করোনা পেনডামিক সময়েও ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের সাফল্যে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পালক। বাংলাদেশী বংশদ্ভোদ ফরজানা হোসেন দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) তাকে যুক্তরাজ্যের বর্ষসেরা জিপি চিকিৎসক ঘোষণা করেছে।
ব্রিটেনে কোভিড-১৯ এ সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত এবং মৃতদের তালিকায় এশিয়ানরা সবার উপরে।এখন পর্যন্ত প্রকাশিত পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশীদের অবস্থান এক থেকে তিন এর মধ্যেই। করোনাকালে কমিউনিটিতে ফারজানা হোসেন এর জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান এবং তা জাতীয় গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আনন্দ ছুয়ে যাচ্ছে।
ডা.ফারজানা লন্ডনের দি প্রজেক্ট সার্জারি প্লাস্টো এর পার্টনার। তিনি নিউহ্যামের জেনারেল প্র্যাকটিস ফেডারেশনের বোর্ড ডিরেক্টরের দায়িত্বও পালন করে আসছেন। ডা. ফারজানা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইমারি কেয়ারের সিইও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাজ্যের এনএপিসির কাউন্সিল সদস্য।
ডা. ফারজানা বিগত ১৮ বছর ধরে স্থানীয় পর্যায়ে কৃতিত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়ে আসছিলেন। এবার তিনি জাতীয় পর্যায়ে বর্ষসেরা জিপি চিকিৎসক মনোনীত হলেন। করোনাকালীন দুর্যোগে মৃত্যুঝুকি নিয়ে রোগীদের সেবায় কাজ করছেন তিনি।
করোনা মহামারীতে ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার হিসাবে ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ( এনএইচএস) এর ডাক্তার, নার্স, কেয়ারার ও কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যে বরিস জনসন সরকার জাতীয় হিরো হিসাবে অভিহিত করেছে। লকডাউন সময়ে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্লাপিং এর মাধ্যমে ব্রিটেনবাসীও তাদেরকে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়ে আসছিল।
২৬জুন রোববার এনএইসএস-এর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান সামনে রেখেই নিজেদের ১২ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে বিলবোর্ড বানিয়েছে ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যবিভাগ। এনএইচএস’ জানিয়েছে, এবারের বর্ষপূর্তি সংস্থাটি ব্যতিক্রমভাবে উদযাপন করছে। কিংবদন্তি ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার র্যাংকিন কে দিয়ে ১২ চিকিৎসকের ছবি তোলানো হয়েছে। সেই ছবি দেশটির বিভিন্ন স্টপেজ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড আকারে ঝুলানো হয়েছে।
লিডারশীপ দায়িত্বে নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ সেখানে অন্যদের সঙ্গে স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশী বংশদ্ভোদ ডা. ফারজানা। ব্রিটেনের ঐতিহ্যিক এবং নানাভাবে মর্যাদাকর লন্ডনের পিক্যাডেলী সার্কাস্থ সাটারস্টক ডটকম তাদের বিলবোর্ডে স্থান দিয়েছে। ছবিতে দেখা যায় বিলবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যুক্তরাজ্যের বর্ষসেরা জেনারেল প্রেকটিকশনার ফারজানা। ডা. ফারজানার এই ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার , ফেইসবুক ও ইন্ট্রোগামে অগণিত মানুষের ওয়ালে সেটে আছে। ব্রিটেনের প্রজন্মরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের শিকড়ের আলোর বার্তাটিও। যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক ডা. ফারজানা ইস্ট লন্ডনের নিউহ্যাম বারায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি বিশ্বখ্যাত ভার্চুয়াল সার্জন ও বিশিষ্ট ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডক্টর শফি আহমদ এর স্ত্রী।
ফারজানার বাবাও পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। বাবা ডা. ফখরুল হোসেন ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে আসেন। তার নানা মরহুম আব্দুল হামিদ আসাম প্রভিন্স এর শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
ফারজানার শশুর যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন এবং বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা মরহুম মিম্বর আলী।
ডাক্তার দম্পত্তি ফারজানা হোসেন ও শফি আহমদ এর বাড়ী সিলেট এর বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর গ্রামে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে।
দেশ সেরার জিপি চিকিৎসকের পুরস্কার পাওয়া ফারজানা হোসেনের ডাক্তার হওয়ার পেছনে আছে তার মায়ের অনন্য ভূমিকা। নিজেকে মানব সেবায় নিয়োজিত করতে তার মা-ই দিয়েছেন অনুপ্রেরণার বীজমন্ত্র।
ফারজানা জানান, ১৯ বছর বয়সে আমার মা হার্টফেল করেন। ওই সময় কার্ডিফে মেডিকেল স্কুলে আমার প্রথম টার্ম ছিল। আমি মাকে দেখতে ২৫৯ মাইল পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে যেতাম। বুঝতাম না মেডিকেলে আর ফেরা হবে কি না। কিন্তু মা বলতেন, তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে আমি ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই। মা পাঁচদিন পর মারা যান।’
ফারজানা বলেন, প্রায় দুই দশক পর নিজেকে যে কতটা সৌভাগ্যবতী মনে হয়, তা বলে বুঝানো যাবে না। এখন রোগীদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, তারাও তো কোনো পরিবারের।
মানুষের সেবাদানে প্রত্যয়ী হওয়া প্রসঙ্গে ফারজানার জীবনের দ্বিতীয় ট্র্যাজেটি রয়েছে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় ট্র্যাজেটি ঘটে যখন আমার বেস্ট ফেন্ড ও মেনটর মারা যায়। বন্ধু ড. পিটার জনস ছিল নিউহ্যামের প্রজেক্ট সার্জারির একমাত্র জিপি পার্টনার। একদিন পিটার আত্নহত্যা করে । তার মৃত্যুতে আমি ভেঙে পড়ি। বলতে গেলে আমি তার কারণেই আজকে পরিপূর্ণ ডাক্তার হতে পেরেছি। রোগীর প্রতি তার ছিল অসম্ভব মমতা ও সম্মান।
তার মৃত্যুর পর আমি প্রজেক্টের সব সামলাতে শুরু করি। তার প্রজেক্টের রোগীরা ব্রিটেনের অন্য হাসপাতালের চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন। যা আমাকেও অনুপ্রাণীত করে। ফারজানা দেশ সেরা জিপি পুরস্কারটি পেয়েছেন এই নিউহ্যাম প্রজেক্ট সার্জারিতে অবদান রাখার জন্য।
নিজের সেবা প্রসঙ্গে ফারজানা বলেন, মানুষের সেবা করছি এটাই বড় কথা। মহামারির সময়ে কাজে যেতে পারি শুধু একটা কথাই ভেবে-যারা বেডে পড়ে আছেন, তাদের ভালো করতে চেষ্টা চালাতে হবে।