মফিদুল হক
সন্জীদা খাতুন চলে গেলেন। বাংলাদেশ ও বাঙালির জীবন বিকাশের ইতিহাসে তিনি বহুভাবে ভূমিকা পালন করে গেছেন। একজন মানুষ নিজেকে কত উজাড় করে দিতে পারেন নানান ক্ষেত্রে, সেখানে তাঁর খুব বেশি তুলনীয় উদাহরণ আমরা পাব না। বলতে গেলে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব তিনি।
তাঁর বড় পরিচয় সংগীতশিল্পী হিসেবে। কিন্তু শিল্পী না বলে সংগীতের সাধক বলাই সংগত। সংগীতের সাধক, শিল্পের সাধক, সংস্কৃতির সাধক। আবার এই সাধনার যেমন গভীরতা আছে; তেমনি সংগীতচর্চাকে জনে জনে ব্যাপ্ত করে দেওয়ার জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞ তাঁর। আর এটা জীবনের সূচনার দিক থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন। তারপর যখন নিজেকে নানাভাবে দক্ষ করে তুললেন এবং নানা রকম যোগ্যতার পরিচয় দিলেন; সর্বক্ষেত্রে তাঁর একই অবদান দেখি। একদিকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচয়; আরেক দিকে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাখ্যায় তিনি অতুলনীয়। যারা বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্টজন, তারাও সন্জীদা খাতুনকে খুবই সম্মানের জায়গা দিতেন। তিনি অধ্যাপনা করেছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যাপক হিসেবে তাঁর যে ভূমিকা, সেটাও অনন্য। সন্জীদা খাতুন পিএইচডি করেছিলেন অনেক আগে। তারপর তিনি পোস্ট ডক্টরেট করলেন; ডি-লিট পেলেন।
এসব কিছুর চাইতেও বড় গবেষণা তিনি এর পর করলেন। কবিতায় ধ্বনির বিচার-বিশ্লেষণে তিনি কম্পিউটার প্রয়োগ এবং এর সঙ্গে শিল্পের বিশ্লেষণ ও মেলবন্ধন বানালেন। এত গভীর কাজ তিনি করেছেন যে, এই কাজের গভীরতা নিয়ে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
তিনি গানের শিক্ষক। আজীবন গান শিখিয়েছেন জনে জনে। গান শিখিয়ে আনন্দ পেয়েছেন। সংগীত শিক্ষাদান তাঁর আরেকটি ব্রত। কীভাবে দিনের পর দিন একজন মানুষ ব্যক্তিজীবন, সংসারজীবন– সবকিছু তুচ্ছ করে সংগীত শিক্ষাদানে উৎসর্গিত ছিলেন; সেটা ছায়ানটকে কেন্দ্র করে একটা বড় মহিরুহের আকার পেল। ছায়ানটও ষাটের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ ঘিরে প্রতিবাদী আয়োজন থেকে বিকশিত হলো। এর সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাশাপাশি তিনি আবার রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের হয়ে সারাদেশে রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলা গানের প্রসারের জন্য কাজ করলেন। কেবল যে আনুষ্ঠানিক কাজ, তা নয়। তিনি অনেক জেলায় গিয়েছেন; ছোট শহরে গিয়ে ছেলেমেয়েদের গান শিখিয়েছেন। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন দশকের পর দশকজুড়ে হাজারো শিল্পী। ছায়ানট তো বটেই; এর বাইরেও সারাদেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন এবং তাদের জীবনে এটা এক সম্পদ।
আবার দেশের দুর্যোগে, যেটা আমরা ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক প্রশ্নে দেখি এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে তিনি প্রবলভাবে দাঁড়িয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যুদ্ধের সময় গানের দল মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা গড়ে তোলা; তারা নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গান গেয়ে অনুপ্রেরণা জোগালো, সেখানেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
আগামী ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের বয়স ৯২ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই যে ৯০-উত্তীর্ণ তাঁর জীবন, সেটা সর্বতোভাবে তিনি মানবিক সমাজ ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ব্যয় করেছেন। এই যে সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্যের বিশাল সম্পদ; সেটা আহরণ করা ও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজ কতভাবে যে তিনি করেছেন, তার কোনো শেষ নেই।
এই মানুষটি চলে গেলেন; কিন্তু বটের ছায়া তো রয়ে গেল। এই বটবৃক্ষ আমাদের জন্য বড় সম্পদ। কতভাবে কত মানুষ বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এই ছায়াতলে জীবনের দীক্ষা ও শিক্ষা পেয়েছে! তারা বহমান রাখবে এই ধারা। আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য তিনি বিশাল সম্পদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
আজীবন একনিষ্ঠ ও সাধারণ, নিরাভরণ জীবন যাপন করেছেন সন্জীদা খাতুন। ষাটের দশকে তাঁকে আমরা যেভাবে দেখেছি, বর্তমান সময়ে এসেও তাঁকে একইভাবে দেখেছি। নিরাভরণ জীবন তাঁর; কিন্তু অন্যদিক দিয়ে এমন সম্পদশালী জীবনের মানুষ খুব কম খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এই সম্পদের সুফল সবাই আহরণ করতে পেরেছে তাঁর সূত্রে।
তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি, তাঁর প্রবন্ধ, চিন্তাশীলতার দিকগুলো যদি বিবেচনায় নিই, সেটাও আরেক বিশাল বৃত্তান্ত। এ রকম সর্বব্যাপ্ত একজন পরিপূর্ণ মানব আমাদের মাঝে ছিলেন।
তাঁর চলে যাওয়া ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি; কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ বহমান থাকবে– এটাই আমাদের আশা; আমাদের শক্তির দিক। এটাই আমাদের প্রেরণা।