তুরস্ক পুরোপুরি একনায়কতন্ত্রের দিকে বড় একটি ধাপ এগিয়ে গেলো রবিবার, যখন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে কারাগারে পাঠানো হলো। বিরোধী দলগুলোর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটলো।
ইমামোগুলু, যিনি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ইসলামপন্থি এরদোয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত, তিনি এখন গণতন্ত্র রক্ষায় ব্যাপক বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। ৮৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই ন্যাটো সদস্য দেশে তার এই আহ্বান তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বিচারের আগেই কারাবরণ
এক আদালত রবিবার দুর্নীতির অভিযোগে ইমামোগলুকে বিচারের আগেই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘সরকারি অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ঠিক সেই দিনই তাকে ইস্তাম্বুলের মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, অথচ একই দিনে তিনি রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচিত হন।
ইমামোগুলু এক্স (টুইটার) এ লিখেছেন, তুরস্ক আজ একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হয়েছে। এই বিচারিক প্রক্রিয়া কোনও বিচার নয়, এটি সম্পূর্ণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
ফ্রান্স দ্রুত ইমামোগুলু ও অন্যান্য বিরোধী নেতার কারাবরণকে ‘গণতন্ত্রের ওপর গুরুতর আক্রমণ’ বলে নিন্দা জানিয়েছে।
দেশজুড়ে বিক্ষোভ, দমন-পীড়ন
ইমামোগলুকে বুধবার আটকের পর থেকে দেশের এক ডজনেরও বেশি শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। এরদোয়ানের নিজ শহর রিজের মতো রক্ষণশীল অঞ্চলেও বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। ইমামোগলুকে আটকের পর থেকে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং জনরোষের খবর প্রচার সীমিত করার চেষ্টা চলছে।
নির্বাচনে এরদোয়ানের পরাজয়
২০২৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে সিএইচপি অপ্রত্যাশিতভাবে দেশজুড়ে বড় বিজয় অর্জন করে, এমনকি ক্ষমতাসীন একে পার্টির দীর্ঘদিনের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত এলাকাগুলোতেও। এর পরই বিরোধী দলগুলোর ওপর এরদোয়ানের এই পাল্টা আক্রমণ।
বিক্ষোভকারীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে এরদোয়ান একে ‘সড়ক সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছেন। এক্সে দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, সিএইচপি ও তাদের সমর্থকরা যাতে জনশৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে, আমরা তা কখনোই হতে দেব না।
আমি মাথা নত করব না: ইমামোগলু
ইমামোগলু আটকের পর থেকেই সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সিএইচপির প্রার্থী হিসেবে নিজেকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সোমবার তিনি বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
সিএইচপির প্রাথমিক নির্বাচনে তিনি একক প্রার্থী ছিলেন, তবুও বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে আসেন। দলটির দাবি, ১৫ মিলিয়ন মানুষ ইমামোগলুকে সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি এক্সে এরদোয়ানকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, আপনি কোনও না কোনোভাবে পরাজিত হবেন। আমি আমার ৮৬ মিলিয়ন দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন ব্যালট বক্সের দিকে ছুটে আসেন এবং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য তাদের সংগ্রাম সমগ্র বিশ্বকে জানান। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আমি কখনও মাথা নত করব না।
‘তুরস্কের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়’
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসির সোনার চাগাপতাই বলেছেন, ইমামোগলুর গ্রেফতার তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তিনি বলেন, তুরস্ক এখন ‘প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদ’ থেকে সরাসরি কর্তৃত্ববাদের দিকে এগিয়ে গেছে, যেখানে বিরোধী দলগুলোর জয়লাভের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
ইমামোগলুকে আটকের পর নয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বুধবার তাকে নিয়ে দুটি পৃথক তদন্ত শুরু হয়েছে, যেখানে ১০০ জনেরও বেশি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক জড়িত। এর আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইমামোগলুর ডিপ্লোমা বাতিল করে, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য আবশ্যক।
এরদোয়ানের পুরনো মিত্রের সতর্কবার্তা
এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এরদোয়ান নিজেও একসময় কারাবরণ করেছিলেন।
গুল বলেন, অতীতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও আমার সঙ্গে যা করা হয়েছিল, তা যেন ইমামোগলুর সাথেও না করা হয়… আমাদের আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার হারানো উচিত নয়। নাহলে তুরস্কই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এরদোয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এরদোয়ানের বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সালে। তবে পার্লামেন্ট যদি আগাম নির্বাচনের ডাক দেয়, তাহলে ৭১ বছরের এরদোয়ান আবারও প্রার্থী হতে পারবেন।
বিশ্লেষকদের ধারণা, এরদোয়ান ইমামোগলুকে নির্বাচনের মাঠে না রেখে আগাম ভোট দিতে চাইছেন, কারণ ৫৪ বছরের ইমামোগলুই একমাত্র প্রার্থী যিনি তাকে পরাজিত করতে পারেন।
ইমামোগলু ইতোমধ্যে তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে তিনটি কঠিন নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। গত বছর সিএইচপি ইস্তাম্বুলের কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী এলাকায় জয়লাভ করে, যা এরদোয়ানের ইসলামপন্থি একে পার্টির জন্য নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হতো।
এরদোয়ান সরকার দাবি করেছে, এই তদন্তগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত নয়, বরং সিএইচপির ভেতরের দুর্নীতিই এই সংকটের কারণ।
তবে, বিরোধীরা বলছে, এটি তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা।
সূত্র: পলিটিকো