ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি সংসদীয় আসন হার্টলপুল বরাবরই ছিল লেবার পার্টির দখলে। আর সেখানে নতুন লেবার নেতা হিসেবে উপনির্বাচনে জেতা কিয়ার স্টারমারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আর আবার একই রকম একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছেন এক উপনির্বাচনে। এটি তার নেতৃত্বের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২১ সালে হার্টলপুল আসনটি বরিস জনসনের কনজারভেটিভ দলের কাছে হারানো ছিল বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্টারমারের সময়কালের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। এর ফলে তিনি দলে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন। এবার রানকর্ন ও হেলসবির আসনটি নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে দলের কাছে চলে গেলে সেটিও তেমনই একটি ধাক্কা হতে পারে। তবে লেবার পার্টির এই আসনটি ধরে রাখার কথা। কারণ এক বছর আগেও তারা সেখানে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে জরিপে দেখা যাচ্ছে, লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা কমেছে, রিফর্মের সমর্থন বেড়েছে এবং জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে—ফলে ফলাফল অনিশ্চিত।
রানকর্নের ফলাফল এই বছরের স্থানীয় ও মেয়র নির্বাচনগুলোর জন্য দিক নির্দেশক হবে। লেবার পার্টি আসনটি ধরে রাখতে পারলে সরকারের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। আর যদি রিফর্ম বিজয়ী হয়, তাহলে নাইজেল ফারাজের প্রভাব আরও বাড়বে। এতে “রেড ওয়াল” অঞ্চলের লেবার এমপিদের মধ্যে উদ্বেগও বাড়বে। যদিও রানকর্নে লেবার পার্টি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, কিন্তু এ বছর ইংল্যান্ডের স্থানীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কনজারভেটিভ পার্টি। কারণ অধিকাংশ নির্বাচন হচ্ছে মধ্য ইংল্যান্ড ও দক্ষিণাঞ্চলের কনজারভেটিভ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। এসব আসনে ২০২১ সালে কনজারভেটিভরা ভালো ফল করেছিল। তখন রিফর্ম দলে ফারাজ সক্রিয় ছিলেন না এবং সরকার করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রমের সাফল্যের কারণে জনপ্রিয় ছিল।
এবার প্রায় ১ হাজার কনজারভেটিভ কাউন্সিলর পুনরায় নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন। জরিপ অনুযায়ী দলটির অবস্থান আরও খারাপ—ফলে অনেকেই পদ হারাতে পারেন। বিগত সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে খারাপ ফলাফলের এক বছর পরও কনজারভেটিভ পার্টির পতনের ধারা যেন এখনও থামেনি। এই নির্বাচনী পর্বের মূল বিষয় হবে নতুন কিছুর সন্ধান। রিফর্ম পার্টির উত্থান এখন শিরোনামে। প্রায় সব নির্বাচনী এলাকায় তারা প্রার্থী দিয়েছে। এতে করে তারা তাদের পূর্বসূরি ইউকিপ দলের সেরা ফলাফলকে অতিক্রম করতে পারে। বিশেষ করে ডার্বিশায়ার, লিঙ্কনশায়ার ও কেন্টের মতো অঞ্চলগুলোতে—যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট বেশি ছিল—রিফর্ম পার্টির ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। দলটি আরও বড় সাফল্য পেতে পারে।
লিঙ্কনশায়ারে এক সাবেক কনজারভেটিভ এমপি এবং হাল ও ইস্ট ইয়র্কশায়ারে একজন অলিম্পিক স্বর্ণপদকজয়ী রিফর্ম পার্টি থেকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিভক্তির কারণে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ আসনও রিফর্মের ঝুলিতে যেতে পারে। তবে শুধু রিফর্ম পার্টিই ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিতে বিরক্ত ভোটারদের একমাত্র আশ্রয় নয়। সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস ও গ্রিন পার্টির উত্থানও লক্ষণীয়। আর উভয় দলেরই সামনে আরও অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২২ সাল থেকে কয়েকশ আসন জিতে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা স্থানীয় সরকারে তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। এটি জোট সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর তাদের জন্য একটি নতুন সূচনা তৈরি করেছে। এই সাফল্যই গত জুলাইয়ে শতাব্দীর সেরা নির্বাচনী ফল অর্জনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। দলটির নেতা এড ডেভি আশা করছেন, এক সময়ের কনজারভেটিভ-প্রধান অঞ্চল যেমন অক্সফোর্ডশায়ার, কেমব্রিজশায়ার ও গ্লউচেস্টারশায়ারে শক্তিশালী ফলাফল এনে তার দলকে ‘হোম কাউন্টিজ’-এ প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। এমনকি বিভক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে কোনও কোনও মেয়র নির্বাচনে মধ্যবর্তী অবস্থান থেকেও জয় সম্ভব হতে পারে।
গ্রিন পার্টিও ক্রমাগত উন্নতি করছে। তারা প্রতিবারের তুলনায় বেশি প্রার্থী দিচ্ছে এবং গত কয়েক বছরে কয়েকশ আসনে বিজয় অর্জন করেছে। আগের মতো এবারও গ্রিন পার্টি আশা করছে, শহর ও কাউন্সিল পর্যায়ে তাদের উপস্থিতি বাড়ালে জাতীয় সংসদে আসন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন সম্ভব হবে। সাধারণ নির্বাচনে গ্রিন পার্টির তিনটি আসনই এসেছিল এমন অঞ্চল থেকে, যেখানে তারা আগে থেকেই শক্তিশালী কাউন্সিল গড়ে তুলেছিল।
এবার আরও বড় একটি সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে ইংল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের মেয়র পদে। সেখানে লেবার পার্টির বিদায়ী মেয়রের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে, যা গ্রিন পার্টির জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে। ওই মেয়র অঞ্চলটি ব্রিস্টলসহ এমন এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে গ্রিন পার্টির শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। বর্তমানে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা কমছে, কনজারভেটিভ পার্টি কার্যত নিষ্ক্রিয়, লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আর রিফর্ম ও গ্রিন পার্টি প্রায় সর্বত্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। ফলে এবারই হতে যাচ্ছে প্রথম সত্যিকারের পাঁচ-দলীয় স্থানীয় নির্বাচন।
এই নজিরবিহীন বিভক্তি ভোটারদের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে নিয়ে যাচ্ছে। “ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট” পদ্ধতিতে যে এগিয়ে থাকে, সেই সবকিছু পায়, বাকিরা কিছুই পায় না। কিন্তু যখন ভোটাররা একাধিক দলের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন, তখন এর ফলাফল হয় বিশৃঙ্খল।
পরবর্তী মাসে শত শত কাউন্সিলর ও মেয়র হয়তো নির্বাচিত হবেন এমন পরিস্থিতিতে, যেখানে বেশিরভাগ ভোটই অন্যদের পক্ষে যাবে। ভোট তিন বা চার ভাগে বিভক্ত হলে স্থানীয় সমর্থনের চেয়ে বিরোধীদের বিভাজন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভৌগোলিক অবস্থান ও জনপ্রিয়তার সূক্ষ্ম পার্থক্য জয় বা পরাজয়ের মধ্যকার ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। এই ধরনের অস্থিরতা ও অসঙ্গতি আগামী মাসের নির্বাচনকে আরও জটিল করে তুলবে। ফলাফল বোঝা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।
এমন বিভক্ত প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খল ফলাফল একটি গভীর বাস্তবতাও তুলে ধরবে: ব্রিটেনে দ্বিদলীয় রাজনীতি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন ভোটাররা আর শুধু লেবার বা টোরি—এই দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছেন না। তারা সেই প্রাতিষ্ঠানিক বাধা উপেক্ষা করছেন, যা এতদিন তাদের এই সীমাবদ্ধ পছন্দে বাধ্য করত। গত জুলাইয়ে প্রধান দুই দলের প্রতি জনসমর্থন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর থেকে সেটি আরও কমেছে। নির্বাচনী পদ্ধতি এ প্রবণতাকে কিছুটা রোধ করেছিল, যা লেবার পার্টির জন্য উপকারে এসেছে। তবে কোনও বাঁধই চিরস্থায়ী নয়। আগামী মাসে হয়তো দেখা যাবে, সেই বাঁধ ভেঙে গেলে কী ঘটে।