এই “প্রবাস পিতার” সাথে আমার পরিচয় ১৯৯১ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাসে। সে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাসাদ্দুক ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাঁর স্নেহভাজন হতে পেরেছিলাম। বাঙালি কমিউনিটির জন্য কাজ করার উৎসাহ তাঁরই কাছ থেকে পেয়েছিলাম। পূর্ব লন্ডনের হ্যানবারি স্ট্রিটে “এথনিক কমিউনিটি সার্ভিস” বলে একটি সংগঠন ছিল। তাসাদ্দুক ভাই এবং প্রয়াত আলী রেজা খান ভাই সংগঠনটি পরিচালনা করতেন। বাঙালি এবং অন্যান্য কমিউনিটির লোকজনকে ধরতে গেলে প্রায় বিনামূল্যে এই সংগঠন থেকে আইনি পরামর্শ ও সহায়তা দেয়া হতো। আমি দীর্ঘদিন এই সংগঠনের সাথে কাজ করেছি। হাতে ধরে তাসাদ্দুক ভাই ও রেজা ভাই আমাকে নানাবিধ কাজ শিখিয়েছেন। কমিউনিটির সেবা করার মূলমন্ত্র তাঁরাই আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তাসাদ্দুক ভাইয়ের সৃষ্ট অনেক সংগঠনের মধ্যে “ওপেন ফোরাম” নামে একটি সংগঠন ছিল। এ সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি কমিউনিটির সমস্যা, তার সমাধান খুঁজে বের করা, বাঙালিদের অধিকার, বৃটিশ মূলধারার রাজনীতিতে কিভাবে বাংগালী নতুন প্রজন্মকে সন্নিবেশিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা, বাঙালিদের শিক্ষা , বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা। একটা সময় তাসাদ্দুক ভাই আমাকে “ওপেন ফোরামের” সাথে জড়িত করেন। প্রতি মাসে এই ফোরামের পক্ষ থেকে আমরা অন্তত একটি করে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করতাম।উল্লেখ্য তাসাদ্দুক ভাইয়ের মুখে শুনেছি, সত্তরের দশকে তাঁর বিখ্যাত “গঙ্গা” রেস্টুরেন্টে এই “ওপেন ফোরাম” এর জন্ম হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সমস্যা নিয়ে ফোরামের মুক্ত ও অবাধ আলোচনায় যে কেউ ইচ্ছা করলে তখন অংশ নিতে পারতেন।
ব্রিটেন প্রবাসে তাসাদ্দুক ভাই এবং আলী রেজা খান ভাই ছিলেন একাধারে আমার অভিভাবক, শিক্ষক, পরামর্শ দাতা, পথ প্রদর্শক, শুভাকাঙ্খী ও আপনজন। দিনের ও সন্ধ্যার বেশিরভাগ সময় তাদের সাথে কাজ করতে হতো। জীবনের কঠিন সিদ্বান্ত নেয়ার জন্য সবসময় তাদের শরণাপন্ন হয়েছি। ভলান্টারী কাজের পাশাপাশি একাউন্টিং ফার্মে যখন কাজ করতে আর ভালো লাগছিলো না, তখন একদিন তাসাদ্দুক ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম সোশ্যাল সার্ভিসে নাকি শিক্ষকতা পেশায় কাজ করবো বুঝতে পারছি না। কোনো ভাবনা – চিন্তা না করে তাসাদ্দুক ভাই আমাকে শিক্ষকতা পেশা বেঁছে নেবার পরামর্শ দিলেন। রেজা ভাইও তাতে সায় দিলেন। আমার লেখাপড়া ছিল একাউন্টেন্সিতে। তাই ভেবেছিলাম অংক বিষয় নিয়ে পিজিসিই করবো। আমার ইচ্ছার কথা শুনেই তাসাদ্দুক ভাই ধমক দিয়ে বললেন, একদিন এই প্রবাস থেকে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বাঙালি নতুন প্রজন্মের ছেলে – মেয়েদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ও শেঁকড়ের সাথে পরিচয় করানোর জন্য আমাদের দরকার বেশি বেশি বাংলা শিক্ষক। তাঁরই পরামর্শে শেষতক আমি ল্যাংগুয়েজে পিজিসিই করলাম। আজ ব্রিটেনের স্কুল – কলেজগুলোর শিক্ষা কারিকুলামে বাংলা ভাষার বেহাল দশা দেখে তাসাদ্দুক ভাইয়ের ভবিষ্যৎ বাণীর কথা বারংবার মনে হয়। তিনি যে কতখানি দুরদর্শীসম্পন্ন ছিলেন তা সহজেই অনুমেয় । তাসাদ্দুক ভাই উপলব্ধি করেছিলেন যে, ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী বাঙালি ছেলে – মেয়েকে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য এদেশের কারিকুলাম অনুযায়ী বাংলা বই রচনা করার আর কোনো বিকল্প নেই। তাঁরই আগ্রহে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী “সহজ বাংলা শিক্ষা” নামে একটি বই লেখেন। মেরিলবোর্ন বাংলাদেশ সোসাইটি অর্থ যোগান দিলেও, সোসাইটির পক্ষ থেকে তাসাদ্দুক ভাই বক্তিগত উদ্যোগে বইটি প্রকাশ করেছিলেন।
সাংবাদিকতার প্রতি ছিল তাসাদ্দুক ভাইয়ের গভীর আসক্তি। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তাসাদ্দুক ভাই তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ এ। এছাড়া করাচি থেকে প্রকাশিত ইভনিং নিউজ পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে ব্রিটেনে আসার পর প্রবাসী বাঙালিদের সুখ – দুঃখের খবরাখবর দেশে সরবরাহ, আবার দেশের খবর প্রবাসীদের জানানো, বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক হালচাল সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালিদের ওয়াকিবহাল করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে “দেশের ডাক” নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা তাসাদ্দুক ভাই প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল অবধি এই পত্রিকাটি প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে একমাত্র বাংলা পত্রিকা হিসেবে প্রচারিত হতো। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় “বাংলাদেশ নিউজ লেটার” নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা বের করতেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর বিদেশিদের কাছে তুলে ধরাই ছিল এই পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য। তার পত্নী, জার্মান বংশোদ্ভূত রোজমেরী আহমদ টাইপরাইটারের সাহায্যে এই নিউজ লেটার প্রকাশে তাঁর স্বামীকে সাহায্য করতেন। এভাবে বিদেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে স্বামী ও স্ত্রী দুজনই অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া ব্রিটেনে এশিয়ান কমিউনিটির প্রথম মুখপত্র হিসেবে তিনি “দ্যা এশিয়ান” নামে একটি ইংরেজি পাক্ষিক পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন বেশ কিছুদিন।
একটা সময় আমি সাপ্তাহিক সুরমা, নতুন দিন এবং জনমত পত্রিকায় খেলাধুলার উপর লেখালেখি করতাম। তাসাদ্দুক ভাই আমার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। কখনো লেখার প্রশংসা করতেন, আবার কখনো লেখার গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। কিভাবে লেখার উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভব সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। সপ্তাহান্তে বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ করতাম বলে আমাকে গর্বের সাথে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। ১৯৯৯ সালে আমি কিংস কলেজে ইংরেজি ভাষায় আবার মাস্টার্স করছিলাম। প্রথম সেমিস্টারের পরেই ভয়েস অফ আমেরিকার লন্ডন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ আসে। স্কুলের শিক্ষকতা, কমিউনিটির কাজ, বিবিসির কাজ, মাস্টার্স কোর্সের লেখাপড়া সবকিছু মিলিয়ে তখন আমাকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো। “ভোয়ার”(VOA) কাজের অফার গ্রহণ করবো কি করবোনা এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এক শনিবারে বিবিসিতে কাজ সেরে ছুটে গিয়েছিলাম সেন্ট মেরীজ সেন্টারে তাসাদ্দুক ভাইয়ের পরামর্শ নেবার জন্য। সব শুনে তিনি আমাকে আমার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার গড়ার পরামর্শ দিলেন। তাঁর কথামতো কিংস কলেজে মাস্টার্স করার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে “ভোয়ার” সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একজন অভিজ্ঞ ও ঝানু সাংবাদিকের সেদিনের পরামর্শ আমার সাংবাদিকতা জীবনে সত্যি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। আর এ ভাবেই তাসাদ্দুক ভাই আমার মতো আরো অনেককে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে গেছেন আমাদের।
তাসাদ্দুক ভাইয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করতো রাজনীতি। তিনি বোধ করি জন্মেই ছিলেন রাজনীতি আর সাংবাদিকতা করার জন্য। তাঁরই মুখে শুনেছি স্কুল, কলেজ জীবন থেকেই তিনি বাম পন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাসাদ্দুক ভাই তৎকালীন প্রগতিশীল যুব আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিলেও তাসাদ্দুক ভাই সমাজতান্ত্রিক মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ, শিক্ষিত, সুলেখক ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে ঢাকার প্রগতিশীল মহলে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তাকে বলতে শুনেছি তিনি ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও সমগ্র পাকিস্তানের বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও নির্ভরযোগ্য সহচর। উল্লেখ্য সিলেটের একটি সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েও, তৎকালীন আসাম সরকারের উর্ধ্বতন ম্যাজিট্রেট পিতার বড়ো ছেলে হয়েও, তাসাদ্দুক আহমদ নিজেকে সমর্পন করেছিলেন, দরিদ্র, অসহায় ও খেঁটে খাওয়া লোকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে সম্মুখভাগ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলায় যখন নুরুল আমিনের মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায়, তখন বামপন্থী কার্যকলাপের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ তাঁর উপর কড়া নজর রাখছিলো। ফলে বাধ্য হয়ে ১৯৫৩ সালের দিকে তাসাদ্দুক ভাই স্বদেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে আসেন। কারন এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে যাচ্ছে তিনি তা টের পেয়েছিলেন। নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ না করলে তাসাদ্দুক আহমদ যে – বড়ো মাপের জাতীয় নেতা হতে পারতেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লন্ডনে আসার পর থেকেই তাসাদ্দুক ভাই বাঙালি কমিউনিটির কল্যানমুলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কমিউনিটির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। ১৯৫৪ সালে মাওলানা ভাসানীর ইউরোপ সফরে তিনি তাঁর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন। ইউরোপে বিশ্ব শান্তি আন্দোলনে যোগদান করতে গিয়ে সেখানে জার্মান তরুণী শান্তিকর্মী রোজমেরীর সাথে পরিচয় , প্রেম ও পরবর্তীতে বিয়ে করেন তাকে। পরে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনের সোহোতে গড়ে তোলেন “গ্যাঞ্জেস” বা “গঙ্গা” রেস্টুরেন্ট। এই “গঙ্গা” রেস্টুরেন্ট একসময় হয়ে উঠেছিল বাঙালিদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার কেন্দ্রস্থল। ব্রিটেনে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী ও সমর্থনকারীদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতে ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান (তখনও তিনি “বঙ্গবন্ধু” উপাধি পাননি) লন্ডনে আসেন। ওই সময় শেখ মুজিব তাসাদ্দুক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে তাঁর “গঙ্গা” রেস্টুরেন্টে যান। এছাড়া মাওলানা ভাসানী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, লেবার পার্টির নেতা মাইকেল ফুট, পিটার শোর, ছাত্র নেতা তারিক আলী, পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ , হামজা আলী, সত্য জিৎ রায়সহ বামঘেঁষা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং ফ্লিট স্ট্রিটের নামকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল “গঙ্গা” রেস্টুরেন্টে। ব্রিটেনের লেবার পার্টির আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আমাদের তাসাদ্দুক ভাই। স্বপ্ন দেখতেন একদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এম পি বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলবেন। আমাকে প্রায়ই বলতেন লেবার পার্টির সক্রিয় কর্মী রাজন উদ্দিন জালালের কথা। তাঁর বিশ্বাস ছিল একদিন রাজন উদ্দিন জালাল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাঙালিদের তথা বাংলাদেশিদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চারজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এম পি রয়েছেন। তাসাদ্দুক ভাইয়ের স্বপ্ন সার্থক হলেও দুর্ভাগ্য তিনি স্বচোক্ষে তা দেখে যেতে পারলেন না।
ব্রিটেনে অনগ্রসর বাঙালি কমিউনিটির শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তার, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, জীবিকার ব্যবস্থা, ব্যবসা – বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার, মেইন স্ট্রিম রাজনীতিতে বাঙালিদের অংশ গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান, বাঙালি মুসলমানদের জন্য গোরস্থানের আন্দোলন ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকান্ডে তাঁর অনন্য ভূমিকা ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশান, বাংলাদেশ কেটেরার্স এসোসিয়েশান এর প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তাসাদ্দুক ভাই জড়িত ছিলেন। স্পিটালফিল্ড স্মল বিজনেস এসোসিয়েশান তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কাজের খাতিরে তাসাদ্দুক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে বহুবার স্পিটালফিল্ড স্মল বিজনেস এর অফিসে ছুটে গিয়েছি। তার ভীষণ শখ ছিল লন্ডন বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার। প্রায়ই এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো। মনোযোগ সহকারে তার পরিকল্পনার কথা শুনতাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে যেতে পারেননি। হঠাৎ করেই ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাক শক্তি ও চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ২০০১ সালের ৮ ই ডিসেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত রমফোর্ড রোডের একটি নার্সিং হোমের একটি ছোট্ট রুমের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে কাটিয়েছেন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি। যখনই তাঁকে দেখতে গিয়েছি, ইশারায় জানতে চেয়েছেন বাঙালি কমিউনিটির সুখ – দুঃখের কথা, জানতে চেয়েছেন ব্রিটিশ মেইনস্ট্রিম রাজনীতির কথা। বাংলাদেশের কথাও জানতে চাইতেন। কারন জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রবাসে কাটালেও নিজ মাতৃভূমির সাথে নাড়ীর যোগটি কখনও ছিন্ন করেননি। আমি সবসময় তার জন্য বাংলা পত্রিকা নিয়ে যেতাম এবং বেঁছে বেঁছে কিছু খবর পড়ে শোনাতাম। কখনও হাসতেন, কখনও চিন্তিত মনে হতো। সবই বুঝতেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারতেন না। তাঁর এই অবস্থা দেখে সহ্য করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল আমার জন্য। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি ড্রাইভ করার সময় অজান্তেই বহুবার চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারিনি। কেঁদেছি বিশালদেহী ও কর্মচঞ্চল তাসাদ্দুক ভাই এর অসহায়ের মতো নির্বাক হুইল চেয়ারে বসে থাকার দৃশ্য মনে করে।
৭৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তাসাদ্দুক ভাই একাধারে ছিলেন বাঙালি কমিউনিটির কিংবদন্তি নেতা, প্রথিতযশা সাংবাদিক, সফল ব্যবসায়ী, চিন্তাবিদ, মনীষী, প্রবাসে বাঙালি কমিউনিটি গড়ার অন্যতম প্রধান স্থপতি, উঁচুমানের সংগঠক, পথ প্রদর্শক এবং বাঙালির বাতিঘর। তাঁকে আমি ইতিহাসবিদ, জীবন্ত ও চলন্ত তথ্য ব্যাংক বলেও আখ্যায়িত করতে চাই। তাকে নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, তাসাদ্দুক আহমদ ছিলেন প্রবাসে বাঙালিদের “নেলসন ম্যান্ডেলা”, “মহাত্মা গান্ধী”, “মাওলানা ভাসানী”, “হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী” এবং “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”। দীর্ঘদিন আঁঠার মতো তাঁর সাথে লেগে থেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, স্বভাবে তাসাদ্দুক ভাই ছিলেন সময়নিষ্ঠ ও প্রতিশ্রুতিরক্ষক, সৎ, নির্ভীক, নিষ্ঠাবান, স্পষ্টবাদী, বিনয়ী এবং পরোপকারী। বিশেষ করে তরুণদের তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। মনে প্রশ্ন জাগে বর্তমানের ব্রিটিশ – বাঙালি নতুন প্রজন্মের তরুণ – তরুণীরা আসলেই কি তাসাদ্দুক আহমদ নামটির সঙ্গে পরিচিত? আমরা কি পেরেছি তাসাদ্দুক আহমদের লেগ্যাসি (LEGACY) এর সাথে তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে? যে টাওয়ার হ্যামলেটসে তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন, মৃত্যুর পর এখানে আজ অবধি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিদর্শনস্বরূপ কোনো কমিউনিটি হলের নামকরণ হয়েছে কি? তাঁর নামে কোনো রাস্তার নামকরণ করা কি যেতো না? কিংবা কোনো প্রাইমারি স্কুলের নাম? টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিল কি পারে না “সিভিক অ্যাওয়ার্ড” এর পাশাপাশি কমিউনিটিতে তরুণদের অসাধারণ কাজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ “তাসাদ্দুক আহমদ কমিউনিটি ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড” চালু করতে? লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব কি পারে না ব্রিটেনে বাংলা প্রিন্টিং মিডিয়া ও বাংলা ইলেক্ট্রিনিক মিডিয়ায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ উভয় মিডিয়া থেকে দুজন করে মোট চারজনকে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতি বছর “তাসাদ্দুক আহমদ জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড” দিতে? অন্তত লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব এর কাছে এটুকু দাবী করাতো মোটেও অযৌক্তিক নয়। লন্ডনে বাংলা সংবাদপত্রগুলোর সাথেতো তাসাদ্দুক ভাইয়ের আত্মার সম্পর্ক ছিলো।
বাঙালিদের “প্রবাস পিতার ” প্রতি এধরণের সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেয়া হলে একদিকে যেমন তাসাদ্দুক ভাইয়ের প্রতি আমাদের ঋণের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হবে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের তরুণ – তরুণীরা প্রবাসে বাঙালিদের অন্যতম প্রধান “রোল মডেলকে” অনুসরণ করে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে। তাই আর কালক্ষেপন নয়, এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের। তাঁর কাজের যথাযথ মূল্যায়নের।
লেখক: শিক্ষক, পরীক্ষক, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী।
(লেখাটি চলতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে )