ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় সাফল্য। প্রায় প্রতিদিন একেকটি সাফল্যের খবর সংবাদপত্র ও স্যোসাল মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। প্রবাসের কমিউনিটির মুখ উজ্জ্বল সহ দেশে- বিদেশে সকলকে আনন্দিত করছে। বাড়ছে আমাদের প্রত্যাশা ও আরও এগিয়ে যাবার প্রত্যয়। যা অনেক ইতিবাচক সামাজিক একটা দিকও।
নিউ ইয়র্কে উচ্চ শিক্ষায় আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির সাফল্য তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে অগ্রগামী। গোটা আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত উর্ধ্বগামী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। ইমিগ্রেন্ট বাবা-মা আমেরিকায় এসে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করছেন। কিন্তু সন্তানের শিক্ষার বিষয়ে প্রায় সকলেই সজাগ। সবাই চাচ্ছেন, সন্তানরা তাদের চেয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়ুক। প্রতিটি বাঙালি পরিবার একই মানসিকতায় উজ্জ্বল। বলা যায়, এই অদম্য চিন্তা এবং সন্তানের শিক্ষায় মনোযোগ দেয়া-ই প্রতিটি পরিবারে লেগেছে উচ্চ শিক্ষার ছোঁয়া ও সাফল্য।
তবে এটাও সত্য যে, ইমিগ্রেন্ডদের প্রজন্মরা উচ্চ শিক্ষায় ধারাবাহিক ভাবে ভালো করলেও সামগ্রিক ভাবে মূলধারায় বাংলাদেশীদের সাফল্যের দিকটি উচ্চকিত হতে আরও সময় লাগবে। প্রশাসন,ব্যবসা,সামাজিক,রাজনৈতিক শাখাতে আমেরিকান-বাংলাদেশীদের লিডারশীপ প্রতিনিধিত্বই এই সাফল্যের ধারাকে সবার সামনে দ্রুততম সময়ে পজিটিভ ভাবে প্রকাশ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বাসকরা একজন বাংলাদেশী নিত্য দিনের কাজের মধ্যে পেয়েছেন একটি ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতা। যা এক অর্থে অনেক অনুপ্রেরণাদায়ীও। পেশায় টেক্সিচালক বাংলাদেশী এই ভাইটির মুখে শুনা অভিজ্ঞতাটি প্রাসঙ্গিক ভাবে এখানে বলা যায় –
বাংলাদেশী টেক্সিচালক গাড়িতে তিনজন আমেরিকানকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে লং আইল্যান্ডে যাচ্ছেন।দীর্ঘ যাত্রা পথে তাদের কথপোকথনে তিনি অনুভব করলেন যে, তার যাত্রীরা বৈষম্যবাদী এমনকি, নিজ দেশের কমিউনিটির বিভিন্ন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন।
তার মনে হলো বাংলাদেশীদের বিষয়ে তাদের ‘না জানা‘ থেকে যে নেতিবাচক ধারণা হয়েছে সেখানে একটু নাড়া দেয়ার! মনে হলো আমেরিকান কমিউনিটিতে বাঙালিদের আলোকিত দিক গুলো থেকেই কিছু তাদের বলবেন।
গন্তব্যে পৌছে যাত্রীরা ভাড়া দিতে গেলে বাংলাদেশী এই টেক্সিচালক তাদেরকে নির্ধারিত ভাড়ার অংক বলে তা থেকে দশ ডলার কম দিতে বললেন। সাদা চামড়ার যাত্রীরা তীর্যক দৃষ্টিতে বললো, কেন? আমেরিকার মানুষের একটি গুণ আছে; তারা অহেতুক বদান্যতা পছন্দ করেনা ।
বাংলাদেশী ভদ্রলোক বললেন, আমার একটি ছেলে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে এবং একটি মেয়ে বায়োটেকনোলজি পড়ে, তাদের মাষ্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। এ উপলক্ষে আমি সবার কাছ থেকে কম ভাড়া নিচ্ছি আর সন্তানদের সাফল্য প্রার্থনা করছি। তারা যেন উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে আমাদের কমিউনিটির জন্য ভালো কিছু করতে পারে।
যাত্রীরা তাঁকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার সন্তান ক’জন ? আমেরিকানদের বেশীর ভাগই এশিয়ানদের চার-পাঁচ জন সন্তান থাকার বিষয়েই ধারণা পোষণ করে। এ নিয়ে তারা অনেক সময় ব্যঙ্গবিদ্রুপও করে।
তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, পাঁচ জন। মুখে বিরক্তির ছাপ প্রকাশ করে জানতে চাইলো- বাকি তিনজন কি করে? তিনি বললেন, আগামী বছর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একজনের মাষ্টার্স কম্পিট হবে, একজন নিউ ইয়র্কের জন জে কলেজে ক্রিমিনাল জাষ্টিসের উপর গ্রেজ্যুয়েশনে পড়ছে দু’বছর হলো, আর শেষজন আগামী বছর ব্রুকলিন টেক (ব্রুকলিন টেকনিক্যাল হাইস্কুল আমেরিকার অন্যতম প্রসিদ্ধ হাই স্কুল) থেকে হাইস্কুল গ্রেজ্যুয়েশন শেষ করবে।
এবারে দৃশ্যটা যেন সম্পূর্ণ উল্টো। মুখে বিস্ময়ের আভা ছড়িয়ে এক অন্যের মুখের দিকে তাঁকালো- ‘ হোয়াও, ইটস লাইক এ ড্রিম।’
বিস্ময়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হোয়াট ইজ ইউর এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড? তিনি বললেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে হাইস্কুল পাস করে এসেছেন।
এবার তারা আরেকটু বেশীই যেন অবাক হলো। বলল –‘ আমরা বেশী অবাক হলাম এজন্য যে, তুমি নিজে মাত্র হাইস্কুল পাস করেছো, কিন্তু তোমার সন্তানদের যেভাবে উচ্চ শিক্ষা দিচ্ছো ,তা আমাদের আমেরিকানদের বেলায়ও সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আমাদের সন্তানদের ঠিক এভাবে গড়ে তুলতে পারছি না। তোমাকে অভিনন্দন। ’
এই সুযোগেই বলতে চেষ্টা করলেন আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটির আলোকিত খবর- আমাদের কমিউনিটির প্রতিটি ঘরে একই অবস্থা, আমরা কষ্ট করছি, কাজও করছি অনেকে, কিন্তু, আমাদের সন্তানরা খুব দ্রুত আমেরিকার উচ্চ শিক্ষায় সাফল্যজনক রেজাল্ট করছে। আর এটাই আমাদের গৌরব।‘
এবার আমেরিকান যাত্রিদের চোঁখে-মুখে যেন সত্যিকারের বিস্ময় দেখা যায়। তারা বাঙালী কমিউনিটির জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও অগ্রগতির বিষয়ে অনেক কিছু বাংলাদেশী টেক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে চাইল। হাসি মুখে বিদায় বেলায় তাঁকে ৫০ডলার বকশিস দিতে চাইলে তিনি বিনয়ে গ্রহন করতে অপারগতা প্রকাশ করলে অনেক আন্তরিক ভাবে এই আমেরিকানরা তার নির্ধারিত ভাড়া প্রদান করলো।
কিছুদিন পর, ঐ তিন প্যাসেঞ্জারের একজন আবারও এই বাংলাদেশী ড্রাইভারের যাত্রী হলেন। যাত্রী কথা প্রসঙ্গে ড্রাইভারকে বললো, সেদিন গাড়িতে তাঁর ও বাঙালী কমিউনিটির নতুন প্রজন্মের উচ্চ শিক্ষায় অগ্রগতির গল্প শুনে তারা অবাক হয়েছিলো। আসলে বাঙালি কমিউনিটির সাফল্যের বিভিন্ন দিক তাদের অজ্ঞাত ছিলো। বাসায় গিয়ে তারা এ বিষয়ে ষ্টাডি করে। ফলে আরো অনেক কিছু জানতে পারে।
আমেরিকান এই ভদ্রলোক এর বাংলাদেশী কমিউনিটি সম্পর্কে ধারণা – ‘Bengali parents and kids are very talent, total community is very positive to develop themselves. Bengali community working hard but your life style, ideology and developing thinking is an example for others community in America. I salute you guys after I have seen the improvements statistics of all immigrant community in America. I hope, Bengali next generation will be a gift for America
স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালি ড্রাইভার ভাইটির মুখে তৃপ্তির হাঁসি ছড়িয়ে গেছে। আমেরিকান বাংলাদেশী হিসাবে গৌবর ও অহংকারে বিষয়টিও অনুভব করেছেন।
প্রবাসের বাঙালি কমিউনিটির অর্জনকে ছোট করে দেখার যেমন কোন সুযোগ নেই। তেমনি আমাদের বিন্দু বিন্দু শ্রমে অর্জিত বিষয় ও সাফল্যগুলোকেও অভিবাসী অন্যান্য কমিউনিটিসহ মুলধারায় তুলে ধরতে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করা জরুরী বলে সমাজবোদ্ধারা মনে করেন। বাংলাদেশকে পরবাসে উজ্জ্বলতম করে প্রকাশের কাজটিও এভাবেই সবচেয়ে সফলভাবে হয়ে থাকে। প্রবাসে এই কাজে বাঙালিদের ধারাবাহিক ভাবে কাজ করার বিকল্প নেই।
নিউ ইয়র্ক,২৫ জুন ২০১৮ সাল।
ছরওয়ার হোসেন; লেখক,সংগঠক ।।