বাইডেনতো আমেরীকারই প্রেসিডেন্ট। সন্ত্রাস-টেরোর প্রভৃতি শব্দগুলো কোনদিনই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিলুপ্ত হবে না। ট্রাম্প হয়ত বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর যাবার সাথে সাথেতো জর্জ ফ্লুয়েড দিয়ে যে বর্ণবাদী বিদ্বেষ তিনি আমেরীকায় জিইয়ে রেখে গেছেন, তা থেকে আমেরীকাকে কি মুক্ত করতে পারবেন জো বাইডেন ?
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে শুধু পাঁচজন শ্বেতাঙ্গদের তিনজনই ভোট দিয়েছে, তা-ই নয়। অভিবাসীদের একটা অংশও ট্রাম্পকে পছন্দ করেছেন আমরেীকার ঐতিহাসিক এ নির্বাচনে। অথচ কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী, সম্প্রদায়গত দ্বন্ধ উসকে দেয়া, ধর্মীয় সুড়সড়ি দিয়েই তিনি কাটিয়েছেন তার বিগত চারটি বছর। শুধু তাইনা, নারী নিগ্রহের মত ব্যাপারও আছে তার প্রেসিডেন্ট থকাকালীন সময়ে। তবুও দেখা গেছে, এমনকি বাংলাদেশী অভিবাসীদের কেউ কেউ, অনেকেই তাঁদের স্বাধীন মত প্রয়োগে ট্রাম্পের পক্ষ নিয়েছেন। এমনকি ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিজে ভোট দিয়েছেন, প্রকাশ্যেই সে কথাটি উচ্চারণও করেছেন, দোয়াদুরুদও করে সোশিয়েল মিডিয়ায় ছেড়েছেন।কিন্তু দুঃখজনকভাবে ট্রাম্পের পক্ষ নেয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাবক হিসেবে অনেকেই চালিয়েছেন, এমনকি দেখা গেছে সোশিয়েল মিডিয়ায় আমেরীকা প্রবাসী কেউ কেউ রীতিমত তর্ক জুড়েছেনে, কেন-ই ট্রাম্প বিজয়ী হবেন না, এই নিয়ে।অন্যদিকে বাংলাদেশী রাজনীতির মগ্ন কিছু মানুষ মনে করেছে ডেমোক্রেটের জো বাইডেনের বিজয়ী হবার মধ্যি দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেই যেতে পারে, তাই তাদের ভেতরে ভেতরেও একটা সন্তোষ্ঠি কাজ করতেই পারে।
নিজস্ব মতামত প্রয়োগে কোন বাঁধা নেই। এটাই স্বাভাবিক।এই স্বাভাবিকত্বের কারণে এবার পৃথিবীর প্রবল প্রভাবশালী ট্রাম্পের সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলে নি এমনকি আমরেীকা তথা বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়া।গণমাধ্যমগুলো সাহস করেছে, এমনকি ট্রাম্পের মিথ্যা ভাষনের লাইভ প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য গণমাধ্যমকে ফেইক বলেছেন, এমনকি তার প্রিয় মাধ্যম ‘টুইটকে’ও তিনি নিয়ন্ত্রণহীন বলে সমালোচনা করেছেন।নির্বাচনে পরাজয়ের আভাস তাঁকে মূলত আত্ননিয়ন্ত্রণহীন করে তোলেছে । অভিবাসন নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ঘোষনায় তিনি মূলত অভিবাসন বিরোধী মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত হযেছেন অনেক আগেই। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লুয়েডের নিহত হবার পর তিনি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হযেছেন, কারন তিনি তা সামলা দিতে সম্পুর্ন ব্যর্থ হয়েছেন । ট্রাম্প শুধু তাঁর দেশের ভিন্ন জাতি গুষ্ঠির হৃদয়ে আঘাত করেন নি, তিনি বিভিন্ন সময় তাঁর কথা দিয়ে আহত করেছেন সাংবাদিকদের, তার নিজস্ব মানুষদের । করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ক’দিন আগে যুক্তরাস্ট্রের প্রধান মেডিকেল অফিসার ফাউচীকে তিনি এমনকি জনসমক্ষে অপমান পর্যন্ত করেছেন। সর্বোপরী একজন ‘বেয়াদব’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন আমেরীকাসহ সারা পৃথিবীতেই।
আমেরকিার গত নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটন মিডিয়ায় অনেকটা ঘোষিতই হয়েছিলেন যে, তিন বিজয়ী হচ্ছেন, অথচ ফলাফল উল্টো হয়ে যায়।নির্বাচনের সে ফলাফল নিয়ে বিতর্কও উঠেছে, কিন্তু হিলারী পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন । কিন্তু বিস্ময়করভাবে সত্য হলো, ট্রাম্প ২০২০ এর নির্বাচনের শুরুতেই একধরনের ঘোষণা দিয়ে দিলেন ‘আমি বিজয়ী হচ্ছি, আমি হেরে গেলে আমাকে প্রতারনা করেই হারিয়ে দেয়া হবে’। আমেরীকার মত ঐতিহ্যবাহি গণতান্ত্রিক দেশের একজন প্রেসিডেন্টের এরকম উক্তি শুধুই অনৈতিক উক্তি নয়, রীতিমত অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। এই অনৈতিক মানুষটি শুধু তাঁর দেশের দীর্ঘকালের ঐতিহ্যকে ধুসরিত করনে নি, এসব বলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ম্লান করে দিয়েছেন।
গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এরকমের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই আমেরীকার। এত বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে বেরিয়ে আসে নাই ইতিপূর্বে। এই জায়গাটাতেও কিন্তু ট্রাম্পের অবদান স্বীকার করে নিতে হয়। কারন বিপুল সংখ্যক অভিবাসী, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিংবা উদার গণতন্ত্রী সংখ্যা গরিষ্ট অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী আমেরীকানরা চেয়েছে পরিবর্তন, ট্রাম্প থেকে মুক্তি। তাই তারা বেরিয়ে এসেছে, এবং ভোট দিয়েছে। সেজন্যই পরিবর্তনের দিকে গেছে আমেরীকা এই নির্বাচনে।কিন্তু সত্যি কথাটা হলো বিপুল সংখ্যক আমেরীকান ট্রাম্পের এত বেয়াদবী, তাঁর শালনিতা শালীনতা বর্জিত আচার-আচরণকে তোয়াক্কা না করেই তার পক্ষ নিয়েছেন, এবং সেজন্যই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়েই ট্রাম্পের আপাতত অন্তর্ধান হয়েছে।
ট্রাম্পের পার্টি রিপাবরিকানরা যতটা না অজনপ্রিয়, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তায় ফাটল ধরেছে এ দলটি শুধুমাত্র ট্রাম্পের কারণেই । কারন এতে যতটুকু না দলটির রাজনৈতিক ব্যর্থতা, তার চেয়ে বেশি ব্যর্থতার কারণ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ত্রুটি।তিনি তার গত চার বছর ধরে বিভিন্ন মন্তব্য করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিতর্কিত এবং সমালোচিত হয়েছেন, পার্টিকেও করেছেন সমালোচিত, বিতর্কিত । আমেরীকার মানুষ মনে করছে মহামারি করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব দেন নি ট্রাম্প, সারা পৃথিবী যখন মাস্ক ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে তা পরিধানে তিনি এখনও অনীহা দেখাচ্ছেন, এটা একধরনের অসম্মান জাতির প্রতি। করোনাকালীন কঠিন সময়ে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটাও তার ভুলের মাঝে একটা ।
যেভাবেই হোক যদি কোন অঘটন না ঘঠান ট্রাম্প, অর্থাৎ তাঁর মামলা-মোকদ্দমা যদি দীর্ঘমেয়াদী না হয়, পরাজয়টা মেনে নেন, তাহলে জানুয়ারীর ২০ তারিখই ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ যে উচ্ছাস কিংবা আকাংখা নিয়ে টাম্প থেকে মুক্তি চেয়েছে, তা হয়ত পেয়েছে। কিন্তু আমেরীকা অর্থাৎ ট্রাম্পের সেই ‘গ্রেট আমেরীকা’ থেকে কি মুক্তি পাবে এ বিশ্ব ? অনেকেই বলে থাকেন, ট্রাম্প যুদ্ধ বাধান নি।কিন্তু তনি কি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগি হয়েছেন ? ইরানের সেনাপ্রধানকে হত্যা করার কথা তিনি অস্বিকার করেন নি । ট্রাম্প সৌদিআরব কিংবা আরব আমিরাতকে নাকে খত দিয়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনের সমাধান করেন নি। অর্থাৎ মুসলিম জাতির মাঝে একটা আন্ত যুদ্ধ তিনি বাধিয়ে চলে যেতে পেরেছেন।ইসলামোফোবিয়ার বীজ তিনি রোপন করেন নি, তবে এই ফোবিয়াকে তিনি বিকশিত করেছেন । আমেরীকার কোন প্রেসিডেন্টই এই ফোবিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি, পারেন নি এমনকি বারাক ওবামাও।
সুতরাং বাইডেনতো আমেরীকারই প্রেসিডেন্ট। সন্ত্রাস-টেরোর প্রভৃতি শব্দগুলো কোনদিনই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিলুপ্ত হবে না। ট্রাম্প হয়ত বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর যাবার সাথে সাথেতো জর্জ ফ্লুয়েড দিয়ে যে বর্ণবাদী বিদ্বেষ তিনি আমেরীকায় জিইয়ে রেখে গেছেন, তা থেকে আমেরীকাকে কি মুক্ত করতে পারবেন জো বাইডেন ? সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ এখন কবিড নাইনটিন। ট্রাম্প করোনা সংকট মোকাবেলায় আমেরীকার জনসাধারণের কাছে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এখনও হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন শুধুই আমেরকিায়। বিশ্বব্যাপী এ চ্যালেন্জকে সামনে নিয়েই বাইডেন এসেছেন বিশ্বের প্রধান নেতা হয়ে । সেকারনে শুধু তার দেশই না, করোনা থেকে মুক্তির চ্যালেন্জটাও বাইডেনকে নিতে হবে এই সংকটজন সময়ে।নির্বাচনকালীন সময়ে জরবায়ুর বিষয়টাকে শীর্ষ ইস্যু হিসেবে তিনি জলবাযু পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবেন এই আশাবাদ শুধু আমেরীকার নয়, সারা বিশ্বের। আশাবাদী আমরা। আমেরীকার ভেতরের সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি বাইডেন বিশ্বকে বাসযোগ্য করতে উদ্যোগী হবেন ।