করোনার ক্রান্তিকাল অতিক্রান্ত করছি আমরা। এরইমধ্যে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় মরণ ঢেউ আমাদের স্বজন, পরিচিত – অপরিচিতদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে “না ফেরার দেশে”। বিশ্বব্যাপী দৈনিক আক্রান্ত বৃদ্ধির জেরে অধিকাংশ দেশে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখনো পুরোপুরি বাগে আনা সম্ভব হয়নি সংক্রমণ। লক্ষ – লক্ষ সাধারণ রোগীর পাশাপাশি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন সম্মুখ সারিতে কর্তব্যরত হাজার – হাজার ডাক্তার, নার্স এবং এন এইচ এস কর্মী। করোনার গ্রাস থেকে রেহাই পাননি শিক্ষক, ফায়ার ফাইটার, দোকানদার, বাস – ট্রেন চালক এমনকি ডেলিভারি ম্যান। দুঃখজনক হলেও সত্য , করোনাকালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু সংবাদ কর্মী এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
আমরা জানি প্রতিনিয়ত সাংবাদিকরা স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন। করোনাকালেও খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন, রেডিও, অন লাইনসহ অন্যান্য মিডিয়ার সাংবাদিকরা সম্মুখ সারির কর্মী হিসেবে সংগ্রহ করে চলেছেন নানা ধরণের সংবাদ। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রহ করছেন অনুসন্ধানী সংবাদ, রাজনীতির সংবাদ, অপরাধ জগতের খবর,ব্যবসা সংক্রান্ত সংবাদ, শিল্পকলা ও ক্রীড়া জগতের খবর, বিনোদন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সংবাদ। আর গত বছরের গোড়া থেকে এযাবৎ দিন – রাত সরকারি – বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওল্ড হোমস আর ডে কেয়ার ঘুরে – ঘুরে ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করছেন করোনায় আক্রান্ত মৃত রোগীদের এবং সক্রিয় রোগীদের খবরাখবর। নিচ্ছেন নানাজনের সাক্ষাৎকার। এ রোগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কাজটিও করছেন বেশ গুরুত্বের সাথে। উদ্বুদ্ধ করছেন এ মরণব্যাধি মোকাবেলায় ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য। তবে এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এরইমধ্যে জীবনের মূল্য দিতে হয়েছে অনেককেই।
সম্প্রতি জেনেভা ভিত্তিক ” দা প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন” সংক্ষেপে পি ই সি (The Press Emblem Campaign – PEC) গত এক বছরে (চলতি বছরের ৪ঠা মার্চ পর্যন্ত) বিশ্বব্যাপী করোনায় কতজন সংবাদকর্মী মারা গেছেন তার একটি পরিসংখ্যানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। পিইসি হলো একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক বেসরকারি স্বতন্ত্র সংস্থা। জাতিসংঘ যাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সংস্থার লক্ষ্য হলো পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সংঘর্ষ বা যুদ্ধ চলছে সেসব বিপদজ্জনক এলাকায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান জোরদার করা। পি ই সি এর প্রতি সারা বিশ্বের প্রায় ৫০টি এনজিও এবং সাংবাদিক সংগঠনের সমর্থন রয়েছে। তাদের প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্টটি সাংবাদিক সমাজকে একদিকে যেমন শংকিত করে তুলেছে, অন্যদিকে তেমনি দুঃচিন্তায় ফেলেছে। রিপোর্ট মোতাবেক গত একবছরে কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীব্যাপী আটষট্টিটি (৬৮) দেশে কমপক্ষে আটশো চল্লিশজন(৮৪০) সাংবাদিক মারা গেছেন। যাকিনা গড়ে দৈনিক ২ জনের বেশি। তাদের মতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর, মিডিয়া কমিউনিটিতে এটা সৰ্বোচ্চ সংবাদকর্মী মৃতের রেকর্ড।
অর্ধেকেরও বেশি সাংবাদিকের মৃত্যু ঘটেছে ল্যাটিন আমেরিকায়। ল্যাটিন আমেরিকার আঠারোটি(১৮) দেশে চারশো আটান্নজন(৪৫৮)মারা গেছেন। এশিয়ার সতেরোটি(১৭) দেশে মৃতের সংখ্যা একশো একান্নজন (১৫১), ইউরোপের ষোলোটি (১৬) দেশে মৃত্যুর হার একশো সাতচল্লিশ (১৪৭), উত্তর আমেরিকার দুইটি(২) দেশে মারা গেছেন পঁয়তাল্লিশজন (৪৫) আর আফ্রিকার পনেরোটি (১৫) দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ঊনচল্লিশজন(৩৯)সাংবাদিক।
বিভিন্ন দেশে মার্চ, ২০২০ থেকে এপর্যন্ত সংবাদকর্মী মৃতের পরিসংখ্যান:
পেরু – সর্বাধিক ১০৮ জন, ব্রাজিল – ১০২জন (উল্লেখ্য ২০২১ সালের শুরুতে মাত্র দুই মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর আঘাতে ব্রাজিলে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় পঞ্চাশজন (৫০) সাংবাদিক), মেক্সিকো – ৮৭ জন, ভারত – ৫৬ জন, ইতালি – ৪৬ জন, বাংলাদেশ – ৪৪ জন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – ৪৪ জন (মৃতের তালিকায় বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ষষ্ঠ),ইকুয়েডর – ৪২ জন, কলাম্বিয়া – ৩৭ জন, গ্রেট ব্রিটেন – ২৬ জন, পাকিস্তান – ২৩ জন, তুরস্ক – ২১ জন, পানামা -১৬ জন, ইউক্রেইন্ – ১৪ জন, বলিভিয়া – ১৪ জন, রাশিয়া – ১৩ জন, স্পেন – ১২ জন, আফগানিস্তান – ৯ জন, আর্জেন্টিনা – ৯ জন, ডোমিনিকান রিপাবলিক – ৮জন, হণ্ডুরাস – ৮ জন, নাইজেরিয়া – ৮জন, দক্ষিণ আফ্রিকা – ৮জন, ভেনেজুয়েলা – ৮জন, মিশর – ৬ জন, ফ্রান্স – ৬ জন, নিকারাগুয়া – ৬ জন, গুয়াটেমালা – ৪ জন, ক্যামেরুন – ৩ জন, ইরান – ৩ জন, মরক্কো – ৩ জন, নেপাল – ৩ জন, সালভাদোর – ৩ জন, সুইডেন – ৩ জন এবং জিম্বাবুয়ে – ৩ জন। আলজেরিয়া – ২ জন, কিউবা – ২ জন, ইন্দোনেশিয়া – ২ জন, প্যারাগুয়ে – ২ জন, পর্তুগাল – ২ জন।
এছাড়া কমপক্ষে একজন করে সাংবাদিক মারা গেছেন :
অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান, বেনিন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্যানাডা, চিলি, চেক রিপাবলিক, কঙ্গো, জার্মানি, ঘানা, ইরাক, ইসরায়েল, জাপান, জর্দান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কিরগিজস্তান,লেবানন, মোজাম্বিক, পোল্যান্ড, সৌদি আরব, সুইৎজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, টোগো, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উরুগুয়ে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, চীনের উহান প্রদেশে করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তি হলেও, এই রিপোর্ট অনুযায়ী চীনে কোনো সংবাদ কর্মী এখন পর্যন্ত প্রাণ হারাননি। পিইসি এর রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, মৃত সংবাদকর্মীদের কেউ – কেউ কর্মস্থলে কিংবা তাদের পরিবার- পরিজন বা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। স্থানীয় মিডিয়া, ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ জার্নালিস্টস এবং পিইসির রিজিওনাল সংবাদদাতাদের তথ্যের উপর ভিত্তি করে পিইসি সংবাদকর্মী মৃতের এই রিপোর্ট তৈরী করেছে।
ব্রিটেনে একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সংবাদকর্মীসহ যখন এই লেখাটি লিখছি,তখন পর্যন্ত মোট ২৭ জন সংবাদকর্মীর মৃত্যুর সংবাদ জানা গেছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল “এনটিভির” অত্যন্ত বিনয়ী এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল সংবাদ কর্মী ও ক্যামেরাম্যান ইলিয়াস আহমেদ শিলু করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা আমাদের এই সহকর্মীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং একইসাথে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।এছাড়া বহু বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরণের দ্বারে উপনীত হয়েও সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। আমার মতো নগন্য ও অখ্যাত সংবাদকর্মীও তাঁদের একজন। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, মৃতের হার কমিয়ে আনতে হলে অনতিবিলম্বে এনএইচএস কর্মীদের মতো শিক্ষক ও সাংবাদিকদেরও সম্মুখ সারির কর্মী হিসেবে বিবেচনা করে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড – ১৯ ভ্যাকসিন দেয়া এখন ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। পিইসির দাবী, বিশ্বব্যাপী সংবাদকর্মী মৃতের হার আরো বেশি হতে পারে। কারণ তাদের মতে, কোনো কোনো দেশে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে সঠিক মৃতের সংখ্যা নিরুপন করা প্রায় অসম্ভব। তার উপর জাতীয় মিডিয়াগুলোও সংবাদকর্মী মৃতের খবর সবসময় প্রচার করছে না।
করোনায় মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদকর্মীরা গুম,খুন,সন্ত্রাসী হামলা, ক্রস ফায়ারের মুখোমুখি হচ্ছেন। আহত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন, কারাবরণ করছেন আবার কেউ – কেউ নিখোঁজ রয়েছেন। শারীরিভাবে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের কারণে অনেকের মানসিক মৃত্যু ঘটেছে, যা কিনা হত্যার সামিল। এর সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের অপপ্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই নিবর্তনমূলক বা কালো আইন প্রবর্তন করা হয় ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে এই কালো আইনের আওতায় মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৬৩টি। আর ২০২০ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৮ তে। এর মধ্যে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সংবাদকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। ব্রিটেন ভিত্তিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯ এর এক বার্ষিক রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক (?) সরকার বলে দাবী করে থাকেন। অথচ বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সাংবাদিক দম্পতি সাগর – রুনির হত্যার বিচার হয়নি। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সংবাদকর্মীদের প্রতি সরকারের এধরণের উদাসীনতা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? তা চিন্তা করার ভার না হয় সুপ্রিয় পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম। কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করে যদি দেশে – বিদেশে সংবাদকর্মীরা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার মহান ব্রত গ্রহণ করেন, তাহলেই সাংবাদিক নির্যাতনের হার এবং জীবনহানি দ্রুত হ্রাস পাবে বলে অভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী
(সৌজন্যে: সাপ্তাহিক পত্রিকা)
আরও পড়ুন: