মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া চলেনা। সমাজের কিছু নিয়মকানুনের কাছে বলি হচ্ছে এই সমাজেরই মধ্যভিত্ত ও দরিদ্র মানুষগুলি। তাঁরা না খেয়ে শরীরের রক্ত বিক্রি করে হলেও সমাজের ওই সব নিয়মের নামে অনিয়মগুলি রক্ষা করে যাচ্ছেন। আম-কাঁঠাল নিয়ে মেয়ের জামাইরবাড়ি যাওয়া বাঙ্গালি সমাজের একটি প্রথা। আম-কাঁঠালের মৌসুম এলেই আম-কাঁঠাল নিয়ে শুরু হয় তোড়জোড়।
আম-কাঁঠালের মৌস আসলে মেয়ের জামাইরবাড়ি আম-কাঁঠাল মৌসুমি ফল পৌঁছানোর ব্যস্ততা শুরু হয়। বিবাহিত মেয়ের অভিভাবকরা প্রতি বছর আম-কাঠাঁলের মৌসুম আসলে কনের পক্ষ থেকে মেয়ের শশুর বাড়িতে আম, কাঁঠাল লিচু, আনারস, কলা, লটকনি, খই, চিড়া, মিষ্টি, জিলাপি আরো অনেক কিছু পসরা দিতেই হবে। তবে কবে থেকে এসব প্রথা চালু হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
কথিত আছে, বহু বছর আগে এক শৌখিন পিতা তার মেয়ের বাড়িতে বেশ ঘটা করে আম-কাঁঠাল নিয়ে যান। সেই থেকে এ প্রথা শুরু। বর্তমানে এটি অনেকটা বাধ্যবাধকতা হয়েগেছে। স্বচ্ছল পরিবারের জন্য এটি শৌখিন ফ্যাশন হলেও নিম্নভিত্ত কিংবা দরিদ্র পরিবারের জন্য এটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে গিলতে আর না পারছেন বের করে আনতে, এমন অবস্থা। সচেতন অনেকে আম-কাঁঠালের এ বিষয়টিকে কুসংস্কার মনে করলেও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এটি না পৌঁছালে নিজেকে ছোট মনে করেন অনেকে।
রমজান মাস আসলে শুরু হয় ওই একই প্রথা মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দিতেই হবে না হলে মানসম্মান রক্ষা করা যাবে না। তাই তো দরিদ্র ও মধ্যভিত্ত পরিবারের মানুষগুলি মেয়ে বাড়ি ইফতারের নামে সমাজ রক্ষার উপডোকন পাঠান। সমাজে এসব নিয়মের নামে অনিয়ম এমনভাবে মন মানুষিকতায় প্রবেশ করেছে যে এগুলো পালন করতেই হবে। প্রতি বছর আম-কাঁঠালের মৌসুমে বাজারে ফলে দাম গুয়েকগুন বেড়ে যায় প্রতিযোগীতা শুরু হয় কে কার আগে কত বেশি ফল কিনবে! শুধু তাই নয়। পবিত্র রমজান মাস আসলে ওই একই প্রতিযোগীতা শুরু হয়।
মেয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সবাই। এসবের কারণে ইফতারির দাম কমা তো দূরের কথা উল্টো দাম বেড়ে যায়। ইফতারির দাম তখন দরিদ্র ও মধ্যভিত্ত মানুষগুলির নাগালের বাহিরে চলে যায়। এ সমাজে এমনও পরিবার আছে যারা আম-কাঁঠালের মৌসুমে মেয়ের পক্ষ থেকে যদি কোন ফল বা ‘আম-কাঁঠলি’ না আসে তবে গৃহবধূকে শোনতে হয় নানা-কথা যা মানুষিকভাবে আহত করে গৃহবধূ ও মেয়ের পরিবারের লোকজনদের। অনেক সময় মেয়ের শশুর বাড়ির লোক জনের মুখের আক্রমন থেকে বাঁচতে গিয়ে এসব প্রথা বা নিয়মের নামে অনিয়মের দিকে যেতে বাধ্য হন। বাধ্য হন মেয়ের বাড়ি ‘আম-কাঁঠলি’ ও ‘ইফতারি’ দিতে।
‘আম-কাঁঠলি’ ও ‘ইফতারি’ মেয়ে বাড়িতে পৌছানোর আগে তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই খানে চলে আপ্পায়োনের বিরাট আয়োজন। অনেকে আল-কাঁঠলির সাথে নিয়ে যান কাপড়চুপড়। তবে নিম্নভিত্ত ও মধ্য ভিত্তদের এসব আয়োজন বিরাট ধুমধাম না হলেও চোখে পড়ার মত আয়োজন হয়। বিয়ানীবাজার পৌর শহরে দক্ষিণ বাজারে আব্দুল আমিন এসেছেন মেয়ের বাড়িতে ইফতারি কিনে দেওয়ার জন্য। তিনি জানান, ‘‘ওউ আম-কাঁঠলি আর ইফতারি প্রথা আমারউ ফছন্দ নায়, কিন্তু নিয়ম ওইগেছে ইগুলা দেওয়া উচিত আর সারায় মিলিয়া এখটা ফুর্তি ওইগেলো আরকি।’’ (মানে, এইসব প্রথা আমার নিজেরই পছন্দ না। কিন্তু নিয়ম হয়েগেছে এইগুলো দেওয়া উচিৎ আর সবাই মেলে একটু ফূর্তি হয়েগেলো।)
তবে সমাজের এসব ক্যুপ্রথা থেকে বেরিযে আসার উপায় কি? জানতে চেয়েছিলাম একজন সমাজ বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি জানান, ‘‘প্রত্যেক সমাজে কিছু কুসংস্কার, নিয়মের নামে অনিয়ম বিরাজ করে। এগুলো থেকে এক সময় মানুষ বের হয়ে আসতে পারে। আমাদের সমাজের এই আম-কাঁঠলি প্রথা আর মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে ইফতারি প্রদান এসবই সুস্থ সমাজের জন্য অভিশাপ।’’ তবে, অভিশাপ হোক আর যাই হোক এইসব প্রথা দ্বারা সমাজের একটি বড় অংশ আর্থীক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সুতরাং সচেতন মহলের দাবি আর এইসব প্রথা চলতে দেওয়া উচিত না। মেয়ের জামাইর বাড়িতে ‘আম-কাঁঠলি’ আর ‘ইফতার’ প্রথা বন্ধ হোক।