চাচা আশ্রয় নেন পাতন গ্রামের মলিক মিয়ার বাড়ী জঙ্গলে আর বাবা আশ্রয় নেন আমাদের পাশের জনশূন্য আবিদের বাড়ীতে। পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা আমদের বসত বাড়ীতে আসে বেলা প্রায় বারোটার সময় । মসজিদে যখন পবিত্র জুম্মার আজান চলছিল, ঠিক তখনই তারা আমাদের বসতঘর ও টংগিঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় । ঘরের পাকা দেয়াল ছাড়া সবকিছু পুড়ে যায় ।
ঘর পোড়ার কয়েক দিন পূর্বে আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ও কিছু টাকা ভর্তি একটি লোহার সিন্দুক আমাদের বাড়ীর পার্শবর্তি খালি বাড়ি (নাদুর বাড়ী) গভীর জঙ্গলে রাখা হয় । আমার আব্বার মটরসাইকেলটি বর্তমান আমাদের বসত বাড়ীর ( তখন খালি বাড়ী ছিল ) জঙ্গলে রাখা হয় । এবং সোনা ঘয়না ও কিছু কাপড় কটুআলীরপার এর সুয়াই মিয়ার বাড়ীতে রাখা হয় ।
বাড়ী পোড়ানোর পর গ্রামে থাকা আমাদের নিরাপদ নয় মনে হলে গ্রাম থেকে আমাদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় । সে জন্য আব্বার মামা খতফর আলী কটুচাঁদ সাহেব আমাদের জন্য দুইটি নৌকা প্রস্তুত করেন ।একটি নৌকায় আমার দাদা-দাদি গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিন আহমদ আলীর বাড়ী চলে যান । আমার আম্মা ও আমার চাচি মিম্বর আলী সাহেবের স্ত্রী ও সন্তানেরা একটি নৌকায় করে আমাদের নানা বাড়ী বড়লেখা আজিমগঞ্জে চলে যাই । সেখানেও ভয় পিছু ছাড়েনি। আমাদের সাথে চাচি দীর্ঘদিন থাকলে যে কেউ সন্দেহ করে মিলিটারির কাছে বলে দিতে পারে- এই সন্দেহে চাচি কিছুদিন আমার নানার বাড়ী, কিছুদিন ঢাকাদক্ষিন দাদা-দাদির কাছে এইভাবে থাকতে থাকেন।
এদিকে আমার বাবা ও চাচা সিরাজ উদ্দিন আহমদ থেকে যান অনিশ্চয়তার উপরে তাদের কোন আশ্রয়স্থল বা খাবার নিশ্চয়তা ছিল না। দিনের বেলা বনে জঙ্গলে কাটলেও নিজ গ্রাম অথবা পার্শ্ববর্তি গ্রামগুলোতে যেতেন রাতে ঘুমানোর জন্য । মানুষের বাড়ী তাদের এই যাতায়াত মানুষ ভালো দৃষ্টিতে নিতো না। মানুষ মনে করত, এই সমস্ত অপরাধীদের আশ্রয় দিলে হয়তো মিলিটারি দ্বারা তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
মানুষের ধারণা সঠিক ছিল উল্লেখ করে আমার চাচা বলেছেন তাদের কোন উপায় না থাকাতে গায়েপড়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাড়ীতে আশ্রয় নিতেন । এভাবে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমাদের পরিবারকে অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়েছে । সিলেটের বাসা ও গ্রামের ঘর পোড়ানোতে আমাদের রক্ষিত পূর্ব পুরুষের সব স্মৃতি ধবংস হয়ে যায় । শুধু রয়ে যায় জঙ্গলে রাখা লোহার সিন্দুক ও আমার আব্বার মোটরসাইকেল ও সুয়াই মিয়ার ঘরে রাখা স্বর্গ । ব্যাংকে রাখা আমাদের টাকা তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু পোড়ে গেলেও রক্ষা পাওয়া লোহার সিন্দুক ও মোটরসাইকেল আজোবদি আছে স্মৃতি হিসেবে ।
এদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে লক্ষ কোটি মানুষের সাথে আমরাও ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অনুসূচনা নেই। বরং সবকিছু হারিয়ে আমরা গর্বিত। কারণ আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইতিহাসের নগন্য হলেও অংশ হতে পেরেছি। তার চেয়ে বেশি গর্বিত হয়েছি যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়।২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে যুক্তরাজ্য হাইকমিশন বাংলাদেশের তেত্রিশ তম স্বাধীনতা দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার চাচার অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে ।
ছরওয়ার আহমদ: স্যোসাল এক্টিভিস্ট, সাবেক ভিপি ; বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ।যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
আরও পড়ুন: