১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। শ্রাবনের সেই মেঘাচ্ছন্ন দিনে পূবের আকাশে রক্তিম সূর্য গাল ভারী করে হলেও ঠিকই উঠেছিলো পৃথিবীর নিয়ম মেনে। অস্তও গিয়েছিল অন্যান্য দিনের মতো। কিন্তু বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রটি যে সূর্য সন্তানের হাত ধরে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিলো বাঙ্গালীর সেই সূর্য সন্তানকে এইদিনে চিরতরে অস্তমিত করেছিলো কিছু কুলাঙ্গার। সেই যে রাজনীতির আদর্শিক সূর্য ডুবে ছিলো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাঙ্গালীর আশ্রয়স্থল খ্যাত ঐতিহাসিক বাড়িটিতে তার বিন্দুমাত্র আলোক ছটাও এখনকার ভোগবাদী রাজনীতিতে আর চোখে পড়েনা। রাজনীতির কবিকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কবিতার পটভ‚মি পাল্টে দেওয়া হয়েছে। তাই তো কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, কবি হীন এই বিমূখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি।
ঘাতকরা একসাথে একই গৃহে একই পরিবারের এত জন মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত একটি আদর্শকেই হত্যা করতে চেয়ছিলো। পুরোপুরি না পারলেও অনেকাংশেই তারা সফল হয়েছিলো। ভাগ্যচক্রে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই তনয়া নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে। এমন একটি হত্যাকান্ডের পর যখন প্রচন্ড বিক্ষোভে, বিদ্রোহে ফেঁটে পড়ার কথা ছিলো তখনকার আওয়ামী রাজনীতিবিদ কিংবা মুজিব প্রেমীদের, কিন্তু বিশ্ব দেখলো তার উল্টো চিত্র। ব্যাপক প্রতিবাদ তো দূরে থাক, প্রায় আট কোটি মানুষের দেশে কিছু বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ হাতে গুনা কয়েকজন নেতৃস্থানীয় মানুষ স্থানীয় পর্যায়ে করেছিলো। তাছাড়া বাকি মোটামুটি অনেকেই ঘাতক খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিলো কিংবা চুপ থেকেছিলো। এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে জাতীয়ভাবে কোন প্রতিবাদ কর্মসূচি দিতে ব্যার্থ হয়েছিলো তখনকার বঙ্গবন্ধুর প্রাণের রাজনৈতিক দলটি। পরিবেশ প্রতিকুল ছিল এ কথা সত্যি কিন্তু আইয়ুবের সামরিক শাসন যে জাতি মেনে নেয় নাই, বৃটিশদের রক্ত চক্ষু যে জাতি বরদাশত করে নাই সে জাতি তাদের জনককে এমন নির্মমভাবে হারিয়ে প্রতিবাদ করবেনা তা কী করে হয়!
বাংলাদেশের রাজনীতির আদর্শিক দ্বন্ধের একটি অধ্যায় রচিত হয়েছিল এই ১৫ আগস্টে। রাজনৈতিক মেরুকরণের অন্যতম একটি দিনও এই ১৫ আগস্ট। এই দিনে কেউ মর্মাহত চিত্তে শোক দিবস পালন করে। যেটি বর্তমানে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রও পালন করে। আবার দীর্ঘদিন দেখেছি কেউ কেউ ব্যাপক উল্লাসে বিতর্কিত জন্মদিনও পালন করে এই ১৫ আগস্টে। বিষয়টি এমন নয় যে এইদিনে কেউ সত্যিকার অর্থে জন্মগ্রহণ করে থাকলে তার সেই জন্মদিন পালনে কোন বাধা আছে।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, বাঙ্গালীর মুক্তির কান্ডারী বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সঠিকভাবে জানাশুনা ও মূল্যায়নকারী মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালী জাতীর জীবনে একটি কালো অধ্যায় এবং নিঃসন্দেহে শোকের দিন। ঐদিন বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলার আকাশ বাতাস। মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের চোখের নোনা জলে ভেসে গিয়েছিল প্রসারিত বুক, যা স্মরণ করে এখনও অনেকে বুক ভাসান।
এরই মধ্যে ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে কয়েকজনের রায় কার্যকরও করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। কিন্তুু সরকার পরিবর্তন হলে ১৫ আগস্ট আর জাতীয় শোক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে পালন করা হয় না। বরং তখন জাতি এমনও দেখেছে ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করা হচ্ছে।
টানা তিনবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে শোক দিবসে উদ্দেশ্যমূলক জন্মদিন পালন করা রাজনৈতিক পক্ষের অবস্থা বর্তমানে অনেকটাই কোনঠাসা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার ফলে আগের মতো আর তথাকথিত জন্মদিন পালনের এতো সাজ সাজ রব দেখা যায় না। যদিও তারা এমন ঘোষনা দেননি যে তারা ভবিষ্যতে কখনও ক্ষমতায় গেলে ১৫ আগস্ট যেহেতু জাতীর জনককে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে কাজেই এই দিনে আর যাই হোক ঘটা করে বিতর্কিত জন্মদিন পালন করা থেকে বিরত থাকবে এবং দিবসটিকে তারা জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করবে।
বর্তমানে অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ মান-মর্যাদার সাথে শোক দিবস পালন করা হয়। আপামর জনগনের মাঝেও দিবসটি পালন এবং দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করার একটি সার্বজনীন প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তুু বর্তমানে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় এই দিবসটিকে ঘিরে একধরনের সুবিধাবাদী অত্যুৎসাহী শ্রেণী তৈরী হয়েছে যারা শোক দিবসের নামে নিজেদের প্রচার করার অর্থাৎ আত্মপ্রচারের একটি উপলক্ষ্য হিসেবে বেঁচে নিয়েছে এই দিবসটিকে। শোক দিবসের প্রচার প্রচারণা যে কেউ করতেই পারে বরং করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তুু শোক দিবসে ব্যানার পোষ্টারে অনেক ক্ষেত্রেই দেখি শোক দিবসের ভাবমূর্তি ফুটে উঠার বদলে ক্ষুন্ন হচ্ছে দিবসের তাৎপর্য অন্যদিকে নিজেকে জাহির করার একটা সুযোগ প্রচারকারীরা নিচ্ছে।
২.
বিশ্ব মানচিত্রের এই যে অঞ্চলটি যেখানে আমরা, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা, তাদের পূর্ব পুরুষেরা বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছিল; যাদের বসবাসের জন্য ভূখন্ড ছিল, নিজস্ব ভাষা ছিল, সংস্কৃতি ছিল আর অগনিত মানুষ তো ছিলই। কিন্তু নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি ভূখন্ড থাকার পরেও বিশ্ব দরবারে নিজস্ব পরিচয় ছিলনা। বৃটিশ কিংবা পাকিস্থানিদের দ্বারা নানান সময়ে শোষিত এই অঞ্চল কাগজে পত্রে বাংলাদেশ নামে কখনই পরিচিত ছিলনা বরং এটিকে কখনো বলা হতো ভারতবর্ষের ইস্ট বেঙ্গল, কখনো বা ইস্ট পাকিস্থান। ভিনদেশী বেনিয়াদের শোষন, নিপীড়ন আর পরাধানীতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাঙ্গালির জাতিগত পরিচয়কে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ তথা বাঙ্গালির জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আখাঙ্খা এই অঞ্চলের মানুষের ছিল আজন্ম। তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতো হে আল্লাহ্, আমাদেরকে এমন এক অমৃতের সন্তান দাও যে আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিবে। এমনই এক অমৃতের সন্তান, বাঙ্গালীর মুক্তির কান্ডারী হয়ে জন্ম নিয়েছিল আজ থেকে শত বছর আগে, ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালাগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। যার হাত ধরেই বহু সংগ্রাম আর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী পেয়েছিল তাদের বহুল কাঙ্খিত স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার আজ পঞ্চাশ বছর। আর স্বাধীনতার স্থপতি, ইতিহাসের সেই মহান নায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ। যেটিকে সরকার মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষনা করেছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার জন্য মুজিববর্ষ উদযাপন এবং স্বাধীনতার স‚বর্ণজয়ন্তী প্রত্যাশা অনুযায়ী করা না গেলেও মোটামুটিভাবে উদযাপন করা হয়েছে।
যে মানুষটি নিজের জীবন বাজি রেখে বাঙ্গালীর বহুল কাঙ্খিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলো সেই মানুষটিকে তার নিজ গৃহে নিমর্মভাবে স্বপরিবারে হত্যা করার দিনটিকেও আমরা সার্বজনীনভাবে সকলে মিলে পালন করতে পারি না। জাতি হিসেবে এটা যে আমাদের জন্য কত বড় লজ্জার তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
১৫ আগস্টের শোকগাথা ভুলবার নয়, বাঙ্গালীর হৃদয়ে এই হত্যাকান্ডের রক্তক্ষরণ যেন আজো চলমান। এটিকে কোনভাবেই নিছক কোন হত্যাকান্ড বলা যাবে না, এটি কেবলমাত্র কোন ব্যাক্তি মানুষকে হত্যাও নয়। এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সর্বোপরি একটি আদর্শকে হত্যা করা হয়েছে যার মাধ্যমে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর ঐতিহ্যের ধারা থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে।
একটি অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের এই দেশকে এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার চাদরে মোড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে যার ধারা এখনও চলমান। প্রায়শই এদের আস্ফালন দেখতে পাই। মুজিব আদর্শে উদ্ভাসিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষগুলো বর্তমানে ভুঁইফোড়, হাইব্রিড, সুবিধাবাদী এবং সুবধাভোগী চেতনা ব্যবসীয়দের দাপটে অনেকটাই কোনঠাসা। এমন বাস্তবতায় প্রতি বছর যখন শোক দিবস আসে তখন কত ধরনের তথাকথিত নেতাদের পোস্টার যে দেখতে পাই বলে শেষ করা যাবেনা। উল্লেখিত এসব পোস্টারে শোক দিবসের মর্মার্থ কিংবা ভাবার্থ কোনটার প্রতিই কোন গুরুত্ব থাকে না বরং পোস্টার/ব্যানারকারীর দাঁত বের করা হাসিমাখা মুখ আর নিজের ছবিকে ফোকাস করতে গিয়ে শোক দিবস ছাপা পরে যায় অবলীলায়।
এবার লক্ষ্য করলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার পরও নিজ নিজ নামে একই মডেলের শোক দিবসের ব্যানার টানানো হয়েছে। বিষয়টি আমার কাছে অন্তত ভাল লেগেছে। সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর একটি রাজনৈতিক দল ছিল এবং আছে। সেক্ষেত্রে তাঁর দলের পক্ষ থেকে যদি রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ কিংবা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সাধারণ মানুষ যারা শোক দিবসের ব্যানার পোষ্টার করতে চায় তাদের জন্য একটি নির্ধারিত মডেল করে দেওয়া হয় এবং কারা এই পোষ্টার করতে পারবে এ ব্যাপারে যদি একটি নির্দেশনা দেওয়া হয় তবে দিবসটির ভাবার্থ ও মর্যাদা সমুন্নত থাকবে এবং শোক দিবসের মর্মবাণী যথার্থভাবে উপস্থাপিত হবে। অগ্রসরমান আমাদের এই জাতি রাষ্ট্রটির পঞ্চাশ বছরের মাইল ফলকে দাঁড়িয়ে এবং জাতির পিতার জন্মশত বর্ষের বিশেষ মুহুর্তে দাঁড়িয়ে শোকের মাসে শোক দিবসকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহবান রেখে বলতে চাই, প্রত্যেকেই যার যার রাজনীতি করুন, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সকল রাজনৈতিক মতপার্থক্যের উর্ধ্বে উঠে এবং ভিন্নমত-পথ ভুলে আসুন সবাই মিলে শোক দিবস পালন করি।
গাজী মহিবুর রহমান : কলাম লেখক