হলভর্তী দর্শক। সামনে সাদা-কালো পোষাকে আছেন কয়েকজন, লণ্ডনে সাংস্কৃতি অঙ্গনের চেনামুখগুলো। এর একটু আগেও, হলে উপস্থিত দর্শকরা যে যার মতো কথাবার্তা বলছিলেন। মাইক্রোফোন,শব্দযন্ত্রেরে পরীক্ষাও শেষ। সামনে দাড়ালেন শুভ্রকেশ এর একজন মানুষ।কবি সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ। আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানালেও তার মূখচ্ছবিতে আনন্দআলো চোখে পড়েনি। জানিয়ে দিলেন আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রসঙ্গ। প্রকাশ করলেন- কেন এই আয়োজনের দিনেও সবার আসলেই মনখারাপ । কেন গর্ববোধ করার সময়েও মন খারপ করে থাকতে হয় সবচেয়ে বেশী। উচ্চারিত প্রশ্নগুলোও যেন প্রপম্পট দিচ্ছিল- স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও হতাশা, ক্ষোভ,অপমান,অপবাদ আর ক্ষরণগুলো কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে? কিংবা বহন করে থাকতে হয় বা হচ্ছে নতুন প্রজন্মদেরকে?
অনুষ্ঠানটির দুটি বিষেষত্ব ছিল আমার কাছে-প্রথমটা হলো-এখানে যাঁরা এসেছেন তাঁরা বোধের তাগিদে-ই এসেছেন। এবং সবাই অনুষ্ঠানের প্রতি একাত্ন হয়ে শুনতেই এসেছেন। পেছনের টাঙ্গানো ব্যানারটাও দিয়েছে উজাড় করা শ্রদ্ধা-আবহ। অনুষ্ঠানের শিরোনাম -মহান স্বাধীনতা দিবসের ছান্দসিক‘র নিবেদন-‘বীরাঙ্গনা‘। সাথে ছিল একজন সাহসী নারীর বিমুর্তছবি। উপরে লাল – সবুজ পতাকা; তার উপরে উড়ছে কয়েকটি পাখি…..।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য শোনার জন্য একটি ব্যতিক্রমী এবং খুব সাহসী চিন্তার আয়োজন করেছে- আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিক। ছান্দসিক জন্মলগ্ন থেকে মৌলিক ও সৃজনশীল বান্ধব কাজগুলো তাদের আপন শৈলীতে ধারাবাহিকভাবে করে আসছে। বীরাঙ্গনা অনুষ্ঠানটি তাদের কর্মসৃজন এর একটি ধারাবাহিক কাজ বলা যায়।
ড. নিলীমা ইব্রাহিম‘র লেখা বই “আমি বীরাঙ্গনা বলছি‘‘ থেকে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বীর নারীদের আর্তনাদ এর কিছু অংশ ও সাংবাদিক অপূর্ব শর্মার একটি সাক্ষাৎকার ‘‘আমার তালাশ কে করে‘‘ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় পাঠ এবং শেখ রানা‘র কয়েকটি গাণ এর অংশবিশেষ নিয়েই ছিল পুরো অনুষ্টান। পূর্বলন্ডনের শাহ কমিউনিটি সেন্টারে ২৫ মার্চ রোববার সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানটি চলে রাত নটা পর্যন্ত।
উপস্থাপক রেজুয়ান মারুফ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা শিরোনাম টেনে বর্ণনা দেন- আমাদের গর্বের ধনগুলোর অন্যতম স্থান দখল করে থাকা স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্নত্যাগকারী সকল শহীদ এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধার অবদান ইত্যাদি। তবে এটাও মোটাদাগে উঠে আসে দীর্ঘ পাচঁযুগ এর কাছে দাড়িঁয়ে থাকা বাংলাদেশ এ মুক্তির সোপান তলে লুকিয়ে থাকা লাখো বীরকন্যাদের করুণ দূ:খকথামালা। যারা দেশের জন্য নিজের সবচেয়ে বড়সম্পদ বিসর্জন দিয়েও তাদের স্বীকৃতিটুকু আজও পায়নি। মাথা উচু করে যেখানে গর্ব করে থাকার কথা, সেখানে, তাদের পরিচয় বয়ে গেছে এখনও ‘ব্যাকেট‘ বন্দী পরিচয়ে। যা আলোর চেয়ে সমাজে এখনও অন্ধকার এর আভা ছড়িয়ে দেয় অনেকের কাছে।
ছান্দসিক সেখানেও বলা যায় আরেকটি সাহসী কাজ করেছে। এটা আমাদের জানা আছে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা বীরনারীদের নিয়ে ‘অশ্রুভাষ্য’ নামকরণে-ও একটি থিম আছে। তবে আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিক ‘বীরাঙ্গনা‘ কথনে এই মহীয়সী বীর নারীদের দেশের জন্য গৌরবগাঁথার অবদানে ‘মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য‘ হিসাবেই গর্ববোধের শিরোনাম করেছেন। সদ্য প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ও কাঁকন বিবি বীরপ্রতীকের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, নারী নির্যাতন তথা মুক্তিযুদ্ধে বীরনারীদের হোমহর্ষক কথন,ঘটনাসমূহের আত্মজৈবনিক বর্ণনার বিবরণ পাঠে ছিল পাঁজর খোলা কান্নার আওয়াজ। হলভর্তী দর্শক এর চোখের পাতা ভিজেছে।কিন্তু তাঁর চেয়ে রক্তক্ষরণ অনুভূব করেছেন- এই বীর নারীদের প্রকৃত সম্মান ও ভালোবাসায় রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক সমাজ ব্যবস্থার অবহেলা, বঞ্চনা আর শোষণে।
