ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ উপলক্ষ্যে বানানো আলোচিত মোটিফ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ আগুনে পুড়ে গেছে। পাশাপাশি, ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফের একাংশতেও আগুন লেগেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি শনিবার সকাল ১০টার দিকে জানান, শনিবার আনুমানিক ভোর ৪টা থেকে ৫টার মাঝে মোটিফ দু’টোতে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করছেন তারা। আর একদিন বাদেই ১৪ই এপ্রিল, বাংলা বর্ষের প্রথম দিন। ওইদিন হবে বর্ষবরণ উৎসব।
উৎসবের আগে এভাবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ নামে ওই মোটিফে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, শনিবার ভোর ৫টা ৪ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে তাদের দুটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
চারুকলা অনুষদ শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগুনের ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপরে তদন্ত করতে শুরু করেছে পুলিশ। শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেছেন, এতগুলো মোটিফের মধ্যে কীভাবে আলোচিত দুটি মোটিফে আগুন লাগলো, সেটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে।
আগুন কীভাবে লেগেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ক্যামেরা না দেখে বলতে পারবো না।” তবে “আমরা দেখেছি, ফ্যাসিস্ট…ওই দানবীয় মোটিফটা পুরোটা পুড়ে গেছে। কাছেই ছিল পায়রা, সেটি আংশিক পুড়ে গেছে। একটি মোটিফ-ই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাতে মনে হয়েছে, ওটিকে টার্গেট করেই আগুন দেওয়া হয়েছে,” বলেন সাইফুদ্দিন আহমেদ।
কেন মনে হচ্ছে যে টার্গেটেড? উত্তরে তিনি বলেন, “এই মোটিফটা (ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি) যাতে র্যালিতে না নেওয়া হয়, তার জন্য নানা অনুরোধ, উপরোধ, চাপ করা হচ্ছিলো। এ কারণেই মনে করছি টার্গেটেড। কারণ আশেপাশের কোনও মোটিফে তারা আগুন দেয়নি। এই একটা মোটিফই পুরো পুড়িয়ে ফেলেছে,” যোগ করেন তিনি।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলামের স্বাক্ষরে পাঠানো একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চারুকলা অনুষদ কর্তৃক পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ ১৮৩২ উদযাপনে আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের চেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী মোটিফের সাথে প্রতীকী দানবীয় ফ্যাসিস্টের মোটিফ তৈরি করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথে জানাচ্ছি যে, ১২ এপ্রিল ভোর আনুমানিক ৪ টা ৫০মিনিটের দিকে দানবীয় ফ্যাসিস্টের প্রতীকী মোটিফে কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।
জানা যায়, প্রতিদিনের মতো গতকালও চারুকলায় তিন ধরনের পাহারার ব্যবস্থা ছিল। চারুকলার নিজস্ব পাহারাদার, পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের দুইজন পাহারায় ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলছেন, “পুলিশ একটু অন্য পাশে ছিল। প্রক্টরিয়াল মোবাইল টিমের দুইজন ৪টা ৫০-এর দিকে নামাজে যায়। যাওয়া আগে পুলিশকে বলে গেছে যে একটু খেয়াল রাখেন। তখনই হয়তো এ কাজ করা হয়েছে” বলে মনে করছেন প্রক্টর মি. আহমেদ। তিনি জানান, কার্যত ওখানে পাহারাদার কতটুকু ছিল, তা তদন্ত করার পর বোঝা যাবে। কিন্তু এখন যেহেতু হাতে সময় নেই বললেই চলে, তাহলে এর মাঝে মোটিফ পুনরায় বানানো সম্ভব হবে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, “সন্দেহ আছে। এটি একটু টাফ হবে। আর মাত্র একদিন আছে। এর মাঝে এটি রিকভার করা যাবে কি না…আমরা শিল্পীদের সাথে কথা বললে বুঝতে পারবো,” জানান তিনি।
বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফটির উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। এখন এই এতবড় মোটিফ পুনরায় আবারও বানানো যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলামও।
পুড়ে যাওয়া মোটিফে একজন হাঁ করা দাঁতালো নারীর মুখাকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। যার মাথায় ছিল চারটি শিং। নাক ছিল বিশালাকার এবং চোখ দু’টো ছিল ভয়ানক।
মোটিফটি মূলত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসাবে বানানো হয়েছিলো বলে অনেকে মনে করেন। এ নিয়ে গত কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনাও চলছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে সামনে রেখে এবারের নবর্ষের প্রতিপাদ্য হলো ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এটিকে সামনে রেখেই ওই মোটিফ বানানো হয়েছিলো।
এবারের নববর্ষ উপলক্ষ্যে যেসব মোটিফ বানানো হয়েছে, তার তালিকার শুরুতেই ছিল এটির নাম। তবে অধ্যাপক ইসলাম বলেন, “এমন না যে এটি-ই প্রধান মোটিফ ছিল। অনেকগুলো মোটিফ বানানো হয়েছে। এটি তার মাঝে অন্যতম।” এবারের শোভাযাত্রার আয়োজনে বানানো অন্য বড় মোটিফগুলোর মাঝে রয়েছে— কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, শান্তির পায়রা, পালকি, তরমুজ, গণঅভ্যুত্থানে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল।
এছাড়া, অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে— ১০টি সুলতানি ও মোগল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস।
উল্লেখ্য, বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি এবারের আয়োজনে থাকছে না। এই শোভাযাত্রার নতুন নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।