কানাডায় নির্বাচনে জয়ী প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির দল লিবারেল পার্টি
মার্ক কার্নির নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পথে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে তারা পরবর্তী সরকার গঠন করতে চলেছে। এই ফলাফল কানাডার জন্য একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক পরিবর্তন। কয়েক মাস আগেও এই দলটিকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ও শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হতো।
তবে এখনও স্পষ্ট নয়, টানা প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে কিনা। ফলাফল এখনও গণনা চলছে। নির্বাচন থেকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনে কনজারভেটিভ বিরোধী দল বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়েছে।
ট্রাম্পের হুমকি
এটি স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক সংক্রান্ত হুমকি এবং কানাডার সার্বভৌমত্ব নিয়ে মন্তব্য এই নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে। ফলে নেতৃত্ব ও দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে।
মার্ক কার্নি এই পরিস্থিতিকে তার পক্ষে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী পিয়েরে পলিয়েভের বিরুদ্ধে যেমন প্রচারণা চালিয়েছেন, তেমনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও প্রচার করেছেন।
কার্নি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, কানাডা এখন এক সঙ্কটময় মুহূর্তের মুখোমুখি। নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি বারবার বলেছিলেন, “ট্রাম্প আমাদের ভেঙে দিতে চায়, যাতে আমেরিকা আমাদের দখল করতে পারে।”
পিয়েরে পলিয়েভ তার প্রচারের সময় ট্রাম্পের প্রসঙ্গ তুলেছেন অনেক কম। তিনি মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় যেমন জীবনযাত্রার ব্যয়, বাসস্থান সঙ্কট ও অপরাধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি লিবারেলদের এসব ইস্যুতে ব্যর্থতার জন্য আক্রমণ করেছেন।
মার্ক কার্নি ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগের সম্পর্ক এখন শেষ। তিনি নির্বাচনের পরপরই নতুন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন।
কানাডিয়ান ব্যবসায়ী কেভিন ও’লিয়ারি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ এবং এক সময় কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি এই প্রচার কৌশলকে সফল বলে স্বীকার করেছেন।
নির্বাচনের আগে তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, “বর্তমানে কানাডিয়ানরা আমেরিকার ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কার্নি এই অনুভূতিকে তার পক্ষে ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজের ভুলগুলো থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওদিকটা দেখো না। দক্ষিণের দিকে তাকাও, আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারবো’।”
অভূতপূর্ব সূচনা
বছরের শুরুতে মার্ক কার্নি ছিলেন একজন সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। রাজনীতিতে তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তিনি হলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি আগে কখনও কোনও নির্বাচিত সরকারি পদে আসীন ছিলেন না। এটি সম্ভব হয়েছে লিবারেল দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে তার বিশাল জয়ের কারণে।
এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো তিনি জনতার সামনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। তিনি ওটাওয়া এলাকার একটি আসনে জয়ী হন এবং তার দলকে এক অভাবনীয় জয়ে পৌঁছে দেন।
মার্ক কার্নি দীর্ঘদিন ধরে কানাডার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর হঠাৎ পদত্যাগের পর জানুয়ারিতে তিনি সেই সুযোগটি কাজে লাগান।
তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের সময়টা ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কানাডা ও যুক্তরাজ্যের পূর্ববর্তী সঙ্কট মোকাবেলায় তার অভিজ্ঞতা তখন কাজে এসেছে। তখন কানাডিয়ানরা তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।
মার্চের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি গাড়ি আমদানির ওপর নতুন শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেন। এটি কার্নির জন্য এক সুযোগ হয়ে আসে। তিনি নির্বাচনী প্রচারের মাঝেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ পান।
কনজারভেটিভরা অগ্রগতি পেলেও জয় ছিনিয়ে আনতে পারেনি
ভিন্ন কোনও নির্বাচনে এই ফলাফল কনজারভেটিভদের জন্য সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতো। ২০১১ সালের নির্বাচনে তারা ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। এবারের নির্বাচনে, ইলেকশন কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ভোট গণনার অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই পিয়েরে পলিয়েভ প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পাওয়ার পথে রয়েছেন।
বর্তমানে তারা ১৪৯টি আসনে জয়লাভ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মার্চে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার সময় তাদের আসন সংখ্যা ছিল ১২০টি। অর্থাৎ আগের তুলনায় তারা বেশ কিছু আসনে অগ্রগতি অর্জন করেছে।
পিয়েরে পলিয়েভ প্রচারে মূলত অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি জীবনযাত্রার ব্যয়, বাসস্থান সংকট এবং অপরাধের মতো ইস্যুতে লিবারেলদের ব্যর্থতার দিকে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি এই সময়কে “হারানো লিবারেল দশক” বলে আখ্যায়িত করেন।
তবে প্রগতিশীল ভোট একত্রিত হয়ে লিবারেলদের দিকে চলে যাওয়ায়, এই অগ্রগতি বিজয়ে রূপ নিতে পারেনি। এই পরাজয় কনজারভেটিভদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। কয়েক মাস আগেও তাদের জয়ের রাস্তা অনেকটা পরিষ্কার ছিল। কিন্তু এখন তারা আবার পরপর পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে এবং ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণে ভাবতে হবে।
এখন দলের জন্য বড় প্রশ্ন হলো, তারা কি পিয়েরে পলিয়েভকে দলীয় নেতা হিসেবে রাখবে কি না। ২০১৫ সালে লিবারেলদের সুস্পষ্ট জয়ের পর থেকে তিনিই কনজারভেটিভদের তৃতীয় নেতা।
বামপন্থী নিউ ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি
এবারের নির্বাচনে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছে। অধিকাংশ কানাডিয়ান এবার ভোট দিয়েছেন হয় লিবারেল, না হয় কনজারভেটিভদের পক্ষে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বামপন্থী নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এনডিপি।
ছোট দলগুলোর মধ্যে ভোটের হার অনেকটা কমে গেছে। বিশেষ করে এনডিপি এবার এখন পর্যন্ত মোট ভোটের মাত্র ৫ শতাংশ পেয়েছে। অথচ ২০২১ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ১৮ শতাংশ ভোট।
গত প্রায় আট বছর ধরে এনডিপির নেতৃত্বে থাকা জগমিত সিং নিজেই ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় নিজের আসন হারিয়েছেন। এর পর তিনি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি, এই রাত নিউ ডেমোক্র্যাটদের জন্য হতাশাজনক। তবে আমরা শুধু তখনই পরাজিত হব, যখন আমরা লড়াই করা বন্ধ করব।” সবুজ দল বা গ্রিন পার্টিও এবার ভোটের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০২১ সালে যেখানে তারা পেয়েছিল ২ শতাংশ ভোট, এবার তারা পেয়েছে মাত্র ১ শতাংশ।
অ্যাঙ্গাস রেইড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট শাচি কার্ল বিবিসিকে বলেন, এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী ছিল ট্রাম্পের আগ্রাসী বক্তব্য। তিনি বলেন, “ট্রাম্পের হুমকি, যুক্ত করার মতো কথা — সব মিলিয়ে এটি কেন্দ্রীয়-বামপন্থী ভোটারদের বড় উৎসাহ যুগিয়েছে লিবারেলদের দিকে ঝুঁকতে।”
কানাডার সার্বভৌমতাবাদ সমর্থনকারী ব্লক কেবেকোয়া দল ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। তবে এই ভোটে তারা কতটি আসন জিতবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এই তথ্যগুলো প্রায় ৩০ শতাংশ কেন্দ্রের ভোট গণনার ভিত্তিতে পাওয়া গেছে।
কানাডার রাজনৈতিক ব্যবস্থা দ্বিদলীয় না হলেও দেশটির ইতিহাসে মূলত কনজারভেটিভ অথবা লিবারেল সরকারই ক্ষমতায় এসেছে বিভিন্ন রূপে।
তবে কানাডার সংসদীয় কাঠামোতে ছোট দলগুলোরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এনডিপি ও ব্লক কেবেকোয়া উভয় দলই বিভিন্ন সময়ে হাউস অব কমন্সে আনুষ্ঠানিক বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করেছে।