‘বীরাঙ্গনা‘ মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম প্রধান বীর। বাংলাদেশ বিনির্মাণের ইতিহাসে পরম শ্রদ্ধা ও অনন্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক স্বীকৃতির প্রধানতম দাবীদার হলেও রাষ্ট্র এবং অন্ধ সামাজিক বলয়গুলো তাঁদের অবদানকে কত অনাদর, অবহেলায় রেখেছে, স্বাধীনতার লাল সূর্য উঠার পর থেকে –বীরাঙ্গনাদের কথাগুলো আবৃত্তিশিল্পীদের পাঠ ও কথনে তা বার বার হলভর্তী দর্শকদের বিবেকে সজরে চপেটাঘাত করেছে ।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য পাঠ উপস্থাপন পর্বে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের ইউএনডিপিতে কর্মরত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. সেলিম জাহান, কবি শামীম আজাদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান,সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ এবং লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নাহাস পাশা।
‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা যা বুঝাই,তা হলো ‘মানুষের মুক্তি’। স্বাধীনতার পরেই আসে মুক্তি কথাটা।বঙ্গবন্ধু ৭মার্চের ভাষণে বলেছিলেন,‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এ কথার ভেতরেই অর্ন্তনিহিত রয়েছে ‘মুক্তি’। মর্মস্পর্শী বক্তব্যে কথাগুলো বলেছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড.সেলিম জাহান।
কবি শামীম আজাদ কান্না ভরা কণ্ঠে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বান্ধবী শামীম,যিনি মুক্তিযুদ্ধের অশ্রুদহন নিয়ে কানাডা প্রবাসী ;তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানসিক নির্যাতনের স্মৃতিসহ ভুক্তভোগী যুদ্ধকালীন নিজের পারকরা সময়ের স্মৃতি থেকেও বর্ণনা করেন।
‘আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গেলাম,মা-বোনদের সাথে নিলাম না, চরম বিপদের মধ্যে রেখে গেলাম, হায়নাদের হাতে ফেলে গেলাম, আমরা তাদের সুরক্ষা দিতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।‘ কথা গুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান ।
‘আমার শিক্ষা জীবনে হাতে খড়ি যাঁর হাতে হয়েছিল, তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন নির্যাতিতা।আমি দেশে গেলে তাঁকে সময় করে দেখে আসি। কিন্তু দু:খের বিষয়,ক্ষমতাসীনরা তাঁর ভিটেবাড়ির একটি অংশ দখল করে নিয়েছে। কেউ তাঁর পাশে দাড়ায়নি!এই ক্ষত বহন করে আমি আছি,যেন আমরা তাঁর কেউ নই।‘ প্রতিক্রিয়া বক্তব্যে মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন পুরো হলরুম যেন স্তব্দ ভাষাহীন হয়ে পড়ে কয়েক মূহুর্তের জন্য।
সৈয়দ নাহাস পাশা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমাদের নতুন প্রজন্মদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে। বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের কাহিনী গুলো অনুবাদ করে ব্রিটেনের স্কুল গুলোতে গিয়ে তুলে ধরা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মসহ অন্য ভাষা ও জাতির কাছে তুলে ধরা দরকার আছে।’
এছাড়াও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে সবার বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে- বীর নারীদের আত্নত্যাগ এর বিপরীতে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার চরম অবহেলার দিকটি। ‘সংখ্যাতত্বে‘ এবং ‘ব্যাকেটবন্দী‘ শব্দে এই মহীয়সী নারীদের ‘পরিচয়দানের‘ বিষয়টিও ক্ষোভে উচ্চারিত হয়েছে।
মোট আটজন বীরাঙ্গনার আত্মকথন পাঠ করা হয়। বীরাঙ্গনা শেফা, বীরাঙ্গনা তাঁরা ব্যানার্জি, বীরাঙ্গনা মীনা, বীরাঙ্গনা ফাতেমা,বীরাঙ্গনা রীনা,বীরাঙ্গনা সাফিয়া,বীরাঙ্গনা মেহেরজান ও বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মকথন পাঠে আবৃত্তি শিল্পীরা যেমন কান্না লুকাতে পারেননি। তেমনি দর্শকদের চোখও বারবার ভিজেছে। সাথে বুকের রক্তক্ষরণ এর আওয়াজটি-ও স্পষ্ট বেজেছে শুরু থেকে শেষ হওয়া অবব্দি অদ্ভুদ নিরবতায় । এক নাগাড়ে ঠায় বসে শুনেছেন দূ:খে মনভেজে ওঠা অনুষ্ঠানটি।
ভূমিকা পর্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ছান্দসিক-এর সিনিয়র সভ্য কবি সাংবাদিক হামিদ মোহাম্মদ। আয়োজকদের পক্ষ থেকে কবি ময়নূর রহমান বাবুল উপস্থিত সুধীজনদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সমাপনি বক্তব্য রাখেন।
বীরাঙ্গনা পাঠের সাথে নিজের লেখা গাণ পরিবেশনে যোগ দেয়া কণ্ঠশিল্পী শেখ রানা বলেন, ’এ ধরনের অনুষ্ঠানে সঙ্গীতকে যুক্ত করা আসলেই কঠিন কাজ এবং সাহসের ব্যাপারও বটে। মুনিরা পারভীন আমার সাথে যখন আলাপ করেন, আমি খুশী হয়েই এই সাহসী কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছি। এই রকম কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে গর্ববোধ করছি।’
‘বীরাঙ্গনা বিষয়টিই আমার জানা ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এমন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল,তা সত্যিই ভয়ানক। আজকে বীরাঙ্গনাদের কথন পাঠে অংশ নিয়ে আমি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি।‘’- ব্রিটেনবাসী কলকাতার মেয়ে,সঙ্গীতশিল্পী সোমা দাস দর্শকদের সামনে নিজের পাঠপ্রতিক্রিয়া এভাবেই তুলে ধরেন।
বীরাঙ্গনা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা,গ্রন্থনা ও নির্দেশনার কাজটি করেছেন ছান্দসিক‘র প্রাণ আবৃত্তিকার মুনিরা পারভীন। ভাবনা-চিন্তা-শৈলীতে চমৎকার মুনশিয়ানার কাজটি ভূয়সী প্রসংশীত হয়েছে। অনুষ্ঠান এর শেষ পর্বে মুনিরা পারভীন বিনয়ে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে ৮জন বীরাঙ্গনার কথা তুলে ধরেন জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীন, তাহেরা চৌধুরী লিপি, সোমা দাস, শতরুপা চৌধুরী। এসময়ের জনপ্রিয় গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী শেখ রানা তাঁর নিজের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম মর্যাদার উচ্চাতায়। কথার পিঠে কথা বা সুরেলা কন্ঠের মাধুর্যতায় নয়; তিনি শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মনে বিধে থাকা কথা-সুর-আবহে প্রায় প্রতিটি পাঠের শেষ অংশটি দর্শক-স্রোতাদের বোধে শানিত ভাবে ডুকিয়ে দিয়েছেন চরম আবেগীসৃজনশীলতায়।
অনুষ্ঠানে প্রচ্ছদে বীরাঙ্গনার ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য‘র প্রতীকি রুপটি তুলে ধরতে পোট্রেট এঁকেছেন-ছান্দসিকের আরেক অন্তপ্রান সভ্য আবৃত্তিকার তাহেরা চৌধুরী লিপি। সাথে পাঠ ও কবিতা আবৃত্তি দর্শকদের হৃদগহীন ছোঁয়ে গেছে। ছান্দসিকের সভ্য, আবৃত্তিশিল্পী শতরুপা পুরো অনুষ্ঠানে এতোই গভীরে ঢুকে ছিলেন যে, পুরো অনুষ্ঠানেই তাঁর দুচোখ দূ:খজলে ভেজাছিল।যা সরাসরি স্পর্শ করেছে উপস্থিত দর্শক-স্রোতাদের-ও। প্রাসঙ্গিক তথ্য ও হৃদয়স্পর্শী সঞ্চালনায় পুরো অনুষ্ঠান একটি বাধঁনে ধরে রেখেছেন জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক রেজুয়ান মারুফ। তিনি কখনও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না। তবে, তাঁর প্রতিবাদী আর হার না মানা প্রত্যয়ে চেতনায় জেগে ওঠার শব্দমালা যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের অবহেলা ও আমাদের সামাজিক অন্ধকারের যাতাকলে স্রোতের দিকে চলা সংখ্যাগরিষ্টদের বোধেরগালে সজরে চপেটাঘাত গুলোও ভুলার নয়।
শুরুতেই বলেছিলাম, অনুষ্ঠানটির দুটি বিশেষত্ব ছিল, আমার কাছে। শেষটা হলো; দুই হাজার তের সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে শাহবাগ গণআন্দোলন এর সাথে একাত্নতা পোষণ করে লন্ডন থেকে আন্দোলন এর সময়ে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে দ্বিমত পোষণকারী কিছু প্রগতিবাদীদের অবস্থান ভেসে ওঠে। লন্ডনে আশ্চর্য ভাবে প্রকাশ পায় প্রগতিশীল নামধারী গোটি কয়েক চেহারা! যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীর প্রশ্নে ‘যদি‘ ‘কিন্তু’ ু‘তবে‘ ইত্যাদিতে সবর থেকে আন্দোলনে একাত্নতা প্রকাশ তো করেনইনি, মোঠফোনে ভিন্নবাদী প্রচারে সরব ছিলেন। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রশ্নে তাঁদের পেছনের লেজটিতে ঘ্যাচাং না মারতে পারলেও আমরা আর্দশ্যবিচূত জন হিসাবেই তাদের তসদিক দিয়ে রেখেছিলাম মনে। তাদের দুই- একজন বীরাঙ্গনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।চোখ তাদের দিকেও গেছে। সত্যি বলতে কি, মন না ভিজলেও, তাদেরও মুখটি বিমর্ষছিল। বুকের রক্তকরণ এর বহি:প্রকাশ ফেলতে আমার ঘৃণা-উপহাস গুলোর কিছুটা তাদের দিকে তাকিয়ে, তাদের ‘যদি-কিন্তু-তবে‘র পিচ্ছিলআদর্শিক গায়ে ফেলতেও ‘প্রতিবাদীআনন্দ‘ কাজ করেছে মনে।
মার্চ মাসটি বাংলাদেশী হিসাবে খুব গর্বের। এই মাসেই আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা আমাদের পরিচয় বহন করে। মা ও মার্চ মাস অঙ্গাঙ্গি জড়িত। এই মাসেই পালিত হয় মাদার্স ডে। আমরা যারা ব্রিটেনে থাকি, এই মার্চ মাসেই ঘটে আরেকটি ভালো বিষয়। আবহাওয়ায় পরিবর্তন হয়। বেলা তিনটায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া ‘ব্রিটিশ ও্যয়েদার- ক্লক টাইম“ মার্চ মাসের শেষ রবিবার থেকে পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ বিকাল শেষ সূর্যটাও ৭টার পরে নিভু নিভু হলে অন্ধকার এর আভা দেখা যায়। অর্থাৎ মার্চ মাসে আলোয় ভরে থাকে ব্রিটেন দীর্ঘ সময় । যা ডেফোডিল-টিউলিপ এর ‘‘স্প্রিং টাইম‘‘ এর আনন্দ নিয়েই প্রকৃতিকে ফুল-ফলে ভরিয়ে দিতে হাসি মুখে আসে প্রকৃতিতে। এই মার্চের ২৫ তারিখ বিলেতবাসী সংখ্যাগরিষ্ট নতুন প্রজন্মদের নিয়ে সংগঠন ছান্দসিক বিলেতে সর্ব প্রথম বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে কোন সাহসী পাঠ অনুষ্ঠান এর সফল আয়োজন করল।
বীরাঙ্গনা অনুষ্টানে কারোই চোখে-মনে আনন্দআলো ছিলনা। রাত নটা পরে, ইষ্ট লন্ডনের ভ্যালেন্স রোড দিয়ে পায়ে হেটে অনতিদূরে, যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখনও, মনখারাপ ছায়া রয়েগেছে । তারপরও মনে হয়েছে – আলো নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধশিশু,বীরাঙ্গনা ইত্যাদি বিষয়ে ব্রিটিশ গবেষকদের কাছে একটা মিথ আছে। তা হলো- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উল্লেখিত সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে সবচেয়ে বেশী কাজ করে নতুন প্রজন্ম। এবং প্রমান আছে যে, এই কাজটি একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পরেই শুরু হয়ে হয়ে একটি সত্যিকারে স্বীকৃত ইতিহাস রচনা হয়েছে। বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রিয় সম্মান শুধু মাত্র ১২৩ জন বীরাঙ্গনার মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীনতা যুদ্ধে চার লক্ষ নির্যাতিত মা বোনরা কেন মুক্তিযুদ্ধা সম্মান দেয়া হচ্ছেনা সেটাও উচ্চারিত হয়েছে অনেক বার।
হে বীরাঙ্গনা; বীরকন্যা-বীরনারী-তোমাকে অভিবাদন। বিনম্র শ্রদ্ধা। অসীম ভালোবাসা। তোমরাই লাল-সবুজ বাংলাদেশ।
আনোয়ারুল ইসলাম অভি; কবি,সাংবাদিক। লন্ডন